অপুর সংসার

অপুর সংসার
"অপুর সংসার" চলচ্চিত্রের পোস্টার
পরিচালকসত্যজিৎ রায়
প্রযোজকসত্যজিৎ রায়
রচয়িতাসত্যজিৎ রায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে
শ্রেষ্ঠাংশেসৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়,
শর্মিলা ঠাকুর,
অলক চক্রবর্তী,
স্বপন মুখার্জি
সুরকাররবিশঙ্কর
চিত্রগ্রাহকসুব্রত মিত্র
প্রযোজনা
কোম্পানি
সত্যজিৎ রায় প্রোডাকশন
পরিবেশকঅ্যাডওয়ার্ড হ্যারিসন
মুক্তি
  • ১ মে ১৯৫৯ (1959-05-01)
স্থিতিকাল১০৭ মিনিট
দেশভারত
ভাষাবাংলা
আয়₹৭৫ - ৮০ লক্ষ

অপুর সংসার (দ্য ওয়ার্ল্ড অফ অপু নামেও পরিচিত) ১৯৫৯ সালের সত্যজিৎ রায় দ্বারা রচিত এবং পরিচালিত ভারতীয় বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র। এটি বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের অপরাজিত উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। পথের পাঁচালী (১৯৫৫) এবং অপরাজিত (১৯৫৬) এর পরে অপুর সংসার হল অপু ত্রয়ীর শেষ পর্ব। এটি বিংশ শতাব্দীর ভারতে অপু নামক এক তরুণ বাঙালির শৈশব এবং প্রাথমিক প্রাপ্তবয়স্কতা সম্পর্কে। চলচ্চিত্রটিতে মূলঅপু চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং অপুর স্ত্রী অপর্ণা চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুর একসাথে প্রথম বার অভিনয় করেন।

১৯৫৯ সালের ১ মে চলচ্চিত্রটি মুক্তির পর সমালোচকদের দ্বারা সমাদৃত হয়। এটি সেরা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের পাশাপাশি সেরা মৌলিক এবং কল্পনা প্রসূত চলচ্চিত্রের জন্য সাদারল্যান্ড পুরস্কার এবং সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় পর্যালোচনা বোর্ড সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছে।

কাহিনী সংক্ষেপ

[সম্পাদনা]

অপু আইএ পাশ করেছে বটে, কিন্তু চাকরি এখনও জোটাতে পারেনি, চাকরির সন্ধানে কলকাতায় ভাড়াবাড়িতে থেকে টিউশন করে সে পেট চালায়। অপুর সংসারের প্রথম দৃশ্যে অপু নিজের কলেজের এক শিক্ষকের কাছে চারিত্রিক সনদপত্র নিতে যায়। বাড়িওয়ালা বকেয়া ভাড়া চাইতে এলে তার সাথে পাক্কা শহুরে লোকের মত ঝগড়া করে অপু। নিশ্চিন্দিপুরের সেই সরল গ্রাম্য বালক এখন পুরোপুরি কলকাতার নাগরিক। বাড়িওয়ালা ভাড়া না পেয়ে তাকে তুলে দেবার হুমকি দিয়ে চলে যাবার সময় ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে গেলে অপু সেটা এবং তার সঙ্গে বাইরের আলোটাও জ্বালিয়ে দেয় – তারপর আবার নির্বিকারে দাড়ি কামানোয় মন দেয়।

বহু বছর বাদে কলেজের প্রাণের বন্ধু পুলুর সাথে দেখা হয় অপুর, ভালো রেষ্টুরেন্ট নিয়ে অপুকে খাওয়ায় পুলু, চাকরির কথাও বলে। অপু বলে সে চাকরি করবে না, পরিশ্রম করবে। অপু একটা উপন্যাস লিখছে, উপন্যাসটা আসলে আত্মজীবনী – পুলুর এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করে অপু, তার উপন্যাস কল্পনা আর বাস্তব অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ। এর সামান্য আগেই সধবার একাদশীর সংলাপ আওড়াচ্ছিল অপু, পুলু বলে প্রেম সম্বন্ধে তার কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই, তাই প্রেমের কথা সে কল্পনা করেও লিখতে পারবে না। অপু পুলুর সাথে তর্ক করে চলে – যদিও তার যে প্রতিবেশিনী রোজ তার বাঁশি শোনার জন্য জানালার ধারে এসে দাঁড়ায়, অপু তাকে দেখে লুকিয়ে পড়ে।

পুলু অপুকে নিমন্ত্রণ কোরে তার মাসির মেয়ের বিয়েতে নিয়ে গেলে ঘটনাচক্রে অপর্ণাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয় অপু, বিয়ের আগে পুলুকে যে চাকরিটা নেবে না বলেছিল সেটার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নেয়।অপর্ণাও শহুরে দরিদ্র জীবনে দরিদ্র স্বামীর ভাড়াবাড়ির সংসারে মানিয়ে নেয়। স্বামী অফিস থেকে ফিরলে তার সঙ্গে মস্করা করে কাগজের ঠোঙা ফাটিয়ে, সিগারেটের প্যাকেটে অনুরোধ লিখে রাখে সিগারেট না খাবার, বাড়িতে কাজের লোক না রাখতে চেয়ে অপুকে অনুরোধ করে বাড়তি টিউশনগুলো ছেড়ে দেবার, আবার অপর্ণা খেতে বসলে অপু পাশে বসে তাকে বাতাস করে।

কাজলের জন্ম দিতে মৃত্যু হয় অপর্ণার। প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে বিপর্যস্ত অপু আত্মহত্যার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না – অপু আবার বোহেমিয়ান হয়ে পড়ে। কাজলকে অপু পছন্দ করে না, কারণ কাজল আছে বলেই অপর্ণা নেই। চাকরদের কাছে মানুষ হবার ফলে মাতৃস্নেহ বঞ্চিত ছেলেটা অত্যন্ত অবাধ্য। তার কাছে কলকাতা এবং বাবা এই দুটো কথাই প্রায় সমার্থক, কারণ তাকে বলা হয়েছে তার বাবা কলকাতায় থাকে এবং দুটোই তার কাছে অদেখা। অপু বাবা হিসাবে কাজলকে ধরতে গেলে কাজল ঢিল ছুড়ে তার মাথা ফাটিয়ে দেয়, কিন্তু সে যখন বলে সে কাজলের বন্ধু এবং তাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চায়, তখন কাজল রাজি হয়। এইভাবে জৈবিক সম্পর্কের সীমানা ছাড়িয়ে মানবিক / সামাজিক সম্পর্ককে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা। অপুর সংসারের শেষ দৃশ্য – অপুর কাঁধে চেপে কাজল চলেছে কলকাতায়।

অভিনয়ে

[সম্পাদনা]

উৎপাদন

[সম্পাদনা]

সত্যজিৎ অপু ট্রিলজির অন্য দুটি চলচ্চিত্রের মতো অপুর সংসার চলচ্চিত্রের জন্য আবার নতুন মুখ চেয়েছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অপরাজিত (১৯৫৬) চলচ্চিত্রে কিশোর অপুর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অডিশন দিয়েছিলেন । যদিও সত্যজিৎ ভেবেছিলেন যে তার চেহারা সঠিক, কিন্তু তিনি তাকে এই ভূমিকার জন্য অনেক বয়স্ক মনে করেছিলেন। সত্যজিৎ তাকে স্মরণ করে দুই বছর পর প্রাপ্তবয়স্ক অপুর চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন।[] সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তখনও জানতেন না যে তাকে ইতিমধ্যেই নাম ভূমিকার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। তিনি সত্যজিৎ রায়ের চতুর্থ ছবি জলসাঘরের সেটে শুটিং দেখতে গিয়েছিলেন। সেদিন, যখন তিনি সেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, সত্যজিৎ তাকে ডেকে এনে অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, "ইনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়; তিনি আমার পরবর্তী ছবি অপুর সংসার "এ অপুর চরিত্রে অভিনয় করছেন, তাকে অবাক করে দিয়েছিলেন।[]  তবে সত্যজিৎ অপর্ণা চরিত্রের জন্য একজন অভিনেত্রী খুঁজছিলেন। এমনকি তিনি একটি স্থানীয় দৈনিকে ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী মেয়েদের থেকে ফটোগ্রাফ চেয়ে একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। বিজ্ঞাপনটির জন্য এক হাজারেরও বেশি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, কিন্তু সত্যজিৎ তাদের কোনোটিই অডিশনের যোগ্য খুঁজে পাননি। এই সময় সত্যজিৎ শর্মিলা ঠাকুর নামে একটি মেয়ের সাথে পরিচিত হন, যিনি সম্প্রতি কলকাতার চিলড্রেনস লিটল থিয়েটারে (সিএলটি) একটি নৃত্য আবৃত্তিতে অভিনয় করেছিলেন। তিনি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সম্পর্কিত, এবং পরবর্তীকালে অডিশন দিয়ে নির্বাচিত হন।[]

নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও, একজন আত্মপ্রকাশকারী অভিনেতা হিসাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তার ক্যারিয়ার পছন্দ এবং বিশেষ করে তার চেহারা সম্পর্কে অনিশ্চিত ছিলেন, কারণ তিনি নিজেকে ফটোজেনিক মনে করেননি। যাইহোক, ১৯৫৮ সালের ৯ আগস্ট যখন ছবিটির প্রথম শটটি এক টেকেই ঠিক হয়ে যায়, তখন তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি তার পেশা খুঁজে পেয়েছেন।[]

সম্মাননা

[সম্পাদনা]
পুরস্কার বছর পুরস্কারের বিভাগ মনোনীত ফলাফল সূত্র
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (ভারত) ১৯৫৯ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অপুর সংসার বিজয়ী []
ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট পুরস্কার
(লন্ডন চলচ্চিত্র উৎসব)
১৯৬০ সাদারল্যান্ড ট্রফি অপুর সংসার বিজয়ী
এডিনবরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ১৯৬০ ডিপ্লোমা অব মেরিট অপুর সংসার বিজয়ী []
ন্যাশনাল বোর্ড অব রিভিউ (যুক্তরাষ্ট্র) ১৯৬০ শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র অপুর সংসার বিজয়ী
বাফটা পুরস্কার ১৯৬২ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অপুর সংসার মনোনীত

অভ্যর্থনা এবং উত্তরাধিকার

[সম্পাদনা]
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রটি দেখতে ওয়াশিংটন, ডি.সি.র ডিপন্ট থিয়েটারে আসেন। (বাম থেকে ডানে) প্রেসিডেন্ট কেনেডি, ভারতে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত কেন্টাকির সিনেটর জন শেরম্যান কুপার, সিনেটর কুপারের স্ত্রী লরেন কুপার, ডুপন্ট থিয়েটারের ম্যানেজার জেরাল্ড জি ওয়াগনার। (১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১)

সংরক্ষণ

[সম্পাদনা]

একাডেমি ফিল্ম আর্কাইভ ১৯৯৬ সালে অপুর সংসার সহ সমগ্র অপু ট্রিলজি সংরক্ষণ করে। ২০১৩ সালে, ভিডিও বিতরণ কোম্পানি দ্য ক্রাইটেরিয়ন কালেকশন , একাডেমি অফ মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের ফিল্ম আর্কাইভের সহযোগিতায় , অপুর সংসার সহ অপু ট্রিলজির মূল নেতিবাচকগুলি পুনরুদ্ধার শুরু করে । এই নেতিবাচকগুলি ১৯৯৩ সালে লন্ডনে একটি অগ্নিকাণ্ডে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এবং রে ফিল্মের সমস্ত ফিল্ম ক্যান এবং টুকরোগুলি স্টোরেজের জন্য মোশন পিকচার একাডেমিতে পাঠানো হয়েছিল, যেখানে তারা দুই দশক ধরে অদেখা ছিল।[] পুনঃপরীক্ষার পর এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল যে, যদিও চলচ্চিত্রের অনেক অংশ প্রকৃতপক্ষে আগুনে বা বয়সের প্রভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তবে অন্যান্য অংশগুলি উদ্ধারযোগ্য ছিল। উপকরণগুলি ইতালির বোলোগনার একটি পুনরুদ্ধার পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছিল: L'Immagine Ritrovata . নেতিবাচক অংশগুলির জন্য যেগুলি অনুপস্থিত বা অব্যবহারযোগ্য ছিল, বিভিন্ন বাণিজ্যিক বা সংরক্ষণাগারের উত্স থেকে সদৃশ নেতিবাচক এবং সূক্ষ্ম-শস্য মাস্টারগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল। ক্রাইটেরিয়ন কালেকশনের নিজস্ব ল্যাব তারপরে তিনটি ফিল্মের ডিজিটাল সংস্করণ তৈরি করতে ছয় মাস সময় ব্যয় করে, কখনও কখনও কিছু অসম্পূর্ণতা ধরে রাখার খরচেও চলচ্চিত্রের স্বতন্ত্র চেহারা সংরক্ষণ করতে বেছে নেয়।

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Ray 1996, পৃ. 131।
  2. "Soumitra Chatterjee on his master Satyajit Ray - Times of India"The Times of India (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০১-২৪ 
  3. Anuradha SenGupta (২৯ জুন ২০০৮)। "Being Soumitra Chatterjee: Star of the East"। CNN-IBN। ১ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০৫-২১ 
  4. "7th National Film Awards" (PDF)চলচ্চিত্র উৎসব অধিদপ্তর। সংগ্রহের তারিখ ১২ অক্টোবর ২০১৭ 
  5. "Apur Sangsar"। Satyajit Ray.org। ২৯ জুন ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ অক্টোবর ২০১৭ 
  6. "The Restoration"Janus Films। ১১ জুলাই ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ আগস্ট ২০১৫ 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]