দেশ | মৌর্য্য সাম্রাজ্য |
---|---|
ভাষা | সংস্কৃত |
ধারাবাহিক | দিব্যাবদান |
বিষয় | অশোকের জীবন |
ধরন | ঐতিহাসিক ও প্রবাদ |
অশোকাবদান (সংস্কৃত: अशोकावदान) বা অশোকরাজাবদান (সংস্কৃত: अशोकराजावदान) দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত বৌদ্ধ গ্রন্থ বিশেষ, যেখানে তৃতীয় মৌর্য্য সম্রাট অশোকের জীবন সম্বন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থে ঐতিহাসিক তথ্য ছাড়াও বহু কল্পকাহিনী স্থান পেয়েছে। এই গ্রন্থে অশোককে একজন বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক শাসক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, যিনি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই ধর্ম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন।[১]
অশোকাবদান বহু বৌদ্ধ প্রবাদ ও কাহিনীর সংগ্রহ হিসেবে পরিচিত দিব্যাবদান গ্রন্থের একটি অংশ বিশেষ। এই গ্রন্থে মথুরা নগরী ও তার বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বিহারের প্রশংস করা হয়েছে বলে জঁ পৃজ্যিলুস্কির মত দিয়েছেন যে, মথুরা অঞ্চলের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এই গ্রন্থ রচনা করেন।[২][৩] ৩০০ খ্রিষ্টাব্দে ফা-হিয়েন আ-ইয়ু ওয়াং চুয়ান নামে এই গ্রন্থকে চীনা ভাষায় অনুবাদ করেন।[৪]:১৬ ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে জঁ পৃজ্যিলুস্কি এই গ্রন্থটিকে ফরাসি ভাষায় এবং ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জন স্ট্রং ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন।
অশোকের আধ্যাত্মিক শিক্ষক বৌদ্ধ ভিক্ষু উপগুপ্তর কাহিনী দিয়ে এই গ্রন্থটি শুরু হয়। উপগুপ্তর পূর্ব-জন্ম এবং মথুরা শহরে তার যৌবনের বর্ণনার এই গ্রন্থে তার সঙ্গে নর্তকী বাসবদত্তার সাক্ষাৎ ও ভিক্ষুত্ব গ্রহণের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।[৪]:১৬
এই গ্রন্থে অশোকের পূর্ব জন্মের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এই কাহিনী অনুসারে, পূর্ব জন্মে তার নাম ছিল জয়। কৈশোরে জয়ের সঙ্গে গৌতম বুদ্ধের সাক্ষাৎ হয়। জয় ধুলোকে খাদ্য জ্ঞান করে তাকে এক বাটি ধুলো দান করেন। তার মহাপরিনির্বাণের বহু বছর পরে এই বালক পরবর্তী কোন এক জন্মে পাটলিপুত্র নগরী থেকে চক্রবর্তী সম্রাট হিসেবে শাসন করবেন বলে গৌতম বুদ্ধ ভবিষ্যদ্বাণী করেন।[৩]
অশোকাবদান গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে যে, অশোকের পিতা বিন্দুসার তার কুরূপের জন্য তাকে অপছন্দ করতেন। অশোক তাঁর সৎভাই ও সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারীকে শঠতা করে একটি জ্বলন্ত কয়লা ভর্তি গর্তে ফেলে দিয়ে হত্যা করেন। তিনি তার মন্ত্রীদের বিশ্বস্ততার ওপর সন্দেহ করে পাঁচশো জন মন্ত্রীকে হত্যা করেন। তিনি বন্দীদের ওপর শারীরিক অত্যাচার করার জন্য একটি কক্ষ নির্মাণ করিয়েছিলেন।[৫][৩] দুঃখ কষ্টে সহনশীল এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে ৮৪,০০০ স্তূপ নির্মাণ করেন।[৪]:১৭
বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে অশোকের ভূমিকা এই গ্রন্থে বিশদে বর্ণিত হয়েছে। এই গ্রন্থানুসারে, অশোক তার ভাই বীতাশোককে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণে উৎসাহিত করেন। এরপর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সম্মান করার জন্য তার মন্ত্রী যশসকে নির্দেশ দেন। এরপর উপগুপ্তকে সঙ্গে করে গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে জড়িত স্থানগুলিতে তীর্থ করতে বেড়িয়ে পড়েন। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য তিনি একটি পঞ্চবার্ষিকী উৎসবের প্রচলন করেন। এই উৎসবে তার সঙ্গে পিন্ডোল ভরদ্বাজের সাক্ষাৎ হয়।[৪]:১৭
অশোকের যুবতী পত্নী তিষ্যরক্ষার ষড়যন্ত্রে তার পুত্র কুণালের অন্ধত্বের কাহিনীও এই গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে। কুণাল পরবর্তীকালে অর্হত্ত্ব লাভ করেন।[৪]:১৮
বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের পরে দুইটি ঘটনায় অশোক হিংসার আশ্রয় নেন। একবার পুণ্ড্রবর্ধনের এক অধিবাসী একটি চিত্র অঙ্কন করেন যেখনে গৌতম বুদ্ধ নিগণ্ঠ ণাতপুত্তকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করছেন বলে দেখা যায়। এক বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর অভিযোগ পেয়ে অশোক তাকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেন ও পরে পুণ্ড্রবর্ধনের সমস্ত আজীবিক সম্প্রদায়ের মানুষদের হত্যার নির্দেশ দেন, যার ফলে প্রায় ১৮,০০০ মানুষ নিহত হন।[৪]:২৩২ কিছু সময় পরে, পাটলিপুত্র নগরীর এক জৈন ধর্মাবলম্বী অনুরূপ একটি চিত্র অঙ্কন করলে অশোক তাকে সপরিবারে জীবন্ত অবস্থায় অগ্নিসংযোগ করে হত্যা করেন।[৬] কোন ব্যক্তি জৈন ধর্মাবলম্বীদের কর্তিত মস্তক এনে দিতে পারলে অশোক তাকে একটি করে রৌপ্য মুদ্রা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। এই আদেশের ফলে ভুলক্রমে এক পশুপালক তার ভাই বীতাশোককে জৈন সন্ন্যাসী ভেবে হত্যা করেন। অশোকের মন্ত্রীরা তাকে উপদেশ দেন যে, এই হত্যাকাণ্ডগুলি জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিদের মধ্যেও বেদনার সঞ্চার করে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে অশোক মৃত্যুদণ্ডের আদেশ রদ করেন।[৪] ঐতিহাসিকদের মতে, এই ঘটনাগুলির সত্যতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।[৭][৮]
অশোকাবদান গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে, শেষ জীবনে অশোক তার রাজকোষের সমস্ত সম্পদ সংঘগুলিকে দান করতেন। তিনি সমস্ত সম্পদ দান করে দেবেন এই ভয়ে তার মন্ত্রীরা তাকে রাজকোষে ঢুকতে বাধা দেন। অতঃপর তিনি তার নিজের ব্যক্তিগত সম্পদ দান করে শান্তিতে মৃত্যুবর্ণ করেন।[৩]
শুঙ্গ রাজবংশের রাজা পুষ্যমিত্র শুঙ্গের কাহিনী দিয়ে অশোকাবদান গ্রন্থটি শেষ হয়। এই গ্রন্থে তাকে একজন বৌদ্ধ ধর্ম বিরোধী শাসক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।[৪]:২৯৩ অন্যান্য অংশের মতো এই কাহিনীও অতিশয়োক্তিতে পরিপূর্ণ বলে মনে করা হয়ে থাকে।[৯]