আবদুল্লাহ কুইলিয়াম | |
---|---|
জন্ম | ১০ এপ্রিল ১৮৫৬ |
মৃত্যু | ২৩ এপ্রিল ১৯৩২ ব্লুমসবারি, লন্ডন, যুক্তরাজ্য | (বয়স ৭৬)
জাতীয়তা | ব্রিটিশ |
উইলিয়াম হেনরি কুইলিয়াম (১০ এপ্রিল ১৮৫৬[১][২][৩] – ২৩ এপ্রিল ১৯৩২), যিনি ইসলাম গ্রহণের পর নিজের নাম আবদুল্লাহ কুইলিয়াম রেখেছিলেন, একজন মুসলমান ছিলেন, যিনি খ্রিষ্ট ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ১৮৮৭ সালে লিভারপুলে ইংল্যান্ডের প্রথম মসজিদ স্থাপন করেছিলেন।[৪]
উইলিয়াম হেনরি কুইলিয়াম লিভারপুলের এক ধনী প্রোটেস্ট্যান্ট পরিবারে ১৮৫৬ সালের এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন।[৫] তিনি তার শৈশবের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন আইল অব ম্যানে। তিনি লিভারপুল ইন্সটিটিউট হাই স্কুল ফর বয়েজ ও ম্যানক্স কিং উইলিয়ামস কলেজে পড়াশোনা করেছেন।[৫]
তিনি ১৮৭৮ সালে আইনজীবী হিসেবে যাত্রা শুরু করেন এবং লিভারপুলের ২৮ চার্চ স্ট্রিটে প্র্যাকটিস করতে থাকেন।[৬] তিনি বিভিন্ন সাড়া জাগানো হত্যা মামলায় আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন। তাকে "লিভারপুলের অঘোষিত অ্যাটর্নি জেনারেল" বলে অভিহিত করা হত।[৬][৭] ১৮৭৯ সালে তিনি হান্নাহ জনস্টনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।[৫] একই সময়ে কুইলিয়াম যুক্তরাজ্যে মাদকদ্রব্য বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।[৮]
১৮৮৭ সালে মরক্কো সফরের সময় যাত্রা বিরতিতে মরক্কোর কয়েকজনকে নামায পড়তে দেখে ইসলামের প্রতি আগ্রহী হন কুইলিয়াম। তিনি সেদিনের কথা সম্পর্কে বলেন:[৪]
“ | জাহাজটি দুলছিল, প্রবল বাতাস বইছিল, কিন্তু তারা তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ করছিল না। আমি তাদের এভাবে নামায পড়তে দেখে ভীষণ অবাক হই। তাদের চেহারায় যে প্রশান্তির ছাপ ছিল তা স্রষ্টার প্রতি তাদের অটুট বিশ্বাস আর আনুগত্যের প্রমাণ। | ” |
তিনি সে সময়ে মরোক্কোতে কিছুদিন অবস্থান করেন এবং ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করেন। এরপর, ৩১ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।[৪] তিনি তার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে বলেন:[৪]
“ | আমার নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে ইসলামের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। বরং অনেক মিল রয়েছে। তাই ইসলাম গ্রহণ করা আমার কাছে খুবই যুক্তিসংগত ব্যাপার মনে হয়েছে। | ” |
ইসলাম গ্রহণের পর তিনি নিজের নাম আবদুল্লাহ কুইলিয়াম রাখেন। তিনি হলেন যুক্তরাজ্যের ভিক্টোরীয় যুগের প্রথম ব্যক্তি, যিনি খ্রিষ্ট ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।[৮] ১৮৮৭ সালে দেশে ফিরে আসার পর তিনি লিভারপুলে দেশটির প্রথম মসজিদ ও ইসলামি কেন্দ্র লিভারপুল মুসলিম ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। লিভারপুলকে তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রধান শহর হিসেবে মনে করা হত।[৪]
১৮৮৯ সালে তিনি ইসলাম প্রচার ও ইসলামের মূলনীতি সংক্রান্ত পুস্তক দ্য ফেইথ অব ইসলাম রচনা করেন।[৫] খুব তাড়াতাড়ি বইটির ২,০০০ কপি বিক্রি হয়ে যায় এবং পরের বছর ৩,০০০ কপি বাজারে আসে।[৬] রানী ভিক্টোরিয়া তার লেখা দ্য ফেইথ অব ইসলাম সংগ্রহ করেছিলেন এবং তার পরিবারের সদস্যদের জন্য আরো ছয় কপি পুস্তক সরবরাহের জন্য আদেশ দিয়েছিলেন।[৯] পুস্তকটি ১৩ টি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।[৯] এছাড়াও তিনি দ্য ক্রিসেন্ট ও ইসলামিক ওয়ার্ল্ড নামের দুইটি পাক্ষিক ও মাসিক সাময়িকী প্রকাশের সাথে যুক্ত ছিলেন।[৫]
১৮৯০ সালে তিনি হল কেইনের বিতর্কিত নাটক ম্যাহোমেট এর প্রদর্শনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন।[৬] ১৮৯১ সালে তিনি মাইকেল হল নামের ধর্মান্তরিত মুসলমানের নামাযে জানাযায় অংশ নিয়েছিলেন, যিনি ছিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ প্রচারক। ১৮৯০ সালে মাইকেল হল ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তার নামাযে জানাযা ছিল লিভারপুলে প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম নামাযে জানাজা।[৬]
১৮৯৪ সালে ব্রিটিশ রানীর অনুমতি নিয়ে অটোমান সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ কুইলিয়ামকে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের 'শেখ-আল-ইসলাম' বা 'মুসলমানদের নেতা' খেতাব দেন।[৪] সে বছর নাইজেরিয়ার লাগোসের শিত্তা বে মসজিদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন।[১০] ১৮৯৬ সালে তিনি অবাঞ্ছিত শিশুদের জন্য মদিনা হোম খোলেন।[৬]
আফগানিস্তানের তৎকালীন আমির তাকে ব্রিটেনের মুসলমানদের নেতা বলে অভিহিত করেছিলেন এবং তিনি লিভারপুলে ইরানের শাহের ভাইস কনসাল হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন।[৫]
তার দাওয়াতি কর্মকাণ্ডের প্রভাবে বহু ব্রিটিশ ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অধ্যাপক নাসরুল্লাহ ওয়ারেন, অধ্যাপক হাসচেম ওয়ারেন ও স্ট্যালিব্রিজের মেয়র রেচেড পি. স্ট্যানলি।[৬] তার কর্মের দরুন যুক্তরাজ্যের প্রায় ছয়শ জন অমুসলিম ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।[৫]
আবদুল্লাহ কুইলিয়াম সুবিধাবঞ্চিতদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার নিয়ে তিনি বেশ সোচ্চার ছিলেন। এক মহিলাকে তার দুশ্চরিত্র স্বামীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদে সাহায্য করতে গিয়ে তার ওকালতি পেশা হুমকির মুখে পড়ে। ওই মহিলার দুশ্চরিত্র স্বামীকে হাতেনাতে ধরার জন্য ফাঁদও পেতেছিলেন তিনি। তখনকার ব্রিটিশ আইনজীবীদের ক্ষেত্রে এটা খুব সাধারণ ঘটনা ছিল। কিন্তু, তাদের ওই কৌশল ব্যর্থ হয়, কুইলিয়াম নিজে উল্টো ফেঁসে যান।[৪] এরপর, বিতর্ক এড়াতে ১৯০৮ সালে তিনি তিনি লিভারপুল ত্যাগ করে কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তানবুল) গমন করেন।[৬][১১][১২][১৩] ১৯১৪ সালে তিনি হেনরি মুস্তাফা লিওন নাম নিয়ে যুক্তরাজ্যে ফিরে আসেন।[১৪]
১৯৩২ সালের ২৩ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সে মাসের ২৮ তারিখে তাকে লন্ডনের ওকিংয়ের ব্রুকউড গোরস্তানে সমাহিত করা হয়।[৬]
তিনি মনে করতেন যে, মুসলমানদের ইউরোপীয় শক্তির হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করা অনুচিত।[১৫] তিনি সুদানে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতির বিরোধী ছিলেন।[১৬] তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অটোমান সাম্রাজ্যের খলিফার সাথে তার হৃদ্যতার দরুন অনেকে তাকে দেশদ্রোহী বলে অভিহিত করতেন।[১৭]
তার স্মৃতিকে উপজীব্য করে ১৯৯৯ সালে আবদুল্লাহ কুইলিয়াম সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়।[৮] ১৯০৮ সালে তার ছেলে লিভারপুল মুসলিম ইন্সটিটিউটের ভবন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে বিক্রি করে দেয়, যা রেজিস্টার অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।[৮][১৩] প্রতিষ্ঠানটি লিভারপুল মুসলিম ইন্সটিটিউটে ঐতিহাসিক মসজিদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সেখানে শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার অর্থসংগ্রহে কাজ করে চলেছে।[১৮][১৯] প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থাও প্রদান করে থাকে।[১৮]
কুইলিয়াম নামের একটি থিংক ট্যাংক দ্য কুইলিয়াম ফাউন্ডেশন নামে ২০০৮ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।[২০][২১] প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ তার নামে করা হয়েছে।[২২] প্রতিষ্ঠানটি ধর্মীয় উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছে।[২৩]