আবুল আস ইবনে রাবী (মৃত্যু ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দ) রাসুলের একজন অন্যতম সাহাবী। একাধারে রাসুলেরর জ্যৈষ্ঠ জামাই ছিলেন।[১] যিনি বনু আবদে শামস এর অন্যতম সদস্য । তার আসল নাম হুশায়ম অথবা ইয়াসির ।
তার পিতা নাম রাবি ইবনে আবদিল উযযা এবং মাতার নাম হালা বিনতে খুওয়াইলিদ,যিনি খাদিজা এর সহোদরা ছিলেন । তার মানে খাদিজা আবুল আস ইবনে রাবি এর খালা ছিলেন । সেই সুত্র ধরে রাসুল বাড়িতে যাওয়া আসার সুযোগ ছিলো । তিনি কুরাইশ গোত্রের আবদু শামস শাখার সন্তান হওয়ার কারণে তিনি ‘আবশামী’ নামেও পরিচিতি লাভ করেন । তিনি ছিলেন খালা-খালুর অতি স্নেহের পাত্র ছিলেন ।
আবুল আসের প্রকৃত নামের ব্যাপারে ইতিহাসে মতভেদ দেখা যায়। লাকীত, হিশাম, মিহশাম, ইয়াসির, ইয়াসিম ইত্যাদি নাম পাওয়া গেলেও তার ডাকনাম "আবুল আস" নামেই তিনি ইতিহাসে খ্যাত। আবুল আস ইবনে রাবী সুদর্শন চেহারা, বংশ পরিচয় এবং বীরত্ব,আত্মমর্যাদাবোধ প্রভৃতি গুণের জন্য আরব সমাজে পরিচিতি ছিলো । মক্কার অধিবাসীরা বিভিন্ন কাফেলা যাত্রাকালে তার ব্যবসায়িক বুদ্ধি, সততা, ও আমানতদারীতার কাছে নিশ্চিন্তে নিজেদের পন্যসম্ভার নিশ্চিন্তে সমর্পণ করতো । ইবন ইসহাক বলেন, ‘অর্থ সম্পদ, আমানতদারী ও ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি তখন মক্কার গণ্যমান্য মুষ্টিমেয় লোকদের অন্যতম। [২]
আবুল আস ইবনে রাবী মুহাম্মদ এর জ্যৈষ্ঠ কন্যা যায়নব বিনতে মুহাম্মদ কে বিবাহ করেন।[১] মুহাম্মাদ নবুওয়াত লাভ করার কয়েক বছর পূর্বে বিবাহটি সম্পন্ন হয়।
মুহাম্মদ ইসলামের দাওয়াত প্রচার তার স্ত্রী যায়নব সহ নবীর অনন্য কন্যাগন ও তাদের মাতা খাদিজা ইসলাম গ্রহণ করেন । আবুল আস স্ত্রী যয়নাবকে খুব ভালবাসতেন কিন্তু তিনি পিতৃপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করতে রাজী না । মুহাম্মদ কুরাইশদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। মক্কার কুরাইশগণ নবীর দুই কন্যাকে স্বামীদের বাড়ি থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু আবুল আস তার স্ত্রীকে ফেরত পাঠান নাই । মক্কার কুরাইশরা আবুল আসকে তার স্ত্রীকে ফেরত পাঠানোর জন্য জোর জবরদস্তি শুরু করে। আবুল আস তাদের প্রস্তাবে রাজি হন নাই ।
হিজরতের পরে মুহাম্মাদ(সা:) মদীনায় চলে আসেন। কুরাইশদের সঙ্গে সংগঠিত বদরের যুদ্ধের অনিচ্ছাসত্ত্বেও আবুল আস যোগ দেন। বদর যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনী পরাজিত হয়। আবুল আস ইবনে রাবী অন্য অনেকের সঙ্গে যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়।
ইবন ইসহাক হতে বর্ণিত, বদর যুদ্ধে হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর ইবন নুমান তাকে বন্দী করেছিলেন। তবে ওয়াকীদীর মতে, হযরত খিরাশ ইবন সাম্মাহর(রা:) হাতে আবুল আস বন্দী হন। [৩]
বদরের বন্দীদের ব্যাপারে মুসলমানরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো, মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। বন্দীদের সামাজিক মর্যাদা এবং ধনী-দরিদ্র অনুযায়ী এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম মুক্তিপণ নির্ধারিত করা হলো । কুরাইশরা বন্ধীদের ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন । জয়নব তার স্বামী আবুল আস ইবনে রাবী কে ছাড়াতে মুক্তিপণ হিসেবে একটি হার দিয়ে তার দেবর আমর ইবন রাবীকে পাঠালেন । উল্লেখ্য হারটি তার মা খাদিজা বিয়ের সময় তাকে উপহার দিয়েছিলেন । এই হার দেখে রাসুল পূর্ব স্মৃতি মনে পরে গেলো রাসুল মুখমণ্ডল বিমর্ষ হয়ে গেলো । রাসুল সাহাবীদের বললেন,তোমরা আবুল আসকে মুক্তিপণের বিনিময়েও ছেড়ে দিতে পারো অথবা জায়নবের এই হারটি তাকে ফেরতও দিতে পারো ।অতঃপর সাহাবীরা আবুল আসকে মুক্ত করে দিলেন এবং হারটি তাকে দিয়ে দিলেন । মুহাম্মদ তাকে এই বলে মুক্ত করলেন, সে মক্কায় ফিরে গিয়ে দ্রুত সময়ে তার কন্যা যয়নাবকে মদীনায় পাঠিয়ে দিবে ।
আবুল আস মক্কা ফিরেই তার ওয়াদা পালনে ব্যস্ত হয়ে পরলেন । তিনি স্ত্রী যয়নাবকে সফরের প্রস্তুতি নিতে বললেন এবং তার ভাই আমর ইবনে রাবি অথবা কিনানকে ডেকে বললেন তুমি জায়নাব কে নিয়ে যাও এবং মক্কার অনতিদূরে তার পিতা মুহাম্মদের প্রতিনিধিরা তার জন্য অপেক্ষা করছে সেখানে জায়নাবকে পৌঁছে দাও । ইবন ইসহাক বর্ণিত,সবার সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ হলে কেনান ইবনে রাবী একটি উট এনে দাঁড় করালো । যয়নাবকে উটের পিঠে নিয়ে দুপুরের দিকে রওনা হলেন কেনান । মক্কার সবাই ব্যপারটা জেনে গেলে তাদের তারা ধাওয়া করে কিছু দুরেই দূরেই ‘যী-তুওয়া’ উপত্যকা নামক স্থানে তাদের ধরে ফেলে এবং আবু সুফিয়ান তাদেরকে মক্কায় যেতে বাঁধা প্রদান করে ফলে কেনান ইবন রাবী যায়নবকে ফিরে আসতে বাধ্য হন । তাবরানী উরওয়াহ ইবন যুবাইর এর বর্ণনা মতে কুরাইশদের আক্রমনে যায়নব আঘাত প্রাপ্ত হন । (হায়াতুস সাহাবা-১/৩৭১)[৪]
আয়েশার বর্ণনা মতে যায়নব তখন সন্তান সম্ভবা ছিলো এবং কুরাইশদের আক্রমনের আঘাতের শরীর কেটে রক্ত বের হয় এমনকি সন্তানও নষ্ট হয়ে যায় ।
স্ত্রী যয়নাব থেকে বিচ্ছেদের পর আবুল আস কয়েক বছর মক্কায় কাটালেন। ৬২৭ সালের অক্টোবর মাসে মক্কা বিজয়ের অল্প কিছুদিন আগে একটা বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে তিনি সিরিয়া থেকে ফিরতি পথে মদীনার নিকতবর্তী স্থানে যায়িদ বিন হারিসার নেতৃত্বে প্রেরিত একটি ক্ষুদ্র টহলদানকারী বাহিনী আক্রান্ত হন এবং কাফেলার সবাইকে বন্ধী এবং কাফেলার সমস্ত মালামাল বায়েজাপ্ত করে মদিনায় নিয়ে যান । আবুল আস ইবনে রাবীর কাফেলাতে ১০০ টি উট ও ১৭০ জন লোক ছিলো ।
তবে সৌভাগ্যক্রমে আবুল আস পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। মূসা ইবন উকবার মতে, আবু বাসীর ও তার বাহিনী আবুল আসের কাফিলার ওপর আক্রমণ চালায়। [২] এরপর আবুল আস পালিয়ে মক্কায় ফেরত না গিয়ে ভীত মনোভাব নিয়ে রাতের অন্ধকারে মদীনায় প্রবেশ করেন এবং তার স্ত্রী জয়নাবের নিরাপত্তা প্রার্থনা করলেন । যায়নব তাকে নিরাপত্তার ব্যপারে আশ্বাস দেন । এভাবে রাত কেটে গিয়ে ফজরের নামাজের জামাতের সময় যায়নব তার পিতা ও সাহাবীদের ব্যপারটা খুলে জানালেন এবং নিরাপত্তা প্রার্থনা করেন ।
এরপর রাসুল মেয়েকে আবুল আসের ব্যপারে সতর্ক করে দিলেন যে আবুল আস তোমার জন্য হালাল নয় । এরপর রাসুল কাফেলার উপর আক্রমণকারী দল- যায়িদ বিন হারিসা নেতৃত্ব দলকে ডেকে বললেন,তোমরা যদি এই লোকটার মালামাল ফেরত দাও তাহলে আমি খুশি হবো আর ফেরত না দিতে চাইলে সেটা তোমার ইচ্ছা,তোমরা সেগুলো ভোগ করতে পারো । এরপর আক্রমনকারী দলের সবাই আবুল আসকে ইসলাম গ্রহণ করার প্রস্তাব দিলেন এবং মালামাল নিয়ে মক্কায় ফেরত যেতে বললেন,কিন্তু আবুল আস ইসলাম গ্রহণের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন ।এরপরেও তাকে কাফেলার সকল মালামাল ফেরত দেওয়া হল ।
আবুল আস তার কাফিলার সমস্ত মালামাল নিয়ে মক্কায় পৌঁছলেন ।এবং কাফেলার মালামাল মক্কার সবার মালামাল পৌঁছে দিলেন । এবং কুরাইশদের বললেন আমি ইচ্ছা করলে মদিনা থাকতেই ইসলাম গ্রহণ করতে পারতাম কিন্তু এজন্য করিনি এতে সবাই ভাবতে পারে আমি কাফেলার মালামাল ফেরত পাওয়ার জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছি ।
অত:পর হযরত আবুল আস মক্কা থেকে বের হয়ে মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেন । হযরত রাসূলে কারীম সা: সম্মানের সাথে তাকে গ্রহণ করেন এবং তার স্ত্রী যয়নাবকেও তার হাতে সোপর্দ করেন। রাসুল আবুল আসের কন্যাকে অন্ত্যন্ত স্নেহ করতেন ।
আবুল আস ইবন রাবী ইসলামের ১ম খলিফার আবু বকরের আমলে মৃত্যু বরন করেন । তবে ইবন মুন্দাহর মতে, তিনি ইয়ামামার যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। [৫]