আলীবর্দী খান | |||||
---|---|---|---|---|---|
সুজা উল-মুলক, হুসাম-উদ-দৌলা, নবাব মুহম্মদ আলীবর্দী খান বাহাদুর, মহব্বত জঙ্গ, বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব নাযিম | |||||
রাজত্ব | ২৯ এপ্রিল ১৭৪০ – ৯ এপ্রিল ১৭৫৬ | ||||
রাজ্যাভিষেক | ২৯ এপ্রিল ১৭৪০ | ||||
পূর্বসূরি | সরফরাজ খান | ||||
উত্তরসূরি | সিরাজদ্দৌলা | ||||
জন্ম | ১০ মে ১৬৭১ দাক্ষিণাত্য | ||||
মৃত্যু | ৯ এপ্রিল ১৭৫৬ মুর্শিদাবাদ, বাংলা (বর্তমান মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) | ||||
সমাধি | |||||
বংশধর | মেহের-উন-নিসা বেগম (ঘসেটি বেগম) মুনিরা বেগম আমিনা বেগম | ||||
| |||||
রাজবংশ | আফসার | ||||
পিতা | শাহ কুলি খান (মির্জা মুহম্মদ মাদানি) | ||||
মাতা | নবাব আকিল খান আফসারের মেয়ে | ||||
ধর্ম | শিয়া ইসলাম[১][২][৩] |
নবাব আলীবর্দী খান (জন্ম: ১০ মে ১৬৭১ – মৃত্যু: ৯ এপ্রিল ১৭৫৬) ১৭৪০ থেকে ১৭৫৬ সাল পর্যন্ত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব ছিলেন। তিনি দীর্ঘ ১৬ বছর বাংলার নবাব ছিলেন এবং তার শাসনামলের অধিকাংশ সময়ই মারাঠা আক্রমণকারী ও আফগান বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যয়িত হয়[৪]। একজন অসমসাহসী ও রণনিপুণ সেনাপতি হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন[৫] এবং কর্মদক্ষ ও দূরদর্শী শাসক হিসেবে তার খ্যাতি ছিল।[৫][৬]
আলীবর্দী খানের প্রকৃত নাম মির্জা মুহম্মদ আলী ।[৭][৮] তার পিতার নাম মির্জা মুহম্মদ মাদানি । তিনি মুঘল দরবার কর্তৃক খান উপাধি পেয়েছিলেন। তুর্কি বংশোদ্ভূত মির্জা মুহম্মদ মাদানি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র আজম শাহের দরবারের একজন কর্মকর্তা ছিলেন।[৭][৫][৯] আলীবর্দী খানের মা ইরানের খোরাসানের এক তুর্কি উপজাতি থেকে এসেছিলেন। তার পিতামহ আওরঙ্গজেবের সৎ ভাই ছিলেন। মির্জা মুহম্মদ আলী পূর্ণবয়স্ক হবার পরপরই আজম শাহ তাকে পিলখানার পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন।[৫]
১৭০৭ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তার পুত্রদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং এ যুদ্ধে আজম শাহ পরাজিত ও নিহত হন[৫]। আজম শাহে এর মৃত্যুর পর তার চাকরি চলে যায় এবং মির্জা মুহাম্মদ আলীর পরিবার দারুণ সমস্যার সম্মুখীন হয়[৫]। ১৭২০ সালে ভাগ্যান্বেষণে তিনি সপরিবারে বাংলায় চলে আসেন। তিনি বাংলার তৎকালীন নবাব মুর্শিদ কুলি খানের অধীনে চাকরির জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু মির্জা মুহম্মদ আলী মুর্শিদ কুলির জামাতা সুজাউদ্দিন খানের আত্মীয় ছিলেন এবং মুর্শিদ কুলি তার জামাতার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। এজন্য তিনি মির্জা মুহম্মদ আলী কে গ্রহণ করেন নি।[৫]
মুর্শিদ কুলি খান কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে মির্জা মুহাম্মদ আলী উড়িষ্যায় গমন করেন। উড়িষ্যার প্রাদেশিক শাসনকর্তা (নায়েব নাযিম) সুজাউদ্দিন খান তাকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করেন।[৫] সুজাউদ্দিন তাকে মাসিক ১০০ টাকা বেতনে রাজস্ব বিভাগের চাকরিতে নিয়োগ দান করেন। অল্পদিনের মধ্যেই তার কাজ ও বিশ্বস্ততায় খুশি হয়ে সুজাউদ্দিন তাকে পদোন্নতি দেন। তিনি মির্জা মুহম্মদ আলীকে সবন্তপুরের থানাদারের পদ এবং ৬০০ অশ্বারোহী সৈন্যের মনসবদারি প্রদান করেন[৫]। তদুপরি সুজাউদ্দিন তাকে উড়িষ্যার কিছু জমিদারির তদারকিও দান করেন। মুহম্মদ আলী উড়িষ্যাতে তার কার্যে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন এবং উড়িষ্যায় শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপনে সুজাউদ্দিনকে সাহায্য করেন।[৫]
১৭২৭ সালে মুর্শিদ কুলি খানের মৃত্যুর পর মির্জা মুহম্মদ আলী বাংলার মসনদ লাভে সুজাউদ্দিন খানকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেন। ফলশ্রুতিতে সুজাউদ্দিন মির্জা মুহম্মদ আলীকে চাকলা আকবরনগরের (রাজমহল) ফৌজদার হিসেবে নিয়োগ দেন। নতুন ফৌজদারের শাসনাধীনে রাজমহলের জনগণ শান্তি ও সমৃদ্ধি লাভ করে।[৫] সুজাউদ্দিন খান ১৭২৮ সালে মির্জা মুহম্মদ আলীকে আলীবর্দী খান উপাধিতে ভূষিত করেন।[১০] এসময় থেকেই মির্জা মুহম্মদ আলী 'আলীবর্দী খান' নামে পরিচিতি লাভ করেন।[৫] দেশ পরিচালনার সকল ক্ষেত্রে আলীবর্দী সুজাউদ্দিনের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। নবাব তার প্রতি এমন নির্ভরশীল হয়ে পড়েন যে, বছরে অন্তত একবার রাজমহল থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে তার ডাক পড়ত।[৫]
১৭৩২ সালে মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহ বিহারকে বাংলার অধীনে নিয়ে আসেন। কিন্তু নবাব সুজাউদ্দিন সম্পূর্ণ অঞ্চল নিজের অধীনে না রেখে আলীবর্দীকে বিহারের নায়েব নাযিম হিসেবে নিয়োগ দেবার সিদ্ধান্ত নেন। ১৭৩৩ সালে তিনি আলীবর্দীকে বিহারের নায়েব নাযিম নিযুক্ত করেন[৫] এবং তাকে পাঁচ হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের মনসবদারি প্রদান করেন। এর কিছুদিন আগেই আলীবর্দীর কনিষ্ঠা কন্যা আমিনা বেগম তার কনিষ্ঠ ভাতিজা জৈনুদ্দিন আহমদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং আমিনা বেগমের গর্ভে সিরাজউদ্দৌলার জন্ম হয়[৫]। আলীবর্দীর নিজের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। আলীবর্দী সিরাজউদ্দৌলাকে তার উত্তরসূরি ঘোষণা করেন।[৫]
আলীবর্দীর দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে বিহার প্রদেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিল।[৫] বিহারের জমিদাররা নবাবের অবাধ্য ছিলেন এবং তাদের অনেকেই লুটতরাজে লিপ্ত হতেন। আলীবর্দী তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং তাদেরকে পরাজিত করে নবাবের বশ্যতা স্বীকার ও নিয়মিত রাজস্ব প্রদান করতে বাধ্য করেন[৫]। টিকারির জমিদার রাজা সুন্দর সিংহ বশ্যতা স্বীকার করে আলীবর্দীর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন এবং মুস্তফা নামক তার অধীনস্থ একজন আফগান নায়ক (সেনা কর্মকর্তাকে) আলীবর্দীর চাকরির জন্য ছেড়ে দেন[৫]। মুস্তফা পরবর্তীতে আলীবর্দীর সেনাপতি রূপে খ্যাতি অর্জন করেন।
এসময় মুঙ্গের জেলায় বসবাসকারী দুরন্ত উপজাতিগুলো ভীষণ উপদ্রব করত। তারা নবাবের কর্তৃত্ব স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানায়। আলীবর্দী তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং কঠোর হস্তে তাদের দমন করেন[৫]। আলীবর্দীর কর্মদক্ষতার ফলে বিহার প্রদেশে বাংলার নবাবের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিহারের অধিবাসীদের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়[৫]।
১৭৩৯ সালের ১৩ মার্চ নবাব সুজাউদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন এবং তার পুত্র সরফরাজ খান নবাব হন। তিনি আলীবর্দী খানকে বিহারের প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসেবে বহাল রাখেন। ৪-৫ মাস আলীবর্দীর সঙ্গে নতুন নবাবের স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় থাকে। এরপর তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি দেখা দেয়। সরফরাজের দুর্বল চরিত্র এবং তার নতুন উপদেষ্টাদের প্রভাব এজন্য বিশেষভাবে দায়ী ছিল[৫]। ক্রমে এ মনোমালিন্য তীব্র সংঘর্ষে রূপ নেয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৭৪০ সালের ৯ এপ্রিল গিরিয়ার যুদ্ধে আলীবর্দী সরফরাজকে পরাজিত ও নিহত করে বাংলার মসনদে আসীন হন[৫]।
বাংলার নবাবি লাভের পর আলীবর্দী খান বাংলার শাসনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ রদবদল আনয়ন করেন[৫]। ১৭৪০ সালের নভেম্বরে মুঘল সম্রাট তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ প্রদান করেন। নবাব পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর আলীবর্দী বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন এবং পরবর্তী এক যুগ তাকে দেশীয় ও আফগান বিদ্রোহী, মারাঠা আক্রমণকারীসহ বিভিন্ন শক্তির বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকতে হয়[৫]।
ক্ষমতা দখলের অব্যবহিত পরে, আলীবর্দি মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহ দ্বারা তার অধিগ্রহণ বৈধ ছিল এবং মুর্শিদ কুলি খানের নীতি পুনরায় শুরু করেন। তিনি পাটনা, দাক্কা এবং ওড়িশার মতো বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ফৌজদারদেরও বেছে নিয়েছিলেন।[১১] ১৭৪২ সাল থেকে মারাঠা সাম্রাজ্য বারবার বাংলায় অভিযান চালায় এবং এর অঞ্চলগুলো ধ্বংস করে। আলীবর্দির প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটি লম্বা খাদ খনন করে, যাকে মারাঠা খাদ বলা হয়, এটি কলকাতার চারপাশে খনন করা হয়েছিল। আলীবর্দি ছিলেন একজন উজ্জ্বল আর্টিলারি কৌশলবিদ, যদিও তার সৈন্যবাহিনী বেরার থেকে মারাঠাদের বিশাল বাহিনীর কম ছিল যারা রঘুজি ভোঁসলের নেতৃত্বে বাংলার অঞ্চলগুলি লুট করতে এবং লুণ্ঠন করতে এসেছিল।
১৭৪৭ সালে রাঘোজির নেতৃত্বে মারাঠারা আলীবর্দি অঞ্চলে অভিযান, পিলেজ এবং সংযুক্তিত করতে শুরু করে। ওড়িশায় মারাঠা আক্রমণের সময়, এর সুবেদার মীর জাফর বর্ধমান যুদ্ধে আলীবর্দি এবং মুঘল সেনাবাহিনীর আগমন পর্যন্ত সমস্ত বাহিনী পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেন, যেখানে রাঘোজি এবং তার মারাঠা বাহিনী পুরোপুরি পরিচালিত হয়েছিল। ক্ষুব্ধ আলীবর্দি তখন লজ্জিত মীর জাফরকে বরখাস্ত করেছিলেন।[১২]
১৭৫১ সালে শুজা-উদ-দৌলার কাছ থেকে কিছু সহায়তা পেলেও ওড়িশায় আলীবর্দির প্রতিরক্ষাবাহিনী অতিক্রম করে। কিন্তু ওড়িশা শেষ পর্যন্ত মুঘল সম্রাট আহমাদ শাহ বাহাদুর দ্বারা বিধ্বস্ত মারাঠাদের কাছে আত্মসমর্পণ করা হয়। ১৭৫১ সাল পর্যন্ত এই মারাঠা অভিযান চলবে যখন আহমাদ শাহ বাহাদুর, আলীবর্দি এবং রঘুজির মধ্যে শান্তি চুক্তি নিষ্পত্তি করা হবে।[১০]
১৭৫০ সালে আলীবর্দি তার মেয়ের ছেলে সিরাজ উদ-দৌলার বিদ্রোহের সম্মুখীন হন, যিনি পাটনা দখল করেন, কিন্তু দ্রুত আত্মসমর্পণ করেন এবং তাকে ক্ষমা করা হয়।[১৩] আলিবর্দি কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল আফগানদের বিদ্রোহকেও দমন করেছিলেন যারা বিহারকে তার প্রশাসন থেকে পৃথক করার চেষ্টা করছিল।[১০]
কিছু ইতিহাসবিদের মতে, আলীবর্দি খানের ১৬ বছরের রাজত্ব বেশিরভাগই মারাঠাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। শেষের দিকে তিনি বাংলার পুনর্নির্মাণ ও পুনরুদ্ধারের দিকে মনোনিবেশ করেন।
নবাব সুজাউদ্দিনের সময় থেকে উড়িষ্যা প্রদেশের প্রাদেশিক শাসনকর্তা ছিলেন সরফরাজ খানের জামাতা দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলি খান রুস্তম জঙ্গ[৫]। তিনি আলীবর্দীর কর্তৃত্ব স্বীকার করতে অস্বীকার করেন এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করেন[৫]। আলীবর্দী ফুলওয়ারীর যুদ্ধে তাকে পরাজিত করে উড়িষ্যা থেকে বিতাড়িত করেন[৫]। দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলি প্রথমে হায়দারাবাদের নিজামের কাছে এবং পরে মারাঠাদের নাগপুর রাজ্যের রাজা রঘুজী ভোঁসলের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন। তার উৎসাহে রঘুজী ১৭৪১ সালের আগস্টে বাংলা আক্রমণ করেন এবং উড়িষ্যা দখল করে নেন। কিন্তু ১৭৪১ সালের ডিসেম্বরে রায়পুরের যুদ্ধে আলীবর্দী মির্জা বাকেরের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী ও মারাঠা বাহিনীকে পরাজিত করে উড়িষ্যা পুনরুদ্ধার করেন[৫]। এর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলির বিদ্রোহের অবসান ঘটে, কিন্তু বাংলায় বিধ্বংসী মারাঠা আক্রমণের সূচনা হয়।
১৭৪১ সাল থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত সময়ে মারাঠারা বাংলায় পরপর ছয়টি আক্রমণ পরিচালনা করে[৫]। তাদের প্রথম পাঁচটি আক্রমণ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়[৫] এবং প্রতিবারই আলীবর্দী তাদেরকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। কাটোয়ার প্রথম যুদ্ধ, কাটোয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধ এবং বর্ধমানের দ্বিতীয় যুদ্ধে আলীবর্দী মারাঠা বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করেন[৫] এবং এর মধ্য দিয়ে তার রণকুশলতার পরিচয় দেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেনাপতিদের অযোগ্যতা, অকর্মণ্যতা ও বিশ্বাসঘাতকতা, সৈন্যদের যুদ্ধক্লান্তি এবং নিজের অসুস্থতা প্রভৃতি নানা কারণে ১৭৪৯ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত পরিচালিত ষষ্ঠ মারাঠা আক্রমণের সময় আলীবর্দী বাংলার মূল ভূখণ্ড থেকে মারাঠাদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হলেও উড়িষ্যা মারাঠাদের দখলে থেকে যায়[৫]। অন্যদিকে, মারাঠারাও তাদের বারংবার পরাজয়ের ফলে হতাশ হয়ে পড়ে এবং শান্তি স্থাপনের প্রস্তাব প্রেরণ করে[৫]। ফলে নবাব শেষ পর্যন্ত ১৭৫১ সালের মে মাসে মারাঠাদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর মধ্য দিয়ে উড়িষ্যা ও দক্ষিণ মেদিনীপুর মারাঠাদের হস্তগত হয়[৫] এবং নবাব মারাঠাদেরকে বাংলা ও বিহার আক্রমণ থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে তাদেরকে বার্ষিক চৌথ কর দিতে সম্মত হন[৫]। দীর্ঘ দশ বছরব্যাপী মারাঠা আক্রমণের ফলে বাংলার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়, অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দেশজুড়ে তীব্র বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়[৫]।
মারাঠা আক্রমণের সুযোগে ১৭৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে নবাবের উচ্চাভিলাষী আফগান সেনাপতি গোলাম মুস্তফা খান বিদ্রোহ করেন এবং মুর্শিদাবাদ ও বিহার দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন এবং ১৭৪৫ সালের ৩০ জুন ভোজপুরের যুদ্ধে বিহারের প্রাদেশিক শাসনকর্তা জৈনুদ্দিন আহমদ তাকে পরাজিত ও নিহত করেন[৫]। এরপর আফগান বিদ্রোহীরা মারাঠাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে। ১৭৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিহারে দুই আফগান সেনানায়ক সমশের খান ও সরদার খান বিদ্রোহ করেন এবং জৈনুদ্দিন আহমদকে হত্যা করে তার স্ত্রী ও পুত্রদেরকে বন্দি করেন। মীর হাবিবের নেতৃত্বে মারাঠা হানাদারেরাও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়[৫]। অবশেষে আলীবর্দী ১৭৪৮ সালের ১৬ এপ্রিল কালাদিয়ারার যুদ্ধে তাদের পরাজিত করলে বিদ্রোহের অবসান ঘটে[৫]।
এসময় মুঘল সম্রাট কর্তৃক অনুমোদনপ্রাপ্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকরা বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করত। তারা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষার জন্য দেশীয় ও অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হত। এজন্য ১৭৪৫ সালে আলীবর্দী আইন জারি করে ইংরেজ, ফরাসি ও ওলন্দাজ বণিকদের তার রাষ্ট্রে যুদ্ধে লিপ্ত হতে এবং তাদের উপনিবেশগুলোতে দুর্গ নির্মাণ করতে নিষেধ করেন[৫]। ১৭৪৮ সালে ইংরেজ বণিকরা বাংলায় আর্মেনীয় ও মুঘল বণিকদের কয়েকটি জাহাজ আটক করে। জাহাজগুলো ছেড়ে দেয়ার জন্য আলীবর্দী কলকাতার ইংরেজ শাসনকর্তা বারওয়েলকে নির্দেশ দেন। তা অমান্য করায় আলীবর্দী ইংরেজ বণিকদের বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেন[৫]। বাধ্য হয়ে ইংরেজরা আর্মেনীয় ও মুঘল বণিকদের জাহাজগুলো ছেড়ে দেয় এবং দেড় লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়[৫]। এরপর আলীবর্দী তাদের বাণিজ্যিক সুবিধাদি ফিরিয়ে দেন।
যদিও আলীবর্দীর শাসনামলের অধিকাংশ সময়ই নানা যুদ্ধ-বিগ্রহে ব্যয়িত হয়, তবুও এরই মধ্যে তিনি বাংলার শাসনব্যবস্থার উন্নতি সাধন করেন। দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলি ও আফগানদের বিদ্রোহ দমন করে তিনি অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করেন এবং মারাঠা আক্রমণ প্রতিহত করে বাংলার জনসাধারণকে রক্ষা করেন[৫]। আলীবর্দী ধর্মীয় উদার নীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং এর ফলে বহু হিন্দু উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন[৫]। মারাঠা আক্রমণের ফলে বিশেষত পশ্চিম বাংলার প্রজাদের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল এবং কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের অবনতি ঘটেছিল[৫]। মারাঠাদের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের পর আলীবর্দীর শাসনব্যবস্থা ও উৎসাহের ফলে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের দ্রুত উন্নতি হয় এবং বাংলা আবার ঐশ্বর্যশালী হয়ে ওঠে[৫]।
ব্যক্তিগত জীবনে আলীবর্দী ধর্মনিষ্ঠ ও সচ্চরিত্রের অধিকারী ছিলেন[৫] এবং শত্রুর প্রতি সদয় আচরণের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন[৫]। আলীবর্দীর শাসনামলে বাংলায় ফার্সি সাহিত্য প্রসার লাভ করে। আলীবর্দী শিক্ষা-দীক্ষার প্রসারে উৎসাহী ছিলেন এবং তার শাসনামলে বাংলায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বিস্তৃতি লাভ করেছিল[৫]।
দীর্ঘদিন যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকার দরুন আলীবর্দীর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিল। ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল তিনি মুর্শিদাবাদে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন[৫]। বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদের খোশবাগে তার সমাধি অবস্থিত।
তাঁর সমসাময়িক অনেকের বিপরীতে, আলীবর্দির কেবল একজন স্ত্রী শারফুন্নেসা ছিলেন।[১৪][১৫] তাদের তিন মেয়ে ছিল,[১৬] যাদের মধ্যে তার বড় ভাই হাজি আহমদের কমপক্ষে দুই পুত্রের সাহে বিবাহ হয়েছিল।[১৭][১৮] আলীবর্দি তার জামাইদের ছাড়িয়ে যান এবং তার নিজের কোন পুত্র না থাকায় তার নাতি সিরাজ উদ-দৌলার স্থলাভিষিক্ত হন।[১৯] আলীবর্দির মেয়েরা নিম্নরূপ:
আলীবর্দির বেশ কয়েকজন সৎ ভাইবোনও ছিল, যাদের মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদ আমিন খান এবং মুহাম্মদ ইয়ার খান, যিনি যথাক্রমে হুগলীর একজন সাধারণ ও গভর্নর হিসেবে তার অধীনে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।[২০][২১][২২] তার সৎ বোন শাহ খানম মীর জাফরের স্ত্রী ছিলেন, যিনি পরে ১৭৫৭ সালে বাংলার সিংহাসন দাবি করেন।[২৩][২৪] ইতিহাসবিদ গোলাম হুসেন খানও একজন আত্মীয় ছিলেন।[২৫]
পূর্বসূরী সরফরাজ খান |
বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব ১৭৪০–১৭৫৬ |
উত্তরসূরী সিরাজদ্দৌলা |