ইবনে জুহর ابن زهر Avenzoar | |
---|---|
জন্ম | ১০৯৪ |
মৃত্যু | ১১৬২ (বয়স: ৬৮) |
পেশা | চিকিৎসক, কবি, সাহিত্যিক |
উচ্চশিক্ষায়তনিক পটভূমি | |
যার দ্বারা প্রভাবিত |
|
উচ্চশিক্ষায়তনিক কর্ম | |
যুগ | মধ্যযুগীয় ইসলামী সভ্যতা |
বিষয় | চিকিৎসাবিজ্ঞান |
প্রধান আগ্রহ | অস্ত্রোপচার |
উল্লেখযোগ্য কাজ | আল-তাইসির ফিল-মুদাওয়াত ওয়াল-তাদবীর (التيسير في المداواة و التعبير) |
উল্লেখযোগ্য ধারণা | ট্র্যাকিওটমি |
যাদের প্রভাবিত করেন | ইবনে রুশদ, মুসা বিন মৈমুন, পিয়েত্রো ডি'আবানো, গাই ডি চাউলিয়াক |
আবু মারওয়ান আব্দুল মালিক বিন জুহর (আরবি: أبو مروان عبد الملك بن زهر) ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ আরব চিকিৎসক, সার্জন এবং কবি। ঐতিহ্যগতভাবে তিনি লাতিন নাম অ্যাভেনজোয়ার (/ˌɑːvənˈzoʊər/;[১] ১০৯৪ খ্রি.–১১৬২ খ্রি.), আবুমেরন, আভুমেরন, আলোমেরন দ্বারা অধিক পরিচিত। তিনি মধ্যযুগীয় আন্দালুসিয়ার (বর্তমান স্পেন) সেভিলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ইবনে রুশদ ও ইবনে তুফাইলের সমসাময়িক এবং তিনি তাঁর যুগের সবচেয়ে সুপরিচিত চিকিৎসক ছিলেন। [২] বিশেষ করে ওষুধের ক্ষেত্রে তিনি আরো যুক্তিযুক্ত ও অত্যাধুনিক অভিজ্ঞতামূলক ভিত্তি আবিষ্কারের উপর জোর দেওয়ার জন্য পরিচিত ছিলেন।
তার প্রধান কাজ হলো, আল-তাইসির ফিল-মুদাওয়াত ওয়াল-তাদবীর (আরবি: التيسير في المداواة و التعبير: বুক অফ সিম্পলিফিকেশন কনসার্নিং থেরাপিউটিকস অ্যান্ড ডায়েট"), যা লাতিন এবং হিব্রু ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। ইবনে জুহর অস্ত্রোপচারের অগ্রগতিতে অন্তত প্রভাবশালী ছিলেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন রোগ ও তাদের চিকিৎসা আবিস্কারের মাধ্যমে অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসা বিজ্ঞানকে উন্নত করেছেন।
ইবনে জুহর একটি ছাগলের উপর প্রথম পরীক্ষামূলক ট্র্যাকিওটমি করেছিলেন এবং [৩] তিনিই বেজোয়ার পাথরকে ঔষধি দ্রব্য হিসেবে সর্বপ্রথম বর্ণনা করেন। [৪]
ইবনে জুহর ১০৯৪ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন আন্দালুসের সেভিলে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি উল্লেখযোগ্য বানু যুহর পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যারা আইয়াদের আরব উপজাতিদের সদস্য ছিলেন। [৫] ১০ শতকের গোড়ার দিকে পরিবারটি পরপর ছয় প্রজন্মের জন্যে চিকিত্সক তৈরি করেছিল; সেইসাথে আইনবিদ, কবি, উজির বা দরবারী এবং ধাত্রী, যারা আল-আন্দালুসের শাসকদের অধীনে কাজ করেছিল। [২][৬] তিনি ধর্ম ও সাহিত্য অধ্যয়নের মাধ্যমে নিজের শিক্ষা শুরু করেন, যেমনটি ছিল মধ্যযুগীয় মুসলিম সমাজের রীতি। পরে তিনি তার পিতা আবুল আলা যুহরের (মৃত্যু: ১১৩১) কাছে অল্প বয়সে চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়ন করেন। তার নিজস্ব বর্ণনা মতে, শিক্ষাদানকালে নিজের বাবা তাকে গ্যালেন এবং হিপোক্রেটিসের কাজের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এবং যৌবনে তাকে হিপোক্রেটিক শপথ নিতে বলেছিলেন। [৭]
আবু জুহর আল মুরাবিতুন রাজবংশের আদালতের চিকিত্সক হিসাবে তার চিকিৎসা জীবন শুরু করেন। যাহোক, কিছু অপ্রকাশিত কারণে তিনি পরবর্তীকালে মুরাবিত শাসক আলি বিন ইউসুফ বিন তাশুফিনের পক্ষ থেকে সরে পড়েন এবং সেভিল থেকে পালিয়ে যান। তবে ১১৪০ সালে মারাকেশে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং জেলে পাঠানো হয়েছিল। এ অভিজ্ঞতা তার মধ্যে একটি খারাপ বিরক্তির ছাপ রেখে যায়, যেমন তার লেখা থেকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। পরবর্তী কালে ১১৪৭ সালে যখন মুওয়াহহিদিন রাজবংশের শাসকরা সেভিল জয় করে, তখন তিনি ফিরে আসেন এবং চিকিৎসা অনুশীলনে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ১১৬২ সালে সেভিলেই মৃত্যুবরণ করেন।
লিও আফ্রিকানাসের মতে, ইবনে জুহর ইবনে রুশদের বক্তৃতা শুনেছিলেন এবং তার কাছ থেকে পদার্থবিদ্যা শিখেছিলেন। এছাড়া তিনি গ্যালেনের একজন মহান ভক্ত ছিলেন এবং তার লেখায় তিনি হাতুড়ে ডাক্তারি এবং জ্যোতিষীদের কুসংস্কারের প্রতিকারের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে প্রতিবাদ করেছেন। [৮]
ইবনে জুহর মুরাবিতুন ও মুওয়াহহিদদের সমসাময়িক ছিলেন। তিনি আন্দালুসিয়ায় তাদের সাথে বাস করেন; তবে নিজের ও উভয় সম্প্রদায়ের নীতির মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। তিনি নিজের পিতা আবুল আলার সাথে আল-মুরাবিতুনদের মধ্যে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন যে, তিনি একজন আল মুওয়াহহিদ রাজপুত্রের অনুরোধে তাঁর বই দ্য ইকোনমি (الإقتصاد) লিখেছিলেন এবং তারপরে মুওয়াহহিদদের মধ্যে তার মর্যাদা বেড়ে যায়।
"কিতাব আল" ইকতিসাদ (আরবি: كتاب الإقتصاد) বা "মডারেশনের বইটি" তার লিখিত অন্যতম এটি একটি গ্রন্থ। এটি মুরাবিতুন রাজবংশীয় রাজকুমার ইবরাহিম ইউসুফ ইবনে তাশফিনের জন্যে তার যৌবনে লিখিত সাধারণ থেরাপিসমৃদ্ধ একটি গ্রন্থ। বইটি বিভিন্ন রোগ, ভৈষজ ওষুধপাতির বর্ণনা এবং সাধারণ স্বাস্থ্যবিধির সারসংক্ষেপ। বইটি প্রসাধনী এবং শারীরিক সৌন্দর্য সম্পর্কিত পরামর্শের জন্যও সুবিখ্যাত। ইবনে জুহর এমনকি বড় নাক, মোটা ঠোঁট বা আঁকাবাঁকা দাঁতের মত অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলি পরিবর্তন করতে পুনর্গাঠনিক শল্যবিদ্যার সুপারিশ করেছিলেন। [৯]
কিতাব আল-আগজিয়াহ
কিতাব আল আগজিয়াহ (আরবি: كتاب الأغذية) বা খাবারের বই; এর নাম হিসাবেই ইঙ্গিত করে যে, এটি খাবার এবং এর নিয়মের উপর রচিত একটি সারগ্রন্থ, যাতে একটি স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্যে বহু নির্দেশিকা রয়েছে। ইবনে জুহর তার পৃষ্ঠপোষক আল মুয়াহহিদ নেতা আব্দুল মুমিন বিন আলী আল কৌমির উদ্দেশ্যে জেল থেকে বের হওয়ার পরপরই বইটি লিখেছিলেন। বইটিতে তিনি রুটি, মাংস, পানীয়, ফল ও মিষ্টির মতো বিভিন্ন ধরণের খাবার ও খাবারের বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগ উল্লেখ করেছেন। যখন তিনি তার বইয়ে মাংসের কথা বলেন, তখন ইবনে যুহর বিভিন্ন ধরণের প্রাণী ও পশুর মাংসের কথা উল্লেখ করেন। এমনকি অস্বাভাবিক ও অখাদ্য হিসেবে বিবেচিত অনেক প্রাণী; যেমন: গযেল, সিংহ ও সাপের মত প্রাণীর মাংসের স্বাদ, উপযোগিতা এবং হজম ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে তাদের শ্রেণীবদ্ধ করেছেম। এমনকি তিনি বছরের প্রতিটি ঋতুর জন্য নির্দিষ্ট খাবারেরও পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন শীতকালে হজম প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়, তাই খাওয়ার পরিমাণও বাড়াতে হবে। তদুপরি, খাবারটিও উষ্ণ ও শুষ্ক হওয়া উচিত; কারণ তাপমাত্রা কম এবং আর্দ্রতা বেশি।
কিতাব আল-তাইসির (আরবি: كتاب التيسير) বইটি মৃত্যুর আগে লিখিত ইবনে যুহরের শেষ বই বলে মনে করা হয়। ভূমিকায় উল্লিখিত হিসাবে মতে, বইটি তার বন্ধু ইবনে রুশদের অনুরোধে রচিত হয়েছিল, যা তার চিকিৎসাবিদ্যা-বিশ্বকোষ কল্লিগেটের একটি সংকলন হিসাবে কাজ করবে এবং বইটিতে ওষুধের সাধারণ বিষয়গুলিতে আরো বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল। বই দুটি পরে হিব্রু এবং লাতিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল, যেখানে সেগুলি একক বই হিসাবেই মুদ্রিত হত এবং ১৮ শতকের শেষের দিকে খুব জনপ্রিয় ছিল।
বইটি মোট ৩০টি অধ্যায় ধারণ করে, যাতে মাথা থেকে শুরু করে রোগের চিকিৎসা-সমন্ধনীয় বর্ণনা ও নির্ণয় প্রদান করা হয়েছে। ইবনে জুহর খাদ্যনালী, পাকস্থলী এবং মিডিয়াস্টিনাল ক্যান্সারের পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষতসমূহের একটি সঠিক বর্ণনা প্রদান করেছেন। [১০][১১] তিনি পেটের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য এনিমা খাওয়ানোর প্রস্তাব করেছিলেন। তিনিই প্রথম ওটিটিস মিডিয়া ও পেরিকার্ডাইটিসের মতো প্রদাহের রোগগত বর্ণনা উপস্থাপন করেন।
ইবনে জুহরকে স্ক্যাবিস মাইটের প্রাচীনতম নথিভুক্ত প্রমাণগুলির মধ্যে একটি প্রদান করার জন্যও কৃতিত্ব দেওয়া হয়, যা সাধারণ অণুজীববিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে অবদান রাখে। [১২] তার কিতাব আল-তাইসিরে তিনি নিম্নলিখিত বক্তব্যটি লিখেছেন:
হাত, গোড়ালি এবং পায়ের নিচে কৃমির মতো উকুন এবং একই জায়গায় ঘা রয়েছে। চামড়া অপসারণ করা হলে এর বিভিন্ন অংশ থেকে একটি খুব ছোট প্রাণী দেখা যায়, যা খুব কম দেখা যায়। [১৩]
সম্ভবত ওষুধে ইবনে জুহরের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল পশু পরীক্ষা প্রবর্তনের মাধ্যমে তার পরীক্ষামূলক পদ্ধতির প্রয়োগ করা এবং তা কাজ করবে কিনা, তা জানার জন্য মানুষের উপর প্রয়োগ করার আগে তিনি প্রাণীদের উপর চিকিৎসা পদ্ধতি সঞ্চালন করেছিলেন বলে জানা যায়। [১৪] তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল ট্র্যাকিওটমির অস্ত্রোপচারের পদ্ধতির অনুমোদন এবং সুপারিশ, যা সেই সময়ে একটি বিতর্কিত পদ্ধতি ছিল। বিতর্কটি সমাধান করার চেষ্টা করার জন্য ইবনে যুহর নিম্নলিখিত চিকিৎসা পরীক্ষাটি বর্ণনা করেন, যা তিনি একটি ছাগলের উপর প্রয়োগ করেছিলেন:
"আমার প্রশিক্ষণের শুরুতে যখন আমি এই মতামতগুলি (বিতর্ক) পড়ি, তখন আমি একটি ছাগলের ফুসফুসের নলের চামড়া কেটে ফেলেছিলাম এবং নীচের আবরণটিও কেটে ফেলেছিলাম। তারপরে আমি পাইপের উপাদানটি সম্পূর্ণভাবে কেটে ফেলেছিলাম, যা এর চেয়ে কম এলাকা একটি তিরমিশার (লুপিন বীজ) আকারের মত। তারপর আমি ক্ষতটি পানি ও মধু দিয়ে ধুতে থাকি, যতক্ষণ না এটি সেরে যায় এবং এটি (প্রাণী) পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে এবং দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে।" [১৫]
ইবনে আবি উসাইবিয়া ইবনে যুহরের এই অন্যান্য কাজের কথা উল্লেখ করেছেন:[১৬]
তার "আল–তাইসির" বইটি বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার পাশাপাশি তার ও ইবনে রুশদের মধ্যে বিদ্যমান ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বকে নিশ্চিত করে। অন্যদিকে, তার খ্যাতি অনেক বেড়ে যায় এবং এটি ডাক্তার সমাজ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় এবং বিভিন্ন বিদেশী ভাষায় অনুবাদ করা হয়। ইবনে সিনার বই আল কানুনে বলা হয়, তিনি দীর্ঘ দিন যাবত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। তিনি ইউরোপীয় চিকিৎসা ব্যবস্থায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গভীর প্রভাব রেখে গিয়েছেন।
ইবনে জুহরের আল ইকতিসাদ ("দ্য ইকোনমি)" বইটির পাণ্ডুলিপি এখনও রয়েছে এবং এর একটি অনুলিপি প্যারিসের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।
ইহুদি চিকিৎসক ও দার্শনিক মাইমোনাইডিস ইবনে জুহরের ব্যাপক প্রশংসা করেছিলেন। [১৭] তাকে "তার বয়সে অনন্য ও 'মহান ঋষিদের একজন' বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি প্রায় তার চিকিৎসা গ্রন্থে তাকে উদ্ধৃত করেছেন। [২] ইবনে রুশদ ইবনে জুহরকে গ্যালেনের পর সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিত্সক হিসাবে প্রশংসা করেছিলেন। তার মেয়ে ও নাতনি উভয়েই প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হয়ে ওঠেছিলেন। [১৫]