বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বিতাটি প্রাথমিকভাবে ধর্মীয় পার্থক্য দ্বারা তীব্র একটি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংগ্রাম, এবং এই অঞ্চলের সাম্প্রদায়িকতা (সেকটেরিয়ানিজম) একটি বৃহত্তর সংঘাতের অংশ হিসেবে ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যে উভয় দেশ দ্বারা ব্যবহৃত হয়।[২২][২৭][২৮] ইরান মূলত শিয়া মুসলিম, অন্যদিকে সৌদি আরব নিজেকে নেতৃস্থানীয় সুন্নি মুসলিম শক্তি হিসেবে দেখে।[২৯]
সংঘাতের বর্তমান পর্যায় শুরু হয় ২০১১ সালে যখন একটি বিপ্লবী তরঙ্গ হিসেবে আরব বসন্ত (ইসলামিক জাগরণ) মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তিউনিশিয়া, মিশর এবং ইয়েমেনে বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং লিবিয়া এবং সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ২০১১ সালে আরব বসন্ত তিনটি প্রধান আঞ্চলিক কর্তৃত্ব ইরাক, সিরিয়া এবং মিশরকে অস্থিতিশীল করে, যা সেই অঞ্চলগুলোতে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি করে।[৩০]আরব বিশ্ব জুড়ে এই গণজাগরণ রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করে। এর জবাবে সৌদি আরব ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্লক উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থা বা গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পর্ক গভীর করার জন্য একটি উপসাগরীয় ইউনিয়ন গঠনের আহ্বান জানায়। এই প্রস্তাবে উপসাগরীয় রাজতন্ত্রে সংখ্যালঘুদের সম্ভাব্য গণজাগরণ প্রতিরোধ এবং ইরানের সাথে তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রতিফলন ঘটেছে।[৩১] এই ইউনিয়ন এই অঞ্চলে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিষয়ের উপর বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণ প্রদানের মাধ্যমে সৌদি প্রভাবকে কেন্দ্রীভূত করার সম্ভাবনা তৈরি করে যা সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে প্রভাবিত করে। বাহরাইন ছাড়া, অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রসমূহ এই প্রস্তাবিত ফেডারেশন প্রত্যাখ্যান করে, কারণ ওমান, কাতার, কুয়েত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সতর্ক ছিল যে এটি সৌদি আধিপত্যের দিকে নিয়ে যাবে।[৩২]
ইজরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতের গুরুত্ব হ্রাস পাওয়ায় এবং জিসিসি রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইরানের উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে জিসিসি রাষ্ট্রগুলো ইজরায়েলের সাথে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করার চেষ্টা করে, যার ফলে তারা ইরানের সাথে ইসরায়েলের বদলি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।[৩৩] মিত্র এবং নিরাপত্তা নিশ্চয়তাদাতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি নিয়েও সৌদি আরব ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এশিয়ার প্রতি আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতি, সৌদি তেলের উপর নির্ভরতা কমানো এবং ইরানের সাথে পুনরায় সম্পর্ক তৈরির সম্ভাবনা সৌদি পররাষ্ট্র নীতিতে আরো জোরালো অবদান রেখেছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে সৌদি আরব সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আন্তঃসরকার ইসলামিক মিলিটারি অ্যালায়েন্স টু ফাইট টেরোরিজম (আইএমএএফটি) গঠন করে। এই জোট বর্তমানে ৪১ সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত, যার সবগুলো সুন্নি অধ্যুষিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়। শিয়া নেতৃত্বাধীন ইরান, ইরাক এবং সিরিয়াকে এখানে উল্লেখযোগ্যভাবে বাদ দেয়া হয়েছে, যা উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে যে এই উদ্যোগ ইরানকে নিঃসঙ্গ করার সৌদি প্রচেষ্টার অংশ।[৩৪][৩৫]
আরব শীতের সূচনা ইরান এবং তার নিজস্ব অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নিয়ে সৌদি উদ্বেগ কে আরও বাড়িয়ে তোলে। এর ফলে রিয়াদ এই অবস্থা বজায় রাখার জন্য বৃহত্তর পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যা বিশেষ করে বাহরাইন এবং অন্যান্য সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রের মধ্যে প্রযুক্ত হয়, এই নতুন পররাষ্ট্রনীতিকে "ব্রেজনেভ মতবাদ একবিংশ শতাব্দীর সংস্করণ" হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।[৩৬][৩৭] ইরান আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নেওয়ার আশায় বিপরীত পন্থা অবলম্বন করে শিয়া অর্ধচন্দ্রে তার উপস্থিতি প্রসারিত করে এবং ইরাক থেকে লেবানন পর্যন্ত বিস্তৃত প্রভাবের একটি স্থল করিডোর তৈরি করে, যা আংশিকভাবে আইএসআইএল-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে শিয়া মিলিশিয়াদের সমর্থন করে।[৩৮][৩৯]
জিসিসির অন্তর্ভুক্ত এবং বাইরের সুন্নি আরব সরকারসমূহের সকলেই ইরান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও দীর্ঘদিন ধরে তারা রাজনৈতিক ইসলাম নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে আসছে। সৌদি আরবের ওয়াহাবি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং এর ঊর্ধ্ব-অধো আমলাতন্ত্র কাতারের মত সৌদি আরবের কিছু মিত্র রাষ্ট্রের ব্যবস্থা থেকে আলাদা, এই রাষ্ট্রগুলো তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেজেপ তাইয়িপ এরদোয়ানের প্রচার করা ইসলামপন্থী প্লাটফর্মের মত জনপ্রিয় সুন্নি ইসলামপন্থী প্লাটফর্মের প্রচার করে। এছাড়া মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো বিতর্কিত বহুজাতিক সংগঠনকে সমর্থনের জন্য কাতার প্রতিবেশী সুন্নি দেশগুলোর সমালোচনা লাভ করেছে (বর্তমানে কাতার ও তুরস্ক হচ্ছে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রধান সমর্থক)। ২০১৫ সালের মধ্যে মুসলিম ব্রাদারহুড বাহরাইন, মিশর, রাশিয়া, সিরিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকারের সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।[৪০] অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত লিবিয়া, মিশর, ইয়েমেন এবং অন্যান্য দেশে ইসলামপন্থা-বিরোধী শক্তিকে সমর্থন দান করে এবং প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসির অধীনে মিশরের মত অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বেশি মনোযোগ প্রদান করে। সুন্নি বিশ্বের এই পার্থক্যসমূহের ফলে সুন্নি রাষ্ট্রসমূহ ইরান এবং সন্ত্রাসবাদ উভয়েরই বিরোধী হবার পরও এদের বিরুদ্ধে এর ঐক্যবদ্ধ হতে পারার সম্ভাবনা অনেক কম হয়ে যায়।[৪১] ২০১৫ সালে বাদশাহ সালমান ক্ষমতায় আসার পর থেকে সৌদি আরব তার ঐতিহ্যবাহী ওয়াহাবী মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে আসে এবং আরো আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করে।[৪২]
জটিল প্রকৃতি, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা উদ্বেগ, মতাদর্শগত বিভাজন এবং সংযুক্ত জোটের জটিল প্রকৃতির কারণে এই সংঘাতকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব ইউরোপের সাথে তুলনা করা হয়।[৪৩] এই দ্বন্দ্ব ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে মিশর ও সৌদি আরবের মধ্যে আরব স্নায়ুযুদ্ধের সাদৃশ্য তুলে ধরেছে। এখানে রাষ্ট্রসমূহের প্রভাবকে প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রতিবেশী দেশের বিষয়কে প্রভাবিত করার ক্ষমতা দ্বারা বিচার করা হয়, অ-রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এবং উভয় শিবিরে বিভেদ থেকে বিরোধী পক্ষের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে কৌশলগত জোটের উদ্ভব ঘটে।[১][৪৪]
বার্ষিক হজ্জযাত্রার সময় মক্কায়২০১৫ সালের পদদলনের ঘটনাটি আরও উত্তেজনা ছড়ায়। তেহরান এই বেদনাদায়ক ঘটনার জন্য সৌদি সরকারকে দায়ী করে এবং তাদের অযোগ্যতার জন্য অভিযুক্ত করে, যা রিয়াদ প্রত্যাখ্যান করে।[৪৫][৪৬][৪৭] ২০১৬ সালের মে মাসে ইরান আসন্ন হজ্বে অংশগ্রহণ স্থগিত করে।[৪৮] সেপ্টেম্বর মাসে সৌদি আরব ১০ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হজ্ব কার্যক্রম সম্প্রচারের জন্য ২৪ ঘণ্টার ফার্সি ভাষার স্যাটেলাইট চ্যানেল চালু করে। আয়াতুল্লাহ খামেনি রিয়াদের বিরুদ্ধে হজ্বের এই বিয়োগান্তক ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগ আনেন এবং যুক্তি দেখান যে সৌদি আরবের এই হজ্বযাত্রা পরিচালনা করা উচিত নয়।[৪৯][৫০]
↑Rogin, Josh (৪ নভেম্বর ২০১৫)। "Iran and Saudi Arabia Clash Inside Syria Talks"। Bloomberg View। ৪ মে ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ মার্চ ২০১৮। ...Iran and Saudi Arabia to discuss anything civilly, much less come to an agreement on Syria, where both sides have proxy forces in the fight.