ঈশোপনিষদ্ ঈশাবাস্যোপনিষদ্ শুক্লযজুর্বেদীয় বাজসনেয়-সংহিতোপনিষদ্ | |
---|---|
দেবনাগরী | ईश |
IAST | īśā |
নামের অর্থ | প্রভু |
রচনাকাল | খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ |
উপনিষদের ধরন | মুখ্য উপনিষদ্ |
সম্পর্কিত বেদ | শুক্ল যজুর্বেদ |
শ্লোকসংখ্যা | ১৮ |
টীকাকার | আদি শঙ্কর, মধ্ব[১] |
ঈশোপনিষদ্ (সংস্কৃত: ईशोपनिषद्) বা শুক্লযজুর্বেদীয় বাজসনেয়-সংহিতোপনিষদ্[২] হল ক্ষুদ্রতম উপনিষদ্গুলির অন্যতম। এটি শুক্ল যজুর্বেদ গ্রন্থের সর্বশেষ অধ্যায়। ঈশোপনিষদ্ হল একটি মুখ্য উপনিষদ্ (প্রধান উপনিষদ্)। বেদের কাণ্ব ও মাধ্যন্দিন শাখায় এই উপনিষদ্ রয়েছে। ঈশোপনিষদ্ হল একটি ক্ষুদ্র কবিতা। শাখা অনুসারে এই উপনিষদের মন্ত্র সংখ্যা ১৮। যা যজুর্বেদের ৪০ নং অধ্যায়ের সকল মন্ত্র।
হিন্দু দর্শনের বেদান্ত শাখার একটি প্রধান ধর্মগ্রন্থ হল ঈশোপনিষদ্। এই গ্রন্থটি হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাছে একটি প্রভাবশালী শ্রুতিশাস্ত্র হিসেবে গৃহীত হয়েছে। গ্রন্থের প্রথম শ্লোকের প্রথম দুটি শব্দ (ঈশা বাস্যম্) থেকে এই উপনিষদ্টির নামটির উৎপত্তি। ঈশা বাস্যম্ শব্দদুটির অর্থ “ঈশ্বরের দ্বারা আবৃত”[৩] বা “ঈশ্বরে (আত্মায়) নিহিত”।[৪] এই গ্রন্থে হিন্দুধর্মের আত্মার তত্ত্বটি আলোচিত হয়েছে। বেদান্তের অদ্বৈত ও দ্বৈত – উভয় শাখাতেই এই উপনিষদের নিজস্ব ব্যাখ্যা প্রচলিত রয়েছে।[৫][৬]
পল ডুসেন (১৯০৮)কেনোপনিষদ্, কঠোপনিষদ্, শ্বেতাশ্বেতরোপনিষদ্ ও মুণ্ডকোপনিষদ্ গ্রন্থের সঙ্গে ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থটিকেও একটি ‘কাব্যিক উপনিষদ্’ হিসেবে চিহ্নিত করেন।[৭]
‘ঈশ্বর’ শব্দের মূল ‘ঈশ্’ (ईश) ধাতুর অর্থ ‘সমর্থ’ ও ‘অধিপতি’।[৮] ‘ঈশ্’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘প্রভু’।[৯] ‘বাস্যম্’ (वास्य) শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘নিহিত বা আবৃত’।[১০] গ্রিফিথ ও ম্যাক্স মুলার উভয়েই এই উপনিষদে ‘ঈশ’ শব্দটির অর্থ করেছেন ‘প্রভু’ ও ‘আত্মা’।[৩][৪] পুকুন লি ঈশোপনিষদ্ নামটির অনুবাদ করেছেন ‘আত্মার অধিপতি’ (‘the ruler of the Self’)।[১১]
ঈশোপনিষদ্ ঈশাবাস্যোপনিষদ্ বা বাজসনেয়-সংহিতোপনিষদ্ নামেও পরিচিত।[৪]
বৈদিক যুগের অন্যান্য সাহিত্যের মতো ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থের সঠিক সময়কালও অজ্ঞাত। এই নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে।[১২] প্রত্যেকটি মতই অপর্যাপ্ত প্রমাণ, ধারণার বিবর্তন-সংক্রান্ত অনুমান এবং কোন দর্শন কোন দর্শনের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল, সেই সংক্রান্ত অনুমানের উপর নির্ভরশীল।[১২][১৩]
রিচার্ড কিং সহ প্রমুখ বৌদ্ধধর্ম বিশারদগণ ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থের সময়কাল নির্ধারণ করেছেন আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১ম সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধ। তাদের মতে, এই গ্রন্থ প্রথম বৌদ্ধ পালি ত্রিপিটক গ্রন্থের পরে রচিত হয়।[১৪]
স্টিফেন ফিলিপস প্রমুখ হিন্দুধর্ম বিশারদগণ [১২] আধুনিক গবেষকদের মতভেদের কথা উল্লেখ করেছেন। তার মতে, ঈশোপনিষদ্ সম্ভবত প্রাচীনতম উপনিষদগুলোর অন্যতম এবং খ্রিস্টপূর্ব ১ম সহস্রাব্দের প্রথম ভাগে রচিত হয়। তার মতে, এই গ্রন্থটি বৃহদারণ্যকোপনিষদ্ ও ছান্দোগ্যোপনিষদ্ গ্রন্থদ্বয়ের পরে এবং তৈত্তিরীয়োপনিষদ্, ঐতরেয়োপনিষদ্, কৌষিতকী উপবিষদ, কেনোপনিষদ্, কঠোপনিষদ্, মুণ্ডকোপনিষদ্, প্রশ্নোপনিষদ্, শ্বেতাশ্বেতরোপনিষদ্ ও মৈত্রায়নীয়োপনিষদ্ গ্রন্থের আগে তথা প্রাচীনতম বৌদ্ধ পালি ও জৈন ধর্মগ্রন্থগুলোরও আগে রচিত হয়।[১২]
পরবর্তীতে ১৯শ ও ২০শ শতাব্দীর গবেষকরা একইভাবে নিজেদের মধ্যে ভিন্নমত পোষণ করতেন। তারা এই উপনিষদ্টিকে প্রাচীনতম অথবা মধ্যকালীন উপনিষদ্ বলে উল্লেখ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, পল ডুসেন[১৫] বলেছেন যে, ঈশোপনিষদ্ প্রাচীন গদ্য উপনিষদ্গুলির (বৃহদারণ্যকোপনিষদ্, ছান্দোগ্যোপনিষদ্, তৈত্তিরীয়োপনিষদ্, ঐতরেয়োপনিষদ্, কৌষিতকী উপনিষদ্ ও কেনোপনিষদ্) পরে রচিত হয়। এই উপনিষদ্ রচনার যুগেই ছন্দোময় কাব্যিক উপনিষদ্গুলো রচিত হয়েছিল। তিনি আরও বলেছেন, ঈশোপনিষদ্ রচনার পরেই অন্যান্য গদ্য উপনিষদ্গুলি (প্রশ্নোপনিষদ্, মৈত্রায়নীয়োপনিষদ্, মাণ্ডুক্য উপনিষদ্ ও সকল উত্তর-বৈদিক যুগীয় উপনিষদ্গুলি) রচিত হয়।
উইন্টারনিটজ্[১৬] বলেছেন যে, ঈশোপনিষদ্ সম্ভবত প্রাক-বৌদ্ধযুগের রচনা। এই যুগেই কঠোপনিষদ্, শ্বেতাশ্বেতরোপনিষদ্, মুণ্ডকোপনিষদ্ ও প্রশ্নোপনিষদ্ রচিত হয়। তবে বৃহদারণ্যকোপনিষদ্, ছান্দোগ্যোপনিষদ্, তৈত্তিরীয়োপনিষদ্, ঐতরেয়োপনিষদ্, কৌষিতকী উপনিষদ্ ও কেনোপনিষদ্ – এই গদ্য উপনিষদগুলোর পরেই ঈশোপনিষদ্ রচিত হয়। তার মতে, ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থটি মৈত্রায়নীয়োপনিষদ্ ও মাণ্ডুক্যোপনিষদ্ প্রভৃতি বুদ্ধ-পরবর্তী যুগের উপনিষদ্গুলির আগে রচিত হয়েছিল।
রাণাডে [১৭] বলেছেন যে, ঈশোপনিষদ্ ও কেনোপনিষদ্ কালপঞ্জি অনুসারে দ্বিতীয় গোষ্ঠীর উপনিষদ্। এ দুটি প্রথম গোষ্ঠীর উপনিষদ্ বৃহদারণ্যকোপনিষদ্ ও ছান্দোগ্যোপনিষদ্ গ্রন্থ দুটির পরে এবং তৈত্তিরীয়োপনিষদ্, ঐতরেয়োপনিষদ্, কৌষিতকী উপনিষদ্, কঠোপনিষদ্, মুণ্ডকোপনিষদ্, শ্বেতাশ্বেতরোপনিষদ্, প্রশ্নোপনিষদ্, মাণ্ডুক্যোপনিষদ্ ও মৈত্রায়নীয়োপনিষদ্ গ্রন্থগুলের আগে রচিত হয়।
ঈশোপনিষদ্ একমাত্র উপনিষদ্ যেটি বেদের প্রাচীনতম অংশ তথা মন্ত্র-সংকলন সংহিতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। অন্যান্য উপনিষদগুলো বেদের পরবর্তীকালীন অংশ ব্রাহ্মণ বা আরণ্যক অংশের সঙ্গে যুক্ত। তবে ম্যাক্স মুলার বলেছেন, এর অর্থ এই নয় যে ঈশোপনিষদ্ প্রাচীনতম উপনিষদ্গুলির অন্যতম।[১৮] কারণ, শুক্ল যজুর্বেদ, ঋগ্বেদ প্রভৃতি প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যের পরবর্তীকালের রচনা বলে জানা যায়।
৮ম শতাব্দীর ভারতীয় পণ্ডিত আদি শঙ্কর তার ‘ভাষ্যে’ (পর্যালোচনা ও টীকা) বলেছেন যে, ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থের মন্ত্র ও স্তোত্রগুলি অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য নয়। কারণ, এগুলোর উদ্দেশ্য পাঠককে ‘আত্মার প্রকৃতি কী’ সেই সম্পর্কে অবহিত করা। যজুর্বেদ সংহিতার উদ্দেশ্য যজ্ঞ তথা অনুষ্ঠান-সংক্রান্ত হলেও, এই কারণেই ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থটিকে একটি অনুষ্ঠান-সংক্রান্ত ধর্মগ্রন্থ বলা চলে না।[১৮][১৯] ঈশোপনিষদ্ হল একটি দার্শনিক গ্রন্থ।[২০]
ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপিতে শুক্ল যজুর্বেদ গ্রন্থের দুটি শাখা অনুসারে পাঠান্তর দেখা যায়। এই শাখা দুটি হল কাণ্ব ও মাধ্যান্দিন শাখা। ১ম থেকে ৮ম শ্লোক পর্যন্ত উভয় শাখাতে কোনো পাঠান্তর নেই। কিন্তু কাণ্ব শাখার ৯ম থেকে ১৪শ মন্ত্রগুলো মাধ্যান্দিন শাখায় ১২শ, ১৩শ, ১৪শ, ৯ম, ১০ম ও ১১শ ক্রমে সজ্জিত। মাধ্যান্দিন শাখার ১৭শ শ্লোকটি কাণ্ব শাখার ১৫শ শ্লোক। কাণ্ব শাখার ১৬শ শ্লোকটি মাধ্যান্দিন শাখায় নেই। আবার কাণ্ব শাখার ১৭শ ও ১৮শ শ্লোকদুটো মাধ্যান্দিন শাখায় ১৫শ ও ১৬শ শ্লোক রূপে প্রদত্ত।
উভয় শাখাতেই ঈশোপনিষদ্ শুক্ল যজুর্বেদ গ্রন্থের ৪০তম অধ্যায়। কাণ্ব শাখায় ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থের শ্লোকসংখ্যা ১৮ এবং মাধ্যান্দিন শাখায় শ্লোকসংখ্যা ১৭।
কান্ব ৪০ | ১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ |
মাধ্যান্দিন ৪০ | ১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | (১৭) | – | ১৫ | ১৬ |
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ |
---|
আনুষঙ্গিক ধর্মগ্রন্থ |
ঈশোপনিষদ্ তার ১ম মন্ত্রটিতে ‘ঈশ’ শব্দটির একক উল্লেখের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই শব্দটি অন্যান্য মন্ত্রে পুনরায় উল্লিখিত হয়নি। একটি ব্যাখ্যা অনুসারে, ‘ঈশ’ শব্দটি অদ্বৈতবাদের দ্যোতক। অন্য একটি ব্যাখ্যা অনুসারে, এটি একেশ্বরবাদের একটি রূপের দ্যোতক। সেই হিসেবে ঈশ অর্থ প্রথম মতানুসারে ‘আত্মা’ এবং দ্বিতীয় মতানুসারে ‘পরম দেবতা’।
ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্।।ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু অনিত্য বস্তু আছে, এ সমস্তই পরমেশ্বরের দ্বারা আবরণীয়। উত্তমরূপ ত্যাগের দ্বারা (আত্মাকে) পালন কর। কাহারো ধনে লোভ করিও না। অথবা—(ধনের) আকাঙ্ক্ষা করিও না, (কারণ) ধন আবার কাহার?
র্যালফ গ্রিফিথ ‘ঈশ’ শব্দটি মূল দার্শনিক ভাবধারার প্রেক্ষাপট অনুসারে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি এটির অনুবাদ করেছেন ‘প্রভু’ (the Lord)। ‘প্রভু’ শব্দটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, এই শব্দের অর্থ ‘সর্বাত্মা এবং তোমার অন্তর্নিহিত আত্মা – একমাত্র পরম সত্য’ (the Soul of All, and thy inmost Self – the only absolute soul)।[২৩] ‘সর্বম্’ কথাটির মাধ্যমে অভিজ্ঞতাপ্রসূত সত্য। ‘ত্যক্তেন’ শব্দটির মাধ্যমে সন্ন্যাসের ভারতীয় ধারণাটিকে বোঝায়। ‘ভুঞ্জীথা’ বলতে বোঝায় ‘আত্মোপলব্ধির আনন্দ’।[২৩][২৪]
অদ্বৈত বেদান্ত প্রবক্তা আদি শঙ্কর’ ১ম স্তোত্রের ‘ঈশ’ শব্দটির অর্থ করেছেন ‘আত্মা’।[১৯] অন্যদিকে দ্বৈত বেদান্ত প্রবক্তা মধ্ব এই শব্দটির অর্থ করেছেন বিষ্ণু।[২৫] এই বিষয়ে অন্যান্য মতও আছে। যেমন, অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের পণ্ডিত মহীধর বলেছেন, ১ম স্তোত্রটি বুদ্ধের কথা বলেছে। তবে ম্যাক্স মুলারের মতে, এই মত গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। হিন্দুধর্মে ‘আত্মার’ অস্তিত্ব স্বীকৃত। অন্যদিকে বৌদ্ধধর্মে তা স্বীকার করা হয় না।[২৪][২৬]
ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থের ২য় থেকে ৬ষ্ঠ স্তোত্রে হিন্দুধর্মের দুটি পরস্পর-বিরোধী সংকটের অবতারণা করা হয়েছে। এই সংকট গৃহস্থের ব্যবহারিক জীবন ও কর্ম এবং ত্যাগ ও [[জ্ঞান (হিন্দুধর্ম)|[৩]
কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতং সমাঃ।
এবং ত্বয়ি নান্যথেতোঽস্তি ন কর্ম লিপ্যতে নরে।।
অসুর্যা নাম তে লোকা অন্ধেন তমসাবৃতাঃ।
তাংস্তে প্রেত্যাভিগচ্ছন্তি যে কে চাত্মহনো জনাঃ।।
অনেজদেকং মনসো জবীয়ো নৈনদ্দেবা আপ্নুবন্ পূর্বমর্ষৎ।
তদ্ধাবতোঽন্যানত্যেতি তিষ্ঠৎ তস্মিন্নপো মাতরিশ্বা দধাতি।।
তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দূরে তদ্বন্তিকে।
তদন্তরস্য সর্বস্ব তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ।।
যস্তু সর্বাণি ভূতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি।
সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজগুপ্সতে।।যে ব্যক্তি এই জগতে শত বৎসর বাঁচিয়া থাকিতে উৎসুক, তিনি (শাস্ত্র-বিহিত) কর্ম করিয়াই বাঁচিতে ইচ্ছা করিবেন। এই প্রকার (আয়ুষ্কামীও) নরাভিমানী তোমার পক্ষে এতদ্ব্যতীত অন্য কোনও উপায় নাই যাহাতে তোমাতে (অশুভ) কর্ম লিপ্ত না হইতে পারে। অসুরদিগের আবাসভূত সেই সকল লোক দৃষ্টিপ্রতিরোধক অজ্ঞানান্ধকারে আচ্ছাদিত। যে সকল মানব আত্মঘাতী তাহারা সকলেই দেহত্যাগ করিয়া সেই-সকল লোকে গমন করে। (সেই আত্মতত্ত্ব) অচল, এক ও মন হইতেও অধিকতর বেগবান্। পূর্বগামী ইহাকে ইন্দ্রিয়েরা প্রাপ্ত হয় না। ইনি স্থির থাকিয়াও দ্রুতগামী অপর সকলকে অতিক্রম করিয়া যান। ইনি আছেন বলিয়াই বায়ু (অর্থাৎ সূত্রাত্মা) সর্বপ্রকার কর্ম আপনাতে ধারণ করেন। অথবা—সূত্রাত্মা সর্বপ্রকার কর্ম যথাযথ বিভাগ করিয়া দেন। ইনি চলেন, ইনি চলেন না; ইনি দূরে, আবার ইনি নিকটে; ইনি এই সমস্ত জগতের ভিতরে; আবার এই সমস্ত জগতের বাহিরে। কিন্তু যিনি সমুদয় বস্তুই আত্মাতে এবং সমুদয় বস্তুতেই আত্মাকে দেখেন, তিনি সেই দর্শনের বলেই কাহাকেও ঘৃণা করেন না।
আদি শঙ্কর বলেছেন, ৬ষ্ঠ স্তোত্রের ‘ইনি’ (উপরের উদ্ধৃতির শেষ বাক্য দ্রষ্টব্য) বলতে বোঝানো হয়েছে “আত্মা ও নিজ আত্মা ও সকলের আত্মার একত্ব অনুসন্ধানের পথযাত্রী মুমুক্ষু। সন্ন্যাসও এর অন্তর্গত।”[১৯] অন্যদিকে মধ্ব মনে করেন, ‘ইনি’ হলেন “ঈশ্বরের প্রেমে নিমগ্ন জীবাত্মা। এই আত্মা পরমাত্মার নীরসান্নিধ্য কামনা করে।”[২৫]
ম্যাক্স মুলার একাধিক প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতীয় পণ্ডিতদের টীকাগুলি পর্যালোচনা করে[২৪] বলেছেন যে, ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থের এই স্তোত্রগুলি “যজ্ঞ ও ধর্মের ধারণার সঙ্গে যুক্ত সকল অনুষ্ঠানের অসারতা”র কথা বলছে। তবে একই সঙ্গে এই স্তোত্রগুলি জানাচ্ছে “সামাজিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিকারক নয়; বরং তার প্রয়োজন আছে। একে জ্ঞানের পথে আপেক্ষিকভাবে মধ্যবর্তী প্রস্তুতি হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে।” ম্যাক্স মুলারের মতে, ঈশোপনিষদ্ নিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা ও অনুষ্ঠানগুলিকে ঠিকও বলছে না, আবার ভুলও বলছে না।[২৪] মোক্ষলাভের জন্য এগুলি অনেকের কাছে প্রয়োজনীয়। অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা কামনাবাসনাকে অর্থহীন বলে অনুভব করতে পারেন। এর ফলে জিজ্ঞাসু মন শান্ত হয় এবং কোনটি সর্বোচ্চ জ্ঞান, তা তারা বুঝতে পারেন।[২৪]
র্যলাফ গ্রিফিথ বলেছেন ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থের উক্ত স্তোত্রগুলি কর্মবাদের সমালোচনা করেছে। তিনি মনে করেন, কর্মীরা “ভবিষ্যৎ জীবনে সুবিধা অর্জন বা স্বর্গলাভে”র আশায় কর্ম অনুষ্ঠান করেন। এটি অজ্ঞতা। তাঁর মতে, ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থে বলা হয়েছে “আত্মজ্ঞান ও তার চিরন্তন, সর্বব্যাপী প্রকৃতি”কে এড়িয়ে চলা “নিজ আত্মাকে হত্যা”র সামিল।[৩] আত্মানুসন্ধান হল চিরন্তন, সম্পূর্ণ, সর্বাধীশ্বর ও আত্ম-নির্ভর, পরম একত্ব, সকল প্রকৃতি ও অস্তিত্বের বিধানের অনুসন্ধান। [২৯]
ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, দুঃখ ও কষ্টের অন্যতম মূল হল নিজ আত্মাকে অন্যের আত্মার থেকে পৃথক জ্ঞান করে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া। এই পৃথক জ্ঞান আসে অস্তিত্বের প্রকৃতিকে সংঘর্ষশীল দ্বৈতজ্ঞান করার থেকে। এই জ্ঞানে একজনের আনন্দ ও বেদনা অন্যের আনন্দ ও বেদনার থেকে পৃথক মনে হয়। এই উপনিষদের মতে, যদি একজন ব্যক্তি সকল বস্তুতে আত্মাকে অনুভব করতে পারেন, তাহলে এই কষ্ট আর থাকে না। এই অদ্বৈত জ্ঞান থেকে তিনি বুঝতে পারেন সকল অস্তিত্বের মধ্যে একটি একত্ব রয়েছে। তখন তিনি ব্যক্তিগত অহংবোধের ঊর্ধ্বে উঠে যান এবং বিশ্বজনীন মূল্যবোধ, আত্মা ও প্রকৃত জ্ঞানের অনুসন্ধানে লিপ্ত হন।[২০]
যস্মিন্ সর্বাণি ভূতান্যাত্মৈবাভূদ্বিজানতঃ।
তত্র কো মোহঃ কঃ শোক একত্বমনুপশ্যতঃ।।সমুদয় বস্তু যে কালে জ্ঞানীর আত্মাই হইয়া গেল, তখন সেই একত্বদর্শীর মোহই বা কি, আর শোকই বা কি? অথবা—জ্ঞানীর যে আত্মা সমুদয় বস্তু আত্মরূপে এক হইয়া গেল, সেই একত্বদর্শীর আত্মায় মোহই বা কি, আর শোকই বা কি?
ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থের ৮ম থেকে ১১শ স্তোত্রের বিদ্যা (প্রকৃত জ্ঞান, চিরন্তন সত্য) অনুসন্ধানের প্রশংসা করা হয়েছে।[২৪][৩১] এই গ্রন্থ অনুসারে, যিনি ‘বিদ্যা’ ও ‘অবিদ্যা’কে জানতে পারেন, ‘অবিদ্যা’ তাকে মৃত্যু অতিক্রম করতে সাহায্য করে (তিনি জীবিত থাকেন) এবং বিদ্যা তাকে অমরত্ব দান করে। সত্য জ্ঞান তাকে সকল দুঃখ ও ভয় থেকে মুক্তিই দান করেন এবং তিনি জীবনে আনন্দ পান।[১৯][২৪] এস. মুখোপাধ্যায়ের মতে, ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থের ১১শ শ্লোকে বলা হয়েছে যে, একজন ব্যক্তিকে পার্থিব জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞা দুইই অর্জন করতে হবে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক ব্যবহার, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত লক্ষ্য এবং জীবনের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের সামঞ্জস্য থেকেই পরিপূর্ণ জীবন লাভ সম্ভব।[৩২]
ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থের ১২শ থেকে ১৪শ স্তোত্রে কোনোকিছুর শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ কারণ বা শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক কারণ অনুসন্ধান সম্পর্কে সতর্ক করে বলা হয়েছে, এই ধরনের একদেশদর্শী অনুসন্ধান অজ্ঞানতার অন্ধকারে ঠেলে দেয়। জ্ঞান অর্জনের জন্য উভয়ের অনুসন্ধানই কাম্য।[৩৩] এই উপনিষদে বলা হয়েছে, যিনি সত্য ও নশ্বর এবং প্রত্যক্ষ অসত্য কারণ ও গুপ্ত সত্য কারণ উভয়কেই জানেন, তিনি মুক্ত হয়ে অমরত্ব লাভ করেন।[১৯][২৪]
ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থের শেষ ১৫শ থেকে ১৮শ স্তোত্রে জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে যে জ্ঞান আলোকের সুবর্ণ চাকতির পিছনে লুক্কায়িত থাকে। তবে এই আলোক ব্যক্তিকে খুঁজে নিতে হয়। এই জ্ঞান মানব মনকে তার কৃতকর্মের কথা এবং সেই কৃতকর্মের প্রারব্ধের কথে মনে করিয়ে দেয়।[১৯] মধ্যণ্ডিন ও কান্ব শাখাদুটিতে এই স্তোত্রগুলির বিন্যাসে কিছু পার্থক্য আছে। তবে উভয় শাখাতেই একই অণুধ্যান উল্লিখিত হয়েছে, “হে অগ্নি ও মন, আমাকে পবিত্র জীবনের দিকে নিয়ে যাও। আমাকে পাপের জীবন থেকে দূরে যাওয়ার পথ বলে দাও।” এইভাবে সৎ পথ ও ধন উপভোগের পন্থা (কর্মের মধু ও আত্ম-অনুসন্ধান) বলা হয়েছে।[২০][২৪] শেষ স্তোত্রে মৌলিক ধারণা “আমিই সেই” উল্লিখিত হয়েছে। এই ধারণায় ব্যক্তি আত্মাকে বিশ্বাত্মার সঙ্গে একীভূত করা হয়েছে।[১৯][৩৪]
- পুরুষঃ সোঽহমস্মি
আমিই সেই, তোমার মধ্যে অন্তর্নিহিত পুরুষ।
— ঈশোপনিষদ্, স্তোত্র ১৬ সংক্ষেপিত[২৮]
মহাত্মা গান্ধী ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থটি সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। তিনি বলেছেন, “যদি সকল উপনিষদ্ ও অন্যান্য সকল ধর্মশাস্ত্র হঠাৎ ভস্মীভূত হয় এবং যদি ঈশোপনিষদ্ গ্রন্থের প্রথম শ্লোকটি মাত্র হিন্দুদের স্মরণে থেকে যায়, তাহলেও হিন্দুধর্ম চিরজীবী হবে।”[৩৫]
পল ডুসেন বলেছেন, এই উপনিষদের প্রথম শ্লোকগুলি আত্মজ্ঞানীর নৈতিকতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।[৩৬]