এডওয়ার্ড টেলার | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | সেপ্টেম্বর ৯, ২০০৩ | (বয়স ৯৫)
জাতীয়তা | হাঙ্গেরীয়-আমেরিকান |
মাতৃশিক্ষায়তন | কার্লসরুহে বিশ্ববিদ্যালয় লিপিজিগ বিশ্ববিদ্যালয় |
পরিচিতির কারণ | জন-টেলার প্রতিক্রিয়া হাইড্রোজেন বোমা |
পুরস্কার | হার্ভে পুরস্কার (১৯৭৫) এনরিকো ফের্মি পুরস্কার (১৯৬২) |
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন | |
কর্মক্ষেত্র | পদার্থবিজ্ঞান (পরমাণু) |
প্রতিষ্ঠানসমূহ | গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয় বোর ইনস্টিটিউট ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানহাটন প্রকল্প শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় ফ্লোরিডা ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, ডেভিস লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি হুভার ইন্সটিটিউশন |
ডক্টরাল উপদেষ্টা | ওয়ার্নার হেইজেনবার্গ |
ডক্টরেট শিক্ষার্থী | চেন নিং ইয়্যাং লিঙ্কন ওলফেনস্টেইন মার্শাল রোজেনব্লুথ চার্লস ক্রিচফিল্ড |
স্বাক্ষর | |
এডওয়ার্ড টেলার (হাঙ্গেরীয়: Teller Ede; জন্ম: ১৫ জানুয়ারি, ১৯০৮ - মৃত্যু: ৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৩) হাঙ্গেরীতে জন্মগ্রহণকারী বিশিষ্ট আমেরিকান পরমাণু পদার্থবিদ। সরচরাচর তাকে হাইড্রোজেন বোমার জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়; যদিও তিনি দাবী করেছিলেন যে, এ পদবী ধারণের জন্যে তিনি উপযুক্ত নন।[১] জার্মানীতে অধ্যয়ন শেষে ১৯৩৫ সালে হিটলারের হাত থেকে রক্ষা পেতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত হন। টেলার পরমাণু পদার্থবিদ্যা, আণবিক পদার্থবিদ্যা জন-টেলার ও রেনার-টেলার প্রতিক্রিয়ায় বর্ণালী এবং পদার্থের বহিঃভাগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেছেন। ফের্মি'র বেটা ডিকে তত্ত্ব সম্প্রসারণ করেন যা পরবর্তীতে গ্যামো-টেলার পরিবর্তন নামে পরিচিত ও এ তত্ত্বের প্রয়োগে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। জন-টেলার প্রতিক্রিয়া এবং বেট তত্ত্ব এখনো প্রকৃতরূপেই প্রতিষ্ঠিত ও পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নে ব্যবহৃত হচ্ছে।[২] এছাড়াও তিনি থমাস-ফের্মি তত্ত্বে অংশ নিয়েছেন। ১৯৫৩ সালে নিকোলাস মেট্রোপোলিস এবং মার্শাল রোজেনব্লুথের সাথে তিনিও সহ-লেখকরূপে একটি নিবন্ধ রচনা করেন।[৩]
অত্যন্ত তুখোড় বৈজ্ঞানিক হওয়া স্বত্ত্বেও টেলারের রক্ষণশীল চিন্তা-চেতনার দরুন নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হননি। পরমাণু বিজ্ঞানী হবার পর বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী জে. রবার্ট অপেনহাইমারের বিরুদ্ধে ১৯৫০-এর দশকে স্বাক্ষ্য দেয়ার জন্যে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বিজ্ঞানীদের কাছে বিতর্কিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। এছাড়াও, ১৯৮০-এর দশকে ব্যালেস্টিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় মার্কিন প্রশাসনকে সমর্থন দিয়েও সমধিক ধিকৃত হন।
টেলার ১৯০৮ সালে এক ধনাঢ্য ও শিক্ষিত ইহুদি পরিবারে হাঙ্গেরীর বুদাপেস্টে জন্মগ্রহণ করেন। তখন বুদাপেস্ট ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের অধীনে প্রধান শহরগুলোর একটি, যেখানে ইউরোপে জার্মান ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশে প্রধান কেন্দ্রস্থল। খুবই ছোট্ট থাকা অবস্থায় তার দাদা তাকে নির্বোধ হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ডাক্তার তাকে মানসিক রোগী নামে আখ্যায়িত করেন। কেননা তিন বছর বয়স হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোন কথা বলতে পারতেন না।
টেলারের বয়স যখন মাত্র দশ বছর, তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠে। এরফলে সাম্রাজ্যের পতন ঘটে ও হাঙ্গেরী প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সংক্ষিপ্তকালের জন্যে বেলা কানের সমাজতান্ত্রিক সরকারের শাসনামলে সম্পদশালী অন্যান্য ইহুদি পরিবারের পাশাপাশি তাদের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। তার বাবা আইনজীবী ম্যাক্স টেলার হাঙ্গেরীয় ভাষায় কথাবার্তা বলতেন ও জার্মান ছিলেন। ইলোনা জার্মান নাম্নী পিয়ানোবাদক হাঙ্গেরীয় মাতা জার্মান ভাষায় কথা বলতেন। তাই টেলার বুঝতে পারতেন না তার বাবা-মা কি বিষয়ে কথা বিনিময় করতেন। ইহুদি পরিবারে জন্ম নিলেও তিনি পরবর্তীকালে নাস্তিক হয়েছিলেন।[৪] এ দম্পতিরই দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন টেলার।
এডওয়ার্ড এবং তার বোন এমি এক ইংরেজ শিক্ষকের কাছে ব্যক্তিগত পর্যায়ে পড়াশোনা শিখতেন। মর্যাদাসম্পন্ন মিন্টা জিমন্যাসিয়ামে উপস্থিত থাকতেন। তিনি সংখ্যা নিয়ে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করতেন। অনেক বড় ধরনের সংখ্যার হিসেব কষতে পারতেন। এক বছরের সমান কত সেকেন্ড হবে তার হিসেব কষা এর একটি উদাহরণ।[৫] গণিতের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ও ঝোঁক ছিল। কিন্তু তার পড়াশোনা নতুন দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পটভূমিতে বেশ বাঁধাগ্রস্ত হয়। ফলে, ১৯২৬ সালে এডওয়ার্ড টেলার বুদাপেস্ট ত্যাগ করে জার্মানিতে চলে যেতে বাধ্য হন।[৬]
বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী বুদাপেস্টের বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে জার্মানির কার্লস্রুহে এলাকায় অবস্থিত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান থেকে রসায়ন প্রকৌশলে ডিগ্রী অর্জন করেন। কিন্তু কার্লস্রুহে অবস্থানকালীন তিনি পদার্থবিদ্যায় ব্যাপকভাবে আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েন, বিশেষ করে কোয়ান্টাম মেকানিকসের নতুন তত্ত্বের উপর। এরপর ১৯২৮ সালে তরুণ রসায়ন প্রকৌশলী টেলার কোয়ান্টাম মেকানিকস বিষয়ে পড়াশোনার লক্ষ্যে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত হন। মিউনিখে অধ্যয়নকালীন সময়েই টেলার চলন্ত গাড়ীর নিচে পড়ে যান ও মারাত্মকভাবে আহত হন। এরফলে তার ডান পা কেটে ফেলতে হয় ও একটি কৃত্রিম পা প্রতিস্থাপন করতে হয়। একসময় তিনি আরোগ্য লাভ করেন ও হাঁটতে শেখেন। লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত হয়ে নতুন পদার্থবিদ্যার অগ্রদূত ও জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্নার হেইজেনবার্গের অধীনে কাজ করেন। অতঃপর ১৯৩০ সালে লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাকৃতিক রসায়ন বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। তার অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল হাইড্রোজেনের পরমাণুর আয়ন চিহ্নিতকরণ যা পরবর্তীকালে আণবিক অক্ষের তত্ত্ব গড়তে সাহায্য করেছে ও অদ্যাবধি প্রারম্ভিক দলিলাদির অন্যতম হিসেবে বিশ্বের সর্বত্র সমাদৃত হয়ে আসছে।
গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টিতে গবেষণা পরামর্শকরূপে নিজ অবস্থান নিশ্চিত করেন ও জার্মানিতে সমৃদ্ধ কর্মময় জীবনের সূচনা করেছিলেন। কিন্তু আবারো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সূত্রপাত ঘটে। অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বাধীন নাজি বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করে। টেলার তা দ্রুত অনুধাবন করেন ও ভবিষ্যতের কোন আশা নেই ভেবে জার্মানি ত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। ১৯৩৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির সহযোগিতায় শুধুমাত্র ইহুদি-বিদ্বেষী নীতির কারণে দেশত্যাগী হিসেবে পরিচিতি পান। শুরুতে তিনি ইংল্যান্ডে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু উদীয়মান পদার্থবিদদের সহায়তায় অবশেষে ১৯৩৪ সালে ডেনমার্কে অভিবাসিত হন টেলার। সেখানে তিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কীয় প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। ঐ প্রতিষ্ঠানেই বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী নিলস বোর একদল তরুণ বিজ্ঞানীদের নিয়ে পরমাণুর গঠনের গুপ্ত বিষয়াবলী নিয়ে কাজ করছিলেন।
২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৪ সালে বুদাপেস্টে তিনি তার বোনের দীর্ঘদিনের বান্ধবী এবং উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী অগাস্টা মারিয়া মিৎজি হার্কানি-কে বিয়ে করেন। নির্বাসনকালীন অবস্থায় এ বিয়েটিকে ঘিরে অর্ধ-শতাব্দীকাল বিতর্কের সৃষ্টি করে। ঐ একই বছর তিনি সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে কোপেনহেগেনের নিলস বোর ইন্সটিটিউটে রকফেলার বৃত্তির জন্যে যান। ডেনমার্কেই তিনি বিখ্যাত রুশ পদার্থবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী জর্জ গ্যামফের সাথে পরিচিত হন। এক বছর পর গ্যামফে ওয়াশিংটনে অবস্থিত জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান এবং টেলার সংক্ষিপ্তকালের জন্য ইংল্যান্ডের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই ওয়াশিংটন থেকে গ্যামফের সাথে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পান টেলার। তার এ প্রস্তাবটি তিনি সাদরে গ্রহণপূর্বক ১৯৩৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্ত্রী সহযোগে অস্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন ও জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে গ্যামফে নিয়োগ দেন। ১৯৪১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ নাগরিকের মর্যাদা লাভ করেন।
এডওয়ার্ড টেলার-অগাস্টা মারিয়া দম্পতির দুই সন্তান রয়েছে। শিকাগোতে ১৯৪৩ সালে পল এবং ৩১ আগস্ট, ১৯৪৬ তারখে লস অ্যালামোজে সুসান ওয়েন্ডি টেলার জন্মগ্রহণ করে।
১৯৩০-এর দশকের শুরুতে ভিমার প্রজাতন্ত্রে বসবাসরত অবস্থায় পরমাণু পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে আগ্রহান্বিত হন। এরফলেই তিনি কোপেনহেগেনে বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী নিল্স বোরের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালে রুশ পদার্থবিদ জর্জ গ্যামফ এবং লেভ ল্যান্ডাউয়ের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এছাড়াও চেক পদার্থবিদ জর্জ প্ল্যাজেকের সাথে আমৃত্যু বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক বজায় রাখেন। প্ল্যাজেক এডওয়ার্ড টেলারের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও দার্শনিক চিন্তা-ভাবনার উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। রোমে এনরিকো ফার্মি'র সাথে তরুণ টেলারের পরিচয় ঘটান প্ল্যাজেক। এরফলে পরমাণু পদার্থবিদ্যায় টেলরকে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন ফার্মি।[৭] পরবর্তীতে ১৯৩১ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা পেশার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।
১৯৩৫ সালে এডওয়ার্ড টেলার ও তার স্ত্রী অগাস্টা হার্কানিকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত হন। জর্জ গ্যামফের উৎসাহ-উদ্দীপনাতেই মূলতঃ ঐবছরই তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকরূপে যোগ দেন। সেখানে তিনি তার সহকর্মী ও বন্ধু জর্জ গ্যামফকে সাথে নিয়ে উপ-অণু কণাকে বিমুক্ত করে নিউক্লিয়াস কণা শ্রেণিবিন্যাসের জন্যে নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হন। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত তিনি জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্যামো'র সাথে একত্রে ছিলেন।
১৯৩৭ সালে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন জন-টেলার প্রতিক্রিয়া বিষয়টি তুলে ধরেন। সেখানে অনুকূল পরিবেশে পরমাণুর ভঙ্গুরতা; এর প্রভাবে ধাতব পদার্থে রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া এবং বিশেষ ক্ষেত্রে পদার্থের রঙের পরিবর্তনের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। টেলার এবং হারম্যান আর্থার জন বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, এ ঘটনাটি সম্পূর্ণরূপেই গাণিতিক পদার্থবিদ্যার একটি অংশ মাত্র। ব্রুনাউয়ের এবং ইমেতের সাথে যৌথভাবে পদার্থ এবং রসায়নের বহিঃর্ভাগ শীর্ষক একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন যা ব্রুনাউয়ের-ইমেত-টেলার (বেট) তূল্য পরিমাণ তাপ বা বেট তত্ত্ব নামে সমধিক পরিচিত।[৮] পাশাপাশি কোয়ান্টাম, আণবিক কণা এবং পারমাণবিক পদার্থবিদ্যা বিষয়েও কাজ করেছেন তিনি। ওয়াশিংটেন টেলার স্থায়ীভাবে বসবাসপূর্বক শান্তিপূর্ণভাবে তার জীবনকে শিক্ষার সাথে জড়িত রাখতে চাইলেও ইউরোপ পুনরায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে টেলার বিশ্বযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত হতে চেয়েছিলেন। তিনি বায়ুগতিবিদ্যায় সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব হাঙ্গেরীয় এমিগ্রে থিয়োডর ভর কারম্যানের পরামর্শে তার বন্ধু হান্স বেটকে সাথে নিয়ে শক-ওয়েভ প্রসারন তত্ত্বের উন্নয়ন ঘটান। পরবর্তী বছরগুলোয় মিসাইল গবেষণার সাথে জড়িত বিজ্ঞানীদের কাছে মূল্যবান প্রামাণ্য দলিল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।[৯]
হিটলারের জার্মানিতে তখনো স্বল্প পরিসরে পরমাণু পদার্থবিদ্যার উন্নয়নে কাজ চলছিল। কিন্তু ১৯৩৯ সালে পরমাণু বিভাজনের বিষয়টি জার্মান বিজ্ঞানীরা আবিষ্কারের পূর্বে তাত্ত্বিক পদার্থবিদের ভূমিকায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন টেলার। পরমাণু বিভাজন প্রক্রিয়াকে কেবলমাত্র তাত্ত্বিকভাবেই সম্ভব যা শক্তিকে তাপে রূপান্তর করতে পারে। এ বিষয়টি টেলার ও অন্যান্য শরণার্থী পদার্থবিদগণ বুঝতে পারেন। তারা ধারণা করেন যে, কোন কারণে এ ধরনের বিধ্বংসী শক্তি এডলফ হিটলারের হাতের মুঠোয় রয়েছে যা মানুষের অজানা। তাদের ভীতিবোধ আরও পুঞ্জীভূত হয় যাতে ভের্নার কার্ল হাইজেনবের্গ স্বয়ং জার্মান পরমাণু প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
লিও জিলার্ড ছিলেন টেলারের বন্ধু। আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণের দুই বছর পূর্বে ১৯৩৯ সালে তিনি লিও জিলার্ড এবং ইউগিন উইগনার নামীয় আরও দুইজন হাঙ্গেরীয় শরণার্থী বিজ্ঞানীদেরকে নিয়ে আলবার্ট আইনস্টাইনের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তারা আইনস্টাইনকে তাদের চিন্তা-ভাবনা ও সমূহ বিপদের আশঙ্কা বুঝাতে সক্ষম হন। আইনস্টাইনের সহযোগিতায় মার্কিন প্রশাসনকে নাজি জার্মানির পারমাণবিক বোমা তৈরীর মার্কিনী সক্ষমতার বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা চালান ও সফলতা লাভ করেন। ১৯৩৯ সালে নিল্স বোর ইউরেনিয়াম বিভাজনের আকস্মিক ও হতবিহ্বলকারী প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এরফলে তিনি তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের কাছে তার দৃষ্টিভঙ্গী উপস্থাপন করে। এ বিষয়টিতে প্রভাবান্বিত হয়ে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট যুক্তরাষ্ট্রের সকল বিজ্ঞানীর কাছে নাজি বাহিনীর আক্রমণ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও সুসংহত করার জন্যে আবেদন জানান। ১৯৪১ সালে টেলার মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৪২ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত এনরিকো ফার্নি'র দলে সেরা পদার্থবিদদের একজন হিসেবে যোগ দেন। দলটি কীভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শিকল বিক্রিয়ার মাধ্যমে কার্যকর হয় এ বিষয়ে কাজ করছিল। তাদের প্রধান ও একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল - জার্মানদের পূর্বেই আণবিক বোমা তৈরি করা। বার্কেলেতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আণবিক বোমা সংক্রান্ত তাত্ত্বিক শিক্ষা বিষয়ে কর্মরত জে. রবার্ট অপেনহাইমার নামীয় বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানীর কাছ থেকে গ্রীষ্মকালীন পরিকল্পনা বিষয়ক সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্যে আমন্ত্রণবার্তা পেয়ে তা গ্রহণ করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল ম্যানহাটন প্রকল্প তৈরী করা। এ প্রকল্পটি মিত্রশক্তি কর্তৃক প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরী ও উন্নয়নের পদক্ষেপবিশেষ। এর কয়েক সপ্তাহ পূর্বেই তার বন্ধু ও সহকর্মী এনরিকো ফার্মি'র সাথে টেলার আণবিক যুদ্ধের উদ্দেশ্য সংক্রান্ত বিষয়ে এক বৈঠকে মিলিত হন। বার্কলে অধিবেশনে টেলার পরমাণু বিভাজনজনিত যুদ্ধের আলোচনাকে হাইড্রোজেন বোমার যুদ্ধে রূপান্তর করেন যাকে তিনি 'সুপার' নামে আখ্যায়িত করেন। হাইড্রোজেন বোমাকে শুরুর দিকে সুপার নামে বলা হতো।[১০] ১৯৪৩ সালে নিউ মেক্সিকোতে এলামোজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির অবকাঠামো অপেনহাইমার অত্যন্ত গোপনে প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে টেলার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে নিযুক্ত হন।
ফলশ্রুতিতে ম্যানহাটন প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন এডওয়ার্ড টেলার। প্রকল্পের উন্নয়নের অংশরূপে প্রথম আণবিক বোমা নিয়ে কাজ করেন। এ সময়েই তিনি প্রথমবারের মতো পারমাণবিক বিক্রিয়া ব্যবহার করে অস্ত্র নির্মাণের লক্ষ্যে ব্যাপকভাবে মনোসংযোগ ঘটান। কিন্তু তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ভিন্নতর ছিল। আণবিক বোমা উদ্ভাবনের জন্যে লস এলামোজ প্রকল্প গঠিত হলেও টেলার মূল গবেষণা থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যান এবং তিনি তার নিজের প্রয়োজনে বহুগুণ শক্তিশালী তাপ আণবিক ক্রিয়ায় গঠিত হাইড্রোজেন বিক্রিয়ার বোমা তৈরীতে অগ্রসর হন।
৬ ডিসেম্বর, ১৯৪১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আণবিক বোমা উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান আর্থার কম্পটন। তিনি ইউরেনিয়াম গবেষণার সাথে জড়িত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমকে সমন্বয় করতেন। ঘটনাক্রমে কম্পটন কলম্বিয়ায় এবং প্রিন্সটনের বিজ্ঞানীদল শিকাগো মেটালার্জিক্যাল ল্যাবরেটরীতে স্থানান্তরিত হন। এনরিকো ফার্মি এপ্রিল, ১৯৪২ সালে স্থানান্তরিত হন ও শিকাগো পাইল ১ নামীয় বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক চুল্লীর অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়। টেলার প্রথমেই চলে যান কিন্তু দুই মাস পর তাকে আবারো শিকাগোতে ফিরিয়ে আনা হয়। ১৯৪৩ সালের শুরুর দিকে অপেনহাইমারের তত্ত্বাবধানে নিউ মেক্সিকোর লস এলামোজ ল্যাবরেটরীতে আণবিক বোমার নক্সা প্রণয়ন কার্য শুরু হয়। এপ্রিল, ১৯৪৩ সালে টেলার সেখানে স্থানান্তরিত হন[১১] ও অপেনহাইমারের নেতৃত্বে প্রথম আণবিক বোমা আবিষ্কারের সাথে জড়িত হন।
বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে অত্যন্ত গোপনীয় লস এলামোজ ল্যাবরেটরীর তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা বিভাগে এডওয়ার্ড টেলার নিয়োগ পান। সর্বক্ষণই পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কীয় বিষয়াদি তার চিন্তা-ভাবনায় নিমজ্জ্বমান ছিল। কিন্তু তার এ ভাবনাকে যুদ্ধের সময় খুব কমই অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল। হাইড্রোজেন বোমার প্রতি তার অতি আগ্রহ এবং উদ্বিগ্নতাজনিত কারণে হান্স বেটেকে স্থলাভিষিক্ত করা হয়। তিনি ইমপ্লোসন মেকানিজম বিষয়ের সমীকরণ করা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। এরফলে অন্যান্য গবেষক দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অতিরিক্ত বিজ্ঞানী হিসেবে ক্লজ ফুকসকে সংযুক্ত করা হয়। ফুকস পরবর্তীকালে সোভিয়েত গুপ্তচর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিলেন।[১২] অন্যদিকে মধ্যরাতে টেলার সহকর্মীদের সাথে পিয়ানো বাজাতেন।[১৩] এরপরও তিনি আণবিক বোমার গবেষণায় বেশ মূল্যবান সময় অতিক্রমণ করেছিলেন।
১৯৪০-এর দশকের শুরুতে তাপ প্রবাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে নিউক্লিয়ার ফিসন থেকে নিউক্লিয়ার ফিউশনে পরিবর্তিত হবার সম্ভাবনা কথা টেলার মনে করতেন যা ব্যাপক বিস্ফোরণের জন্ম দেবে। তিনি লস এলামোজের প্রকল্পে ফিসন ও ফিউশনের উভয় বিষয়েই সাফল্যের আশা করেছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানের ফিসন যন্ত্রাংশের মাধ্যমে জটিল ধরনের ফিউশন বিষয়ক গবেষণা স্থগিত করতে বাধ্য হন তিনি যা টেলারের মনে গভীর রেখাপাতের সৃষ্ট করে।
আণবিক বোমা গঠনে এডওয়ার্ড টেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। শুরুর দিকে কিছু বিজ্ঞানী অনিয়ন্ত্রিত পন্থায় পরমাণু বিক্রিয়ার আশঙ্কা করেছিলেন। তারা ভেবেছিলেন যে প্রস্তাবিত বোমাটি অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারে ও পৃথিবীর বিপুল ক্ষতিসাধন করবে। কিন্তু টেলার হিসাব কষে বিজ্ঞানী দলকে পুনরায় নিশ্চয়তা বিধান করেছিলেন। তার মতে, পারমাণবিক বিস্ফোরণটি বেশ শক্তিশালী হলেও তা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
তিনি ছিলেন খুব কমসংখ্যক বিজ্ঞানীদের একজন যিনি চোখ রক্ষা করে স্বশরীরে জুলাই, ১৯৪৫ সালে সংঘটিত নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের এলামোগোর্দো এলাকায় সফল ও পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম আণবিক বোমা বিস্ফোরণের দৃশ্য দেখেন। কিন্তু তার সহযোগীরা সকলেই ঐ সময়ে পিঠ উপরে দিয়ে ভূমিতে শুয়ে পড়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি আণবিক বিচ্ছুরণ সম্পর্কে বলেন যে, 'যদি আমি অন্ধকার কক্ষে তাকাই, তাহলেও পূর্ণশক্তির উজ্জ্বল দিনের আলোয় আলোকিত করবে।'[১৪] জার্মানদের প্রকল্পও সমাপ্তির দিকে ছিল কিন্তু তার পূর্বেই জার্মানি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। প্রথম পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ কার্যক্রম শেষ হবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকার বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এরফলে জাপান আত্মসমর্পণ করে ও যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। যুদ্ধ শেষ হবার পরপরই টেলার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সম্মতিক্রমে লস এলামোজে ফিউশন বিক্রিয়ায় সচেষ্ট হন। অবশেষে তিনি তাপীয় পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে সক্ষমতা প্রদর্শন করেন যা জাপানে নিক্ষিপ্ত বোমার তুলনায় অনেকগুণ বেশি শক্তিশালী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লিভারমোর অঞ্চলে ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় পারমাণবিক অস্ত্র গবেষণাগার ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তেজস্ক্রিয়তা সংক্রান্ত গবেষণাগার যা বর্তমানে লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি নামে পরিচিত। তিন এ গবেষণাগারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ও প্রতীকি হয়ে আছেন। গবেষণাগারটিতে তিনি আর্নেস্ট ও লরেন্সের পাশাপাশি একাধারে পরিচালক এবং সহযোগী পরিচালক হিসেবে অনেকগুলো বছর অতিক্রমণ করেন। সেখানে তিনি পরবর্তী প্রায় চার দশককাল অতিক্রমণ করেন এবং গবেষণাগারটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের প্রধান কারখানায় রূপান্তর করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ এবং ১৯৬০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি এর সহযোগী পরিচালক ও ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পরিচালক পদে আসীন ছিলেন। পরিচালকের পদ থেকে অবনমন ঘটলেও ১৯৬০-এর দশকে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ বিষয়ে কংগ্রেসে উপস্থাপিত প্রস্তাব অনুমোদনের প্রাক্কালে টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে জোরালো প্রচারণা চালান।[১৫] চাকুরীজীবনের পাশাপাশি ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বার্কেলে এলাকায় অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে প্রায়োগিক বিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। এরফলে তাকে সম্মানসূচক অধ্যাপক হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়।[১৬] পরবর্তীতে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর-এট-লার্জ পদে দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭৫ সালে অধ্যাপনার পেশা ও লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তার সম্মানে লিভারমোর ল্যাবরেটরিতে এমিরেটাস পরিচালক পদ সৃষ্টি করা হয় এবং হুভার ইনস্টিটিউশনে সিনিয়র রিসার্চ ফেলোরূপে নিযুক্তি দেয়া হয়।
১৯৮৩ সালে থমাস জেফারসন স্কুলে জর্জ রেইজম্যানের পরিচালনায় বিষয়বস্তুতা শীর্ষক বুদ্ধিজীবিদের এক সম্মেলনে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মাননা জানানো হয়।[১৭]
১৯৪৫ সালে আণবিক বোমার সফলতম উন্নয়ন ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারকে পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়নে ম্যানহাটন প্রকল্পকে নতুন প্রকল্পরূপে গ্রহণ করে হাইড্রোজেন বোমা আবিষ্কারের দিকে ধাবিত করতে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত ও চাপ প্রয়োগ করেন। ১৯৪৬ সালে এডওয়ার্ড টেলার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু বিদ্যা ইন্সটিটিউটের একটি পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও লস এলামোজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে অতিরিক্ত সময়কালের জন্যে পরামর্শক হিসেবে ফিরে আসেন।
এছাড়াও, ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রেক্ষাপটে টেলার আরও সুদৃঢ় অবস্থানে অনড় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হাইড্রোজেন বোমা তৈরীতে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। কিন্তু আণবিক শক্তি কমিশনের সাধারণ উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান জে. রবার্ট অপেনহাইমার তাতে আপত্তি উপস্থাপনসহ বিরুদ্ধাচরণ করেন। অপেনহাইমারের মতে এ ধরনের বোমা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত আণবিক বোমার তুলনায় প্রায় ৫০০ গুণ শক্তিশালী, যার আর তেমন কোন প্রয়োজন নেই। এ বিতর্ক আরও উজ্জ্বীবিত হয়ে উঠে যখন যায় যে ব্রিটিশ আণবিক বিজ্ঞানী ক্লজ ফুকস ১৯৪২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ অবলম্বন করে গোয়েন্দাবৃত্তিতে নিয়োজিত ছিলেন। ফুকস হাইড্রোজেন বোমার ব্যাপারে আমেরিকানদের আগ্রহের বিষয়টি পূর্বেই অবগত হয়েছিলেন। অনেক পূর্বেই তিনি আমেরিকানদের কাছে থাকা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সোভিয়েতদের কাছে হস্তান্তর করেন। টেলার নতুন প্রকল্পের বিষয়ের গুরুত্বতার বিষয়টিতে মার্কিন প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করাতে সক্ষম হন। ফলশ্রুতিতে মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান অস্ত্র প্রতিযোগিতায় অগ্রসর হবার কথা জানান। অন্যদিকে এডওয়ার্ড টেলার তার স্বপ্ন পূরণে লস এলামোজের দায়িত্বে নিয়োজিত হন।
হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা বর্ষণের বিষয়টি অপেনহাইমারের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। ম্যানহাটন প্রকল্পে নিয়োজিত অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে কেবল স্বল্পসংখ্যক বিজ্ঞানীই পারমাণবিক অস্ত্রের গবেষণায় থাকতে ইচ্ছে পোষণ করেন। নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি লস এলামোজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে তার সাবেক প্রধান ও সহকর্মী জে. রবার্ট অপেনহাইমারের বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য দেন। এরফলে তিনি সমগ্র বৈজ্ঞানিক মহলে ব্যাপকভাবে সমালোচিত ও নিন্দিত হন। কিন্তু তিনি মার্কিন সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পান এবং সামরিক গবেষণা প্রতিষ্ঠায় অংশ নেন। বিশেষতঃ তার পরামর্শক্রমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক শক্তি খাতের উন্নয়ন, শক্তিশালী পারমাণবিক অবকাঠামো বিনির্মাণ এবং উচ্চাভিলাষী পারমাণবিক পরীক্ষা সম্পর্কীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
১৯৫৪ সালে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে অপেনহাইমারের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বিষয়ক শুনানীর আয়োজন করা হয়। সেখানে টেলার লস এলামোজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির সাবেক প্রধান ও আণবিক শক্তি কমিশনের উপদেষ্টা জে. রবার্ট অপেনহাইমারের বিরুদ্ধে সহানুভূতিবিহীন অবস্থায় স্বাক্ষ্য প্রদান করেন। পরমাণু বিভাজন এবং হাইড্রোজেন বোমা গবেষণা - উভয় বিষয়ে লস এলামোজে প্রায়শঃই তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হতেন। শুনানীতে বৈজ্ঞানিক মহল থেকে একমাত্র তিনিই মনোনীত হয়েছিলেন।[১৮] তিনি বলেন, আমি মনে করি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে আরও নিরাপত্তা দিতে হবে ও নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
শুনানীতে আণবিক শক্তি কমিশনের অ্যাটর্নী রজার রবের 'ড. অপেনহাইমারকে কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অবিশ্বাস্য বলে তুলে ধরা হয়েছে বলে পরিকল্পনা করেছেন' - এ প্রশ্নের জবাবে টেলার উত্তর দিয়েছিলেন:[১৯]
আমি এ ধরনের কোন পরামর্শ দিতে চাই না। আমি জানি অপেনহাইমার নিজের বুদ্ধি-বৃত্তিচর্চায় খুবই সচেতন এবং তাঁকে বুঝা খুবই কঠিন ব্যাপার। আমি মনে করি তিনি অতি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং আমার পক্ষ থেকে তাঁর কাজের উদ্দেশ্য বুঝার চেষ্টা করা ভুল সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু আমি সবসময়ই আশাবাদী এবং এখনো আমি আশাবাদী যে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসী থাকবেন। আমি তাই বিশ্বাস করি এবং তখনই বিশ্বাস করবো যখন আমি দেখবো প্রতিপক্ষ আমাকে তা প্রমাণের মাধ্যমে এর সফল পরিসমাপ্তি দেখাতে পেরেছেন।
তদন্ত কমিটির কাছে কেন তিনি বিশ্বাস করেন যে অপেনহাইমার নিরাপত্তা বিষয়ক ঝুঁকিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব - এ প্রশ্নের জবাবে টেলার বলেন:[২০]
অনেকগুলো বিষয়ে আমি ড. অপেনহাইমারকে অভিনয় করতে দেখেছি। আমি বুঝতে পেরেছি যে তিনি অভিনয় করছেন। এরফলে তাঁকে আমার দিক থেকে বেশ বুঝতে বেশ কষ্ট হয়েছে। আমি অনেকগুলো বিষয়েই তাঁর সাথে একমত হতে পারিনি এবং তাঁর কর্মপন্থা সত্যিকার অর্থেই আমাকে বিভ্রান্ত এবং জটিলতার দিকে অগ্রসর করেছে। এ প্রেক্ষিতে আমি মনে করেছি যে দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে যিনি বিশ্বাসী তাঁর হাতেই থাকা উচিত। স্বল্প চিন্তা-চেতনার অধিকারী হয়ে আমি অনুভব করি যে যদি আণবিক অস্ত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি একটি অতি সাধারণ ব্যাপার বলে মনে হয়, তাহলে তার বিষয়বস্তু বাদ-বাকী অন্যান্য লোকদের কাছে পৌঁছবেই।
এরফলে শুনানী শেষে অপেনহাইমারকে নিরাপত্তা বিষয়ক যাবতীয় বিষয়াবলী থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয় এবং বিজ্ঞানবিষয়ক প্রশাসক পদের দায়িত্ব থেকেও তাকে অব্যহতি দেয়া হয়। যদিও টেলারের স্বাক্ষ্যই যে তার এ চলে যাওয়ার বিষয়ে প্রধান সিদ্ধান্তরূপে মনে করা হয় না; তারপরও অনেক প্রথিতযশা আমেরিকান পরমাণু বিজ্ঞানীগণ অপেনহাইমারের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে টেলারকে কখনো ক্ষমা করতে পারেননি। টেলারের অধিকাংশ সহকর্মীই তার স্বাক্ষ্যের বিষয়ে সন্দিহান প্রকাশ করেন এবং বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের তাকে দূরে সরিয়ে রাখেন।[১৮] এ ঘটনার পর ধারাবাহিক ও জোরালোভাবে অপেনহাইমারের বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা অস্বীকার করেন। এমনকি তিনি তাকে দোষমুক্ত রাখতে চেষ্টা করেছিলেন বলে জানান। প্রামাণ্য দলিল-দস্তাবেজ মোতাবেক ঘোষণা করা হয় যে, এটি কোনরূপ মামলা নয়। স্বাক্ষ্য গ্রহণের ছয় দিবস পূর্বে টেলার আণবিক শক্তি কমিশনের একজন কর্মকর্তার সাথে দেখা করেছিলেন এবং তিনি বলেছিলেন যে টেলারের স্বাক্ষ্যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হতে পারে।[২১] এছাড়াও, টেলারের স্বাক্ষ্য বিষয়াবলী অপেনহাইমারের বিপক্ষে অবস্থান করলে অপেনহাইমারকে চাকুরীচ্যুত করা হবে। এরফলে তিনি আমেরিকান বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের প্রধান নেতা হতে পারবেন।[২২]
১৯৪৬ সালে টেলার তাপীয় পারমাণবিক জ্বালানী হিসেবে ডিউটেরিয়ামের ব্যবহার শীর্ষক একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন এবং হাইড্রোজেন বোমার সম্ভাব্য রূপরেখার বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এতে করে হাইড্রোজেন বোমায় টেলারের চিন্তা-ভাবনা আরও অনুকূলে আসে। পাশাপাশি ডিউটেরিয়ামের পরিমাণগত দিকও তুলে ধরা হয় যাতে ডিউটেরিয়াম প্রজ্জ্বলনে স্বল্পমাত্রায় তেজস্ক্রিয়তা নির্গত হবে। এছাড়াও ট্রিটিয়ামের দূর্মূল্যজনিত কারণে তাপীয় পারমাণবিক জ্বালানীতে মিশ্রণে প্রায় একই উত্তাপ তৈরী হবে। কিন্তু ঐ সময়ে তখনো কেউই জানতো না যে ঠিক কতটুকু ট্রিটিয়ামের প্রয়োজন হতে পারে। সম্মেলন শেষে রবার্ট সার্বারের ন্যায় কিছু সদস্য এর বিরোধিতা করেন। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও টেলার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন পেশ করেন যে হাইড্রোজেন বোমা নির্মাণ করা সম্ভব এবং পারমাণবিক অস্ত্র উদ্ভাবনের বাদ-বাকী কাজ সম্পন্ন করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন। ফুকসও এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং মস্কোতে এ তথ্য পাচার করে দেন। টেলারের ক্লাসিকেল সুপার মডেলটি এতেটাই অনিশ্চিত ছিল যে পরবর্তীতে অপেনহাইমার বলেছিলেন হয়তোবা রাশিয়ানরা এ নক্সার আদলে তারা নিজেরাই হাইড্রোজেন বোমা তৈরী করে ফেলবে।[২৩] ১৯৪৬ সালে তিনি লস এলামোজ ত্যাগ করে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তখন তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন এনরিকো ফার্মি এবং মারিয়া মেয়ার।[২৪] তখন থেকেই এডওয়ার্ড টেলার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাইড্রোজেন বোমার জনক হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে আসছেন। ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমবারের মতো আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এরফলে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান হাইড্রোজেন বোমা নির্মাণের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে উন্নয়ন পরিকল্পনার ঘোষণা দেন। এরফলে ১৯৫০ সালে লস এলামোজের প্রকল্পটিতে কাজ করার উদ্দেশ্যে ফিরে আসেন। সেখানে তিনি ক্লজ ফুকস-সহ আরও কয়েকজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীকে অন্তর্ভুক্ত করেন।[২৫]
টেলার এবং তার সহকর্মীরা লস এলামোজে তাপ পরমাণুবিশিষ্ট যন্ত্রের নক্সা প্রণয়নে ১৯৫১ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত অল্পই অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। স্টেইনস্ল মার্সিন উলাম নামীয় পদার্থবিদ প্রস্তাবনা করেন যে আণবিক বোমায় কারিগরীভাবে সঙ্কুচিত অবস্থায় থাকা দ্বিতীয় অংশে ধাক্কা দিবে যা বিস্ফোরিত হবে। এরফলে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরণের জন্যে সংরক্ষিত দ্বিতীয় অংশে বরাদ্দ তাপ পরমাণুর জ্বালানী আরও অধিক কার্যক্ষম হবে। টেলার তার এ পরামর্শ গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যেকার সৃষ্ট এ নতুন চিন্তাধারার প্রেক্ষিতেই গঠিত হয় বিক্রিয়াজনিত অস্ত্রের নক্সা যা টেলার-উলাম নক্সা নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়। টেলার বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়নের রূপকার হিসেবে ধারাবাহিকভাবে চিত্রিত হয়ে আসছেন। কিন্তু, উলামের এ পারমাণবিক বোমার নক্সা প্রণয়নে অন্যতম প্রধান ভূমিকার কথকতা সরকারী নথিপত্রে উল্লেখ করা হয়নি। এ ঘটনার প্রায় তিন দশক পর নক্সার বিষয়াবলী প্রকাশ করা হয়।
এ নক্সার মাধ্যমে সৃষ্ট পারমাণবিক অস্ত্রটি ১ নভেম্বর, ১৯৫২ সালে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের এনিউইটেক প্রবালদ্বীপে পরীক্ষামূলকভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। অস্ত্রের এ পরীক্ষাটির সক্ষমতা ছিল ১০ মিলিয়ন টন বা ১০ মেগাটন টিএনটি ক্ষমতাসম্পন্ন।
অস্ত্রের রূপরেখা প্রণয়ন এবং কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা স্বত্ত্বেও তার সমান্তরালে অবস্থানকারী অনেক বিজ্ঞানী বোমার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তেমনিই একজন হচ্ছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী আন্দ্রে শাখারভ। শাখারভ ১৯৫০ সালে সারোভে প্রথমবারের মতো মেগাটন-দূরত্বের সোভিয়েত হাইড্রোজেন বোমা নক্সার মান উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা নেন। পরবর্তীতে তার এ নক্সাই তৃতীয় চিন্তা নামে রাশিয়ায় পরিচিতি লাভ করে যা ছিল টেলার-উলাম নক্সার অনুরূপ।
অপেনহাইমার বিতর্কের পর টেলার বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের কাছে পরিত্যাজ্য হলেও মার্কিন প্রশাসন এবং সমর বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তার নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ও পরামর্শে পারমাণবিক শক্তির উন্নয়ন, শক্তিশালী পারমাণবিক ভিত্তি এবং যুগান্তকারী পারমাণবিক পরীক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এছাড়াও ১৯৪০-এর দশকের শেষার্ধ্বে তিনি পারমাণবিক চুল্লী নিরাপত্তা কমিটির সভাপতি হিসেবে পারমাণবিক চুল্লীর নিরাপত্তার মানোন্নয়নে আণবিক শক্তি কমিশনকে যথেষ্ট সাহায্য করেন।[২৬]
কট্টর সমাজতন্ত্রবিরোধী ব্যক্তি হিসেবে এডওয়ার্ড টেলার ১৯৬০-এর দশকের অধিকাংশ সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পরমাণু অস্ত্রের ভীতি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষার জন্যে সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি সোভিয়েত মিসাইল ভীতি মোকাবেলায় প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ও গুরুত্বারোপ করার জন্যে বিরাটভাবে চাপ প্রয়োগ করেন। ১৯৫৮ সালে রকফেলার ব্রাদার্সের গঠিত সামরিক উপ-প্যানেল বিশেষ শিক্ষা প্রকল্পের স্বাক্ষরদাতাদের একজন ছিলেন। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেটে আরও ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দের জন্যে বলা হয়েছিল।[২৭] ১৯৬৩ সালে তিনি পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বিরুদ্ধাচরণ করে গেছেন যা বায়ুমণ্ডলে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধতা সংক্রান্ত। কেন্দ্রীয় সরকারের রূপরেখা অনুযায়ী পারমাণবিক বিস্ফোরণকে শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহারের বিরুদ্ধেও তার অবস্থান ছিল। ১৯৭০-এর দশকে টেলারকে মার্কিন সরকারের প্রথিতযশা উপদেষ্টারূপে রাখা হয় যাতে পরমাণু অস্ত্র নীতি প্রণয়ন করা হয়। ১৯৮২-৮৩ সালে প্রতিরক্ষা কৌশলকে প্রধান বিষয় হিসেবে রাখতে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান প্রশাসনকে ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে গেছেন। এ কৌশলটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক হামলা থেকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সৃষ্টি করা। মহাকাশ যুদ্ধ প্রকল্পে রোনাল্ড রিগ্যানকে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করেন যা লেজার রশ্মি প্রয়োগের সাহায্যে মহাকাশ থেকে পারমাণবিক বোমাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
কয়েক দশক ধরে হাঙ্গেরীতে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ হলেও তিনি তার মাতৃভূমি কিংবা মায়ের ভাষাকে ভুলতে পারেননি। ১৯৮৯ সালে হাঙ্গেরীতে সমাজতন্ত্র পতন হলে নিজ জন্মভূমিতে বেশ কয়েকবার সফরসহ রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিকে গভীরভাবে সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। ২০০২ সালের নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীল দল ফিদ্জ কর্তৃপক্ষের কাছে দলের প্রতি তার সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেন। তার মৃত্যুর একমাস পর বেলেভিলে নামীয় একজন হাঙ্গেরীয় সাংবাদিক বামপন্থী সংবাদপত্রে টেলারের একটি চিঠি প্রকাশ করেন। পত্রে তিনি ফিদ্জ দলকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন বলে উল্লেখ করা হয়। টেলারের বন্ধুবর্গ এবং তার সচিব চিঠির বৈধতা সম্পর্কে জানতে চান; কেননা তারা বিশ্বাস করতে পারেননি যে টেলার কখনো এ ধরনের লেখা লিখতে পারেন। কিছুদিন পরই জানা যায় যে, চিঠিটি ভূয়া ছিল।
পরমাণু বিদ্যার পথিকৃৎ এনরিকো ফার্মি'র সম্মানে প্রদেয় এক লক্ষ মার্কিন ডলার মূল্যমানের এনরিকো ফার্মি পুরস্কার লাভ করেন টেলার। বৈজ্ঞানিক এবং কারিগরী সংক্রান্ত বিষয়ের উন্নয়নে অসামান্য অবদান বিশেষ করে শক্তি উৎপাদনের জন্যে ১৯৬২ সালে এ পুরস্কারের জন্যে তিনি মনোনীত হন। উল্লেখ্য, এ পুরস্কারটি হোয়াইট হাউস থেকে ঘোষিত হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত। ১৯৬০ সালে টাইম ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে বছরের সেরা ব্যক্তি শিরোনামে 'মার্কিন বিজ্ঞানী' দলের একজনরূপে তার নামও অন্তর্ভুক্ত হয়।[২৮] ৫০০৬ টেলার নামীয় একটি গ্রহাণুপুঞ্জের নামও তার নামে নামাঙ্কিত হয়।[২৯] ১৯৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক একাডেমী কর্তৃক সিলভেনাজ থায়ের পুরস্কার লাভ করেন।[৩০] আমেরিকান একাডেমী অব আর্টস এন্ড সায়েন্সেস এবং আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি এডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স ও আমেরিকান নিউক্লিয়ার সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সম্মাননার মধ্যে তিনি আলবার্ট আইনস্টাইন পদক, করভিন চেইন, জাতীয় বিজ্ঞান পদক উল্লেখযোগ্য। ২০০৩ সালে মৃত্যুর দুই মাস পূর্বে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ কর্তৃক টেলারকে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম প্রদান করা হয়।
৯৫ বছর বয়সে ৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৩ তারিখে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ডে এই বিখ্যাত পদার্থবিদের মহাপ্রয়াণ ঘটে।[৩১]
পারমাণবিক অস্ত্রের সাথে টেলারের একাগ্রনিষ্ঠতা এবং যেখানে যুদ্ধকালীন সময়ে অনেক সহকর্মীদের অস্ত্র দৌঁড়ে অংশগ্রহণের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা - সেখানে তার আণবিক যুদ্ধপ্রীতির জন্যে খুব সহজেই তিনি একজন উন্মাদ বৈজ্ঞানিকরূপে প্রচার পেয়েছেন। ১৯৯১ সালে প্রবর্তিত ব্যাঙ্গাত্মক নোবেল পুরস্কার বা ইগ নোবেল পুরস্কারের প্রথমটিতেই তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। 'জীবনব্যাপী শান্তির অর্থ পরিবর্তনের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ' তাকে এ পুরস্কারের জন্যে মনোনীত করা হয়। এছাড়াও তিনি ১৯৬৪ সালে স্ট্যানলী কুব্রিকের চলচ্চিত্রের ড. স্ট্রেঞ্জলাভ চরিত্রে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন বলে ব্যাপক গুজব রয়েছে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিদ ইসিদোর ইজাক রাবি একবার বলেছিলেন যে, 'টেলারবিহীন বিশ্বই অধিকতর ভাল অবস্থানে থাকতো।'[৩২]
Religion was not an issue in my family; indeed, it was never discussed. My only religious training came because the Minta required that all students take classes in their respective religions. My family celebrated one holiday, the Day of Atonement, when we all fasted. Yet my father said prayers for his parents on Saturdays and on all the Jewish holidays. The idea of God that I absorbed was that it would be wonderful if He existed: We needed Him desperately but had not seen Him in many thousands of years.
টেলার লিখিত
টেলার সম্বন্ধীয়
টেলার সম্বন্ধীয় অন্যান্য লেখনী