ওয়েডেল সাগর হল দক্ষিণ মহাসাগরের একটি অংশ। এখানে একটি ওয়েডেল চক্র রয়েছে। কোটস ভূমি এবং অ্যান্টার্কটিক উপদ্বীপ দ্বারা গঠিত খাঁড়ি এর সীমানা নির্দেশ করে। এর পূর্বতম বিন্দুটি হল রানী মড ভূমির রাজকুমারী মার্থা উপকূলে অবস্থিত নরভেগিয়া অন্তরীপ। নরভেগিয়া অন্তরীপের পূর্ব দিকে আছে রাজা হাকন সাত সমুদ্র। এই সমুদ্রের বেশিরভাগ দক্ষিণ অংশই বিশাল এবং স্থায়ী হিম স্তর, ফিল্চার-রোন হিম স্তর দ্বারা আবৃত থাকে।
এই সমুদ্রটি, অ্যান্টার্কটিক আঞ্চলিক দাবির দুটি অধিক্রমণশীল ক্ষেত্র, আর্জেন্টিনীয় অ্যান্টার্কটিকা এবং ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক ক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থিত। এটি আংশিকভাবে অ্যান্টার্কটিক চিলীয় ক্ষেত্রের মধ্যেও পড়ে। এই সাগরের প্রশস্ততম মাপ, আড়াআড়িভাবে, ২,০০০ কিলোমিটার (১,২০০ মা), এবং এর বিস্তৃত ক্ষেত্র প্রায় ২.৮ নিযুত বর্গকিলোমিটার (১.১×১০ ৬ মা২)।[১]
ওয়েডেল সাগরে ফিল্চার-রোন হিম স্তর সহ অনেকগুলি হিম স্তর রয়েছে। অ্যান্টার্কটিক উপদ্বীপের পূর্ব দিকে কিছু হিম স্তর ২০০২ সালের মধ্যে পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। আগে সেটি ওয়েডেল সাগরের মোটামুটি ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার (৩,৯০০ মা২) অংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল।[২] বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে কোনও সমুদ্রের তুলনা এই সমুদ্রের জল সবচেয়ে পরিষ্কার। আলফ্রেড ওয়েগনার ইনস্টিটিউটের গবেষকরা, সেকচি চাকতিকে (জলের স্বচ্ছতা পরিমাপ করতে ব্যবহৃত হয়) ১৩ই অক্টোবর ১৯৮৬ তারিখে ৮০ মিটার (২৬০ ফু)গভীরতায় দৃশ্যমান পেয়ে, নির্ধারণ করেন যে এর স্বচ্ছতা পাতিত জলের সমান।
১৯৫০ সালে, ইতিহাসবিদ টমাস আর হেনরি, তাঁর দ্য হোয়াইট কন্টিনেন্ট বইটিতে লিখেছেন: "যারা ওয়েডেল সাগরের তুষারস্তূপে ভরা জলের মধ্য দিয়ে যাত্রা করেছে তাদের সাক্ষ্য অনুসারে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্বাসঘাতক ও ভীতিপ্রদ অঞ্চল। রস সাগর তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ, অনুমানযোগ্য এবং নিরাপদ।"[৩] তিনি পুরো একটি অধ্যায় জুড়ে বলে গেছেন, সমুদ্রের বরফ জলে দেখতে পাওয়া সবুজ কেশী মৎস্যপুরুষদের কাহিনী সম্পর্কে, ১৯৪৯ সাল অবধি নাবিকদের উপকূল পর্যন্ত পথে চলাচল করতে না পারার অক্ষমতা সম্পর্কে, এবং বিশ্বাসঘাতক "আকস্মিক হিমশীতল দমক" সম্পর্কে যেখানে জাহাজগুলির নিরাপত্তা ভাসমান তুষারস্তরের ওপর নির্ভর করত, যেমনটি ঘটেছিল আর্নেস্ট শেকল্টনের এন্ডিওরেন্স, জাহাজের ক্ষেত্রে, যেটি ধাক্কা খেয়ে জলে ডুবে গিয়েছিল।
স্কটিশ নাবিক জেমস ওয়েডেল, যিনি ১৮২৩ সালে সমুদ্রাভিযান শুরু করেছিলেন, তাঁর নামানুসারে সমুদ্রটির নামকরণ করা হয়েছে। মূলত এর নামকরণ হয়েছিল রাজা চতুর্থ জর্জের নামে; ১৯০০ সালে ওয়েডেলের সম্মানে নতুন এর নামকরণ করা হয়।[৪] ১৮২৩ সালে, আমেরিকার বেঞ্জামিন মরেল জমি দেখতে পেয়েছেন বলে দাবি করেছিলেন, সমুদ্রের আসল পূর্ব সীমানা থেকে প্রায় ১০-১২° পূর্বে। তিনি এটিকে নতুন দক্ষিণ গ্রিনল্যান্ড বলেছিলেন। তবে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সমুদ্রকে আরও ভালভাবে অন্বেষণ করা হলে এর অস্তিত্ব অপ্রমাণিত মনে করা হয়েছিল। ওয়েডেল ৭৪ অক্ষাংশ দক্ষিণ পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন; যেটি সেই সময় ছিল দক্ষিণতম অনুপ্রবেশ। তবে ওয়েডেলের পর, আধুনিক যুগের আগে, ১৯০৩ সালে স্কট উইলিয়াম স্পায়ার্স ব্রুস দক্ষিণতম প্রান্তে গিয়েছিলেন।
ওয়েডেল সাগর ক্যাবেলিং (দুই ধরনের জলের উপাদানের মিশ্রণে ঘন তৃতীয় উপাদানের সৃষ্টি) পদ্ধতির মাধ্যমে গভীর জলের ভর গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র, থার্মোহেলাইন প্রবাহ (ঘনত্বের পার্থক্যের জন্য প্রবাহ) এর মূল চালিকা শক্তি। ক্যাবলিংয়ের মাধ্যমে উত্তর আটলান্টিকের গভীর জলেও নতুন উপাদান সৃষ্টি হয়। জলেরর তাপমাত্রা এবং লবণাক্ততার পার্থক্যের কারণে এটি ঘটে। ওয়েডেল সমুদ্রের মধ্যে, এটি সাধারণত লবণ বর্জন এবং বায়ু শীতল দ্বারা ঘটে।
১৮২৩ সালে, ব্রিটিশ নাবিক জেমস ওয়েডেল এই সাগর আবিষ্কার করেছিলেন। ১৯০১-১৯০৪ সালের সুইডিশ অ্যান্টার্কটিক অভিযানের নেতা ছিলেনঅটো নর্ডেন্সকিল্ড। তাঁদের ত্রাণ জাহাজটি বরফ পরিবৃত হয়ে শেষ পর্যন্ত চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। নাবিকেরা কোনক্রমে পলেট দ্বীপ পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন। যেখানে তাঁরা একটি কুঁড়েঘরে শীত কাটিয়েছিলেন। নর্ডেন্সকিল্ড এবং অন্যদের অবশেষে আর্জেন্টাইনীয় নৌবহর উদ্ধার করেছিল।
১৯১৫ সালে, আর্নেস্ট শেকল্টনের জাহাজ, এন্ডিওরেন্স, এই সাগরে বরফে আটকা আটকা পড়ে চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। [৫]
অ্যান্টার্কটিকার অন্যান্য প্রতিবেশী অংশগুলির মতোই ওয়েডেল সাগরের ভূতত্ত্ব দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ অংশের মতই। দক্ষিণ পাতাগোনিয়ায় জুরাসিক বিবর্তনে অ্যান্ডিয়ান পর্বত সৃষ্টির সূচনায় রোকাস ভার্দেস অববাহিকা তৈরি হয়েছিল। এটি একটি পশ্চাদ চাপ অববাহিকা। এর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সম্প্রসারণের ফলে ওয়েডেল সাগরের সৃষ্টি হয়।[৬][৭] উত্তর ক্রিটেসিয়াস যুগে রোকাস ভার্দেস অববাহিকার ভূতাত্ত্বিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে সিনোজোয়িক যুগে, এটি সংকুচিত হয়ে ফোরল্যান্ড অববাহিকায় রূপান্তরিত হয়, যার নাম মেগালেন অববাহিকা।[৬] দক্ষিণ আমেরিকাতে যখন এই ঘটনা ঘটেছে, অববাহিকার ওয়েডেল মুদ্র অংশটি পাতের সংকোচনশীল অবস্থা থেকে রক্ষা পেয়ে একটি মহাসাগরীয় অববাহিকা হিসাবে থেকে যায়।[৭]
ওয়েডেল সাগর বিশ্ব মহাসাগরের এমন একটি স্থান, যেখানে গভীর তলদেশের জলে এমন জলীয় বস্তু গঠিত হয়, যেগুলি থার্মোহেলাইন সংবহন ঘটায়। ভূপৃষ্ঠের জটিল সক্রিয়তা জাত উৎপন্ন জলীয় বস্তুর বৈশিষ্টগুলি, সমুদ্রের হিম প্রক্রিয়ায়, মহীসোপানে সামুদ্রিক গতিশীলতায়, এবং ঢাল ও উপ-হিম স্তর জলের ভর রূপান্তর দ্বারা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়।[৮]
পশ্চিম ওয়েডেল সাগরে সংবহনের তুলনায় উত্তর দিকে প্রবাহিত স্রোত প্রাধান্য পায়। এই উত্তরমুখী স্রোতটি মূলত বায়ুচালিত, ঘূর্ণিঝড় চক্রের পশ্চিম অংশ, যেটি ওয়েডেল চক্র নামে পরিচিত। এই উত্তর প্রবাহটি ওয়েডেল সাগর থেকে জল প্রবাহিত হয়ে যাবার প্রাথমিক শক্তি হিসাবে কাজ করে। তাই এই অঞ্চলটি বিশ্ব মহাসাগরের অবশিষ্ট অংশগুলিতে সমুদ্রের জল পরিবর্তনের একটি প্রধান উৎস। ওয়েডেল চক্র হল ঠান্ডা এবং কম লবণাক্ত পৃষ্ঠ স্তর। [৯]
অ্যান্টার্কটিক উপদ্বীপের সরু এবং লম্বা পর্বতমালার সমান্তরালে শক্তিশালী ভূপৃষ্ঠের বায়ুর প্রাধান্য, পশ্চিম ওয়েডেল সাগর অঞ্চলে আবহাওয়া এবং জলবায়ুর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এই বাতাস নিম্ন অক্ষাংশের দিকে শীতল বাতাস বহন করে নিয়ে যায় এবং আরও উত্তর দিকে গিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমী বায়ুতে পরিণত হয়।
উপদ্বীপের পূর্বাঞ্চলের তাপমাত্রায় প্রভাব ফেলার জন্য যে শুধু এই বায়ুর প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে তা নয়, এই বায়ু বরফকে উত্তর-পূর্ব দিকে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবাহিত করে। অ্যান্টার্কটিক উপদ্বীপের দুই প্রান্তের বাতাস, তাপমাত্রা এবং বরফের অবস্থার মধ্যে তীব্র বৈপরীত্য বহু বছর ধরে সুপরিচিত।[১০]
ওয়েডেল সাগরে প্রচুর তিমি এবং সীল আছে। সমুদ্রের বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রাণীগুলির মধ্যে এখানে দেখা যায় ওয়েডেল সীল এবং ঘাতক তিমি, কুঁজো তিমি, মিনকে তিমি, চিতা সীল, এবং কাঁকড়া ভক্ষক সীল। ওয়েডেল সমুদ্র ভ্রমণ করলে এদের চোখে পড়ে।
কঠোর পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হওয়ার কারণে অ্যাডিলি পেঙ্গুইন হল এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রভাবশালী পেঙ্গুইন প্রজাতি। প্রায় ১০০,০০০ জোড়া অ্যাডিলি পেঙ্গুইন আগ্নেয় পলেট দ্বীপে দেখতে পাওয়া যায়।
১৯৯৭ সাল নাগাদ, সম্রাট পেঙ্গুইনের একটি উপনিবেশটি ওয়েডেল সাগরের স্নোহিল দ্বীপের ঠিক দক্ষিণে আবিষ্কার করা হয়েছিল। ওয়েডেল সাগর প্রায়শই ভারী বরফ স্তর দ্বারা আবদ্ধ থাকায় হিমস্তর ভাঙার বিশেষ জাহাজে হেলিকপ্টার নিয়ে এই উপনিবেশে পৌঁছানোর প্রয়োজন হয়।[৫]
সম্প্রতি গবেষকেরা অ্যান্টার্কটিকার বরফে ঢাকা এই ওয়েডেল সাগরে মাছের বিশাল আবাসস্থলের সন্ধান পেয়েছেন। এই আবাসে প্রায় ছয় কোটি মাছের বাস। গবেষকেরা একে ইউরোপের দেশ মাল্টার (৩১৬ বর্গকিলোমিটার) প্রায় সমান বলছেন।[১১]
টীকা
গ্রন্থপঞ্জী