কাঠমান্ডু দরবার ক্ষেত্র সাবেক কাঠমান্ডু রাজ্যের রাজকীয় বাসভবনের প্লাজা। এটি কাঠমান্ডু উপত্যকায় অবস্থিত তিনটি দরবার ক্ষেত্রের একটি। এই তিনটি দরবার ক্ষেত্রই ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।
কাঠমান্ডু দরবার ক্ষেত্রের চারপাশে দর্শনীয় স্থাপতত্যিক নিদর্শন ছিল। কয়েক শতাব্দীকাল ধরে নির্মিত নেওয়ার শিল্পীদের শিল্প কর্ম এই স্থাপত্যকর্মগুলোতে শোভা পাচ্ছিল। এই দরবার ক্ষেত্রের বেশ কয়েকটি দালান ২০১৫-এর_নেপাল_ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[১] রাজকীয় ভবনটি মূলত আগে দত্তরয়া ক্ষেত্রে অবস্থিত ছিল, পরে এটিকে দরবার ক্ষেত্রে স্থানান্তরিত করা হয়।[২]
কাঠমান্ড দরবার ক্ষেত্রে মল্ল ও শাহ রাজাদের প্রাসাদ ছিল। এছাড়া এই ক্ষেত্রে বেশ কিছু চতুর্ভুজাকৃতির উঠোন এবং মন্দির রয়েছে। এটি হনুমান ধোকা দরবার ক্ষেত্র নামেও পরিচিত, নামটি হনুমান-এর মূর্তি থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। ক্ষেত্রের প্রবেশের পথে এই হনুমান মূর্তিটি অবস্থিত।
রাজা প্রতাপ মল্ল-এর সময় কাঠমান্ডু দরবার ক্ষেত্র ব্যাপকভাবে নির্মিত হয়। রাজা প্রতাপ মল্ল ছিলেন ধার্মিক ও পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি শিল্পের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। তিনি নিজেকে কভিন্দ্র বলতেন, এর অর্থ কবিদের রাজা। এছাড়া তিনি পনেরোটি ভাষা জানায় নিজেকে নিয়ে গর্ব করতেন। প্রতাপ মল্ল স্থাপনা নির্মাণের প্রতিও আগ্রহী ছিলেন, একারণে রাজা হিসেবে অভিষেকের পরেই তিনি তার প্রাসাদের সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেন। পুরনো অনেক মন্দিরের সংস্কার করেনে এবং নতুন অনেক মন্দির, মঠ ও স্তুপা নির্মাণ করেন।
রাজা প্রতাপ তার প্রাসাদ নির্মাণের সময় নেওয়ারি রীতিতে একটি ছোট প্রবেশ পথ নির্মাণ করেন। প্রবেশ পথের দরজাটি বিভিন্ন কারুকার্যমন্ডিত ছিল। তাতে বিভিন্ন দেবতার প্রতিমা স্থান পেয়েছিল। দরজাটি পরবর্তিতে মোহান চকে স্থানান্তরিত হয়। এর সামনে একটি হনুমানের মূর্তি স্থাপিত হয়, কারণ ভাবা হয়েছিল হনুমান রাজার সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করবে এবং তার আবাসকে রক্ষা করবে। এই প্রবেশ পথ দিয়ে নাসাই চকে যাওয়া যেত, নাসাই চকে সবধরনের রাজকীয় অনুষ্ঠান, পরিবেশনা ইত্যাদি হত। এই নাসাই চক দীর্ঘদিন পর্যন্ত রাজকীয় উঠোন ছিল। ধারণা করা হয় এই উঠোনের নিচে অনেক সম্পত্তি ছিল। সেসময় রাজা প্রতাম সুন্দরী চক নামেও একটি উঠোন নির্মাণ করেন। এখানে তিনি প্রস্তরখন্ডে পনেরোটি ভাষায় লিখিত খন্ড স্থাপন করেন। রাজা প্রতাপ কেবল তার ঐশ্বর্য প্রকাশের জন্যই এত স্থাপনা নির্মাণ করেননি, তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল দেব-দেবীর প্রতি আরাধনা। তিনি নতুন মন্দির নির্মাণে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন, এছাড়া পুরনো অনেক মন্দিরকে সম্প্রসারিত করেন ও সংস্কার করেন। প্রাসাদের পাশেই তিনি একটি কৃষ্ণ মন্দির নির্মাণ করেন ১৬৪৯ সালে, যার নাম ভামসাগোপালা। এই মন্দিরটি তিনি তার দুই স্ত্রীকে উৎসর্গ করেন, একজন রুপমতি এবং অন্যজন রাজামতি। এই দুইজনেই একই বছরে মারা যান। এছাড়া মোহান চকে রাজা তিন ছাদের সমন্বয়ে আগামাছেম মন্দির এবং একটি বড় ছাদবিশিষ্ট মন্দির নির্মাণ করেন। মূল চককে তিনি সম্পূর্ণরূপে সংস্কার করেন এবং সেখানে তালেজু মন্দিরের উন্নয়নে অর্থ ব্যয় করেন। ১৬৭০ সালে তালেজু মন্দিরের জন্য তিনি বেশ কয়েকটি ধাতুর দরজা নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। তার দাদার তৈরি দেগুতালে মন্দিরকে পুনরায় নির্মাণ করেন।
১৬৭৪ সালে রাজা প্রতাপ মল্ল মারা যাওয়ার পরে দরবার ক্ষেত্র উন্নয়নের গুরুত্ব কমে যায়। তার উত্তরাধীকারীগণ ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় এবং সেসময়কার মন্ত্রীগণ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তাদের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর শিল্প ও সংস্কৃতির উপর গুরুত্ব হ্রাস পায়। রাজার মৃত্যুর পরের এই তিন দশকে সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ধারা ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে। এসময় শহরে অল্প কয়েকটি স্থাপনা নির্মিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থিভেন্দ্র মল্ল নির্মিত দাসাভাতারা মন্দির, যা ভগবান ভিষ্ণুকে উৎসর্গ করে নির্মিত। পরবর্তিতে গারুদার একটি বিশালাকার মূর্তি এর সামনে স্থাপিত হয়। এছাড়া পার্থিভেন্দ্র মল্ল তার পরিবারের ছবিসহ একটি স্তম্ভ তালেজু মন্দিরের সামনে নির্মাণ করেন। ১৬৯২ সালে রাজা প্রতাপ মল্লের বিপত্নীক স্ত্রী রাণী রাধিলাসমি ভগবান শিভাকে উৎসর্গ করে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। এটি মাজু দেভাল নামে পরিচিত এবং দরবার ক্ষেত্রের গারুদা মূর্তিটির পাশে অবস্থিত। মন্দিরটি নয়টি প্ল্যাটফর্মের উপর অবস্থিত এবং এটি দরবারের অন্যতম শীর্ষ স্থাপনা।