গরুর গাড়ি হল দুই চাকাবিশিষ্ট গরু বা বলদে টানা একপ্রকার যান বিশেষ। এই যানে সাধারণত একটি মাত্র অক্ষের সাথে চাকা দুটি যুক্ত থাকে। সামনের দিকে একটি জোয়ালের সাথে দুটি গরু বা বলদ জুড়ে এই গাড়ি টানা হয়। সাধারণত চালক বসেন গাড়ির সামনের দিকে। তাঁর পিছনে বসেন যাত্রীরা। বিভিন্ন মালপত্র বহন করা হয় তারও পিছনের দিকে। বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য ও ফসল বহনের কাজে গরুর গাড়ির প্রচলন যথেষ্টই ব্যাপক। গ্রাম বাংলায় ঐতিহ্যগতভাবে গরুর গাড়ি কিছুদিন আগে পর্যন্তও যাতায়াত ও মালবহনের কাজে প্রভূত পরিমানে ব্যবহৃত হত। তবে বর্তমানে নানাধরনের মোটরচালিত যানের আধিক্যর কারণে অপেক্ষাকৃত ধীর গতির এই যানটির ব্যবহার অনেক কমে এসেছে। তবে গ্রামের দিকে কাঁচা রাস্তায় এখনো মাল টানার ক্ষেত্রে এ গাড়ি ব্যবহার করা হয়।
গরুর গাড়ির ইতিহাস সুপ্রাচীন। নব্যপ্রস্তর যুগের সময় থেকেই মানুষ এই যানটি ব্যবহার করে আসছে। ফ্রান্সের ফঁতান অঞ্চলে আল্পস পর্বতের উপত্যকায় একটি গুহায় গরুর গাড়ির যে ছবি পাওয়া যায়, তার থেকে জানতে পারা যায় খ্রিস্টের জন্মের ৩১০০ বছর আগে ব্রোঞ্জ যুগেও গরুর গাড়ির অস্তিত্ব ছিল।[১] হরপ্পা সভ্যতাতেও যে গরুর গাড়ির অস্তিত্ব ছিল তার সপক্ষে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখানেও নানা অঞ্চল থেকে এক অক্ষ বিশিষ্ট চাকাওলা নানা খেলনা পাওয়া গেছে। এগুলি থেকে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, খ্রিস্টজন্মের ১৬০০ থেকে ১৫০০ বছর আগেই সিন্ধু অববাহিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল, যা সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে দক্ষিণেও ছড়িয়ে পড়ে।void setup
গরুর গাড়িতে গরু জুড়তে সাধারণত জোয়াল ব্যবহার করা হয়, ঘোড়ার গাড়ির মতো লাগাম ব্যবহার করা হয় না। গাড়ির চাকাগুলি হয় বড় বড়, সাধারণত কাঠের তৈরি। তবে এখন তাতে প্রায়শই লোহার রিম ব্যবহার করা হয়। সম্পূর্ণ লোহার তৈরি চাকার ব্যবহারও খুব বিরল নয়। যাত্রীদের রোদ ও বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য গাড়ির উপর অনেকসময়েই ছই'এর প্রচলনও আছে। গাড়ির পাটাতনটি সাধারণত বাঁশ বা কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। ছইটি হয় সাধারণত বেতের বোনা। কখনও কখনও তা বাঁশ ও খড় দিয়েও তৈরি করা হয়ে থাকে।
সভ্যতার প্রায় উন্মেষকাল থেকেই গরুর গাড়ি এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার প্রায় সর্বত্রই ছিল যাতায়াত ও পরিবহনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ যান। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপে পরে দ্রুতগামী ঘোড়ায় টানা গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবহন ও যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে গরুর গাড়ির ব্যবহার কমে আসে। পরবর্তীকালে যন্ত্রচালিত লাঙল বা পাওয়ার টিলার এবং নানাবিধ যন্ত্রযানের উদ্ভবের ফলে এখন ঐ অঞ্চলে গরুর গাড়ির ঐতিহ্য কেবলমাত্র টিকে রয়েছে নানারকম লোকসংস্কৃতি ও তাকে ভিত্তি করে নানা মেলা-অনুষ্ঠানে।
আবার আফ্রিকার বহু জায়গায় প্রবল জঙ্গলাকীর্ণ ভূমিরূপের কারণে সেখানে পথঘাট যেকোনও রকম গাড়ি চালনারই অনুপযুক্ত ছিল। তাই এইসব জায়গার মানুষদের মধ্যে গরুর গাড়ি সংক্রান্ত কোনও ধারণার প্রচলনই ছিল না। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় যখন ওলন্দাজ ঔপনিবেশিকরা প্রবেশ করতে থাকে, বহুক্ষেত্রেই তারা বাহন হিসেবে গরুর গাড়িকে ব্যবহার করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন জনপ্রিয় উপন্যাসেও তাই আমরা দক্ষিণ আফ্রিকায় যাতায়াত ও মালবহনের উপায় হিসেবে গরুর গাড়ির উল্লেখ দেখতে পাই। উদাহরণস্বরূপ আমরা এক্ষেত্রে এইচ. রাইডার হ্যাগার্ড'এর বিখ্যাত উপন্যাস কিং সলোমনস মাইনস 'এর উল্লেখ করতে পারি। এক্ষেত্রে তারা গরুর গাড়ির আরেকটি ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলে। রাত্রিতে বিশ্রাম নেওয়ার সময় বা বিপদে পড়লে তারা প্রায়শই গরুর গাড়িগুলোকে গোল করে সাজিয়ে একধরনের দুর্গ গড়ে তুলে তার মধ্যে আশ্রয় নিত। গরুর বা ঘোড়ার গাড়িকে ব্যবহার করে এইধরনের দুর্গ গড়ে তোলার রেওয়াজ অবশ্য আমরা এর অনেক আগে থেকেই দেখতে পাই। চেঙ্গিজ খানের নাতি বাতু খানের নেতৃত্বে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে যে মোঙ্গল আক্রমণ চলে সেখানে তার প্রতিরোধে স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা গরুর গাড়ির এই ধরনের ব্যবহারের কথা আমরা জানতে পারি। বিশেষ করে কালকার যুদ্ধে কিয়েভ রুশেরা এই ধরনের গাড়িনির্মিত চলমান দুর্গ তৈরি করে মঙ্গোল আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।[২]
পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়ার বহু অংশে গ্রামীণ অঞ্চলে মূলত মাল পরিবহনের কাজে গরুর গাড়ির ব্যবহার এখনও প্রচলিত আছে।এক সময় গ্রামে গরুর গাড়িই ছিল প্রধান বাহন।