গোলকোন্ডা দুর্গ | |
---|---|
![]() | |
সাধারণ তথ্যাবলী | |
দেশ | ভারত |
স্থানাঙ্ক | ১৭°২৩′ উত্তর ৭৮°২৪′ পূর্ব / ১৭.৩৮° উত্তর ৭৮.৪০° পূর্ব |
সম্পূর্ণ | ১৬০০ |
গোলকোন্ডা দুর্গ ভারতের হায়দারাবাদে অবস্থিত একটি প্রাচীন দুর্গ। কুতুবশাহী সম্রাজ্যের (১৫১২-১৬৮৭) রাজধানী হিসেবে এটি বিখ্যাত। ভৌগোলিকভাবে এটি ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের অন্তর্গত। পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ব এবং ইতিহাসের আধার হিসেবে গোলকোন্ডা দুর্গ ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা তালিকায় স্থান পেয়েছে।[১] ২০১০ সালে ভারতের পক্ষ থেকে এটিকে প্রস্তাব করা হয় বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্থান দেয়ার জন্য।[২]
গোলকোন্ডা হিরকখনির জন্য বিখ্যাত। আশেপাশে হিরক খনি থাকার কারণে গোলকোন্ডা দ্রুত একটি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হয়। বড় আকারের হিরকগুলি গোলকোন্ডা ডায়মন্ড নামে পরিচিত। গোলকোন্ডা দুর্গের ভল্টেই আরো অনেক হিরকখন্ডের সাথে বিখ্যাত নুরহাজান একসময় জমা রাখা ছিলো।[৩]
কাকাটিয়া শাসনামলে (Kakatiya Dynasty) এই দুর্গটি তৈরি হয়েছিলো কোন্ডাপাল্লি দুর্গের (Kondapalli Fort) পশ্চিমভাগের রক্ষণভাগের জন্যে। রাজা কৃষ্ঞদেব পাহাড়ের শীর্ষে এটি তৈরী করেন। তার উত্তরসূরী কন্যা রুদ্রমা দেবী এবং প্রপৌত্র প্রতাপরুদ্রের হাতে এর পুননির্মান এবং শক্তিশালীকরন হয়।[৪][৫] দুর্গ এবং এর ভেতরকার শহর গ্রানাইট পাহাড়ের ওপর তৈরি হয়েছিলো যা উচ্চতায় ১২০ মিটার (৪৮০ ফিট)। ১৩৬৩ সালের এক চুক্তি অনুযায়ী এটি বাহমানি শাসকদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়।[৬] ১৪৯৫-১৪৯৬ সালের দিকে এটি জায়গীর হিসেবে দেয়া হয় কুলী কুতুব শাহকে।
মুলত বাহমানি সালতানাতের অধীনে গোলকোন্ডা ধীরে ধীরে খ্যাতি লাভ করেছিল। বাহমানিরা মাটির দুর্গকে গ্রানাইট পাথর দিয়ে সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে।[৭] বাহমানিদের প্রতিনিধি হিসেবে গোলকান্দায় রাজ্যপাল সুলতান কুলী কুতুব-উল-মুলক (১৪৮৭-১৫৪৩) শহরটিকে তাঁর সরকারের কেন্দ্র হিসাবে ১৫০১-এর দিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এক সময় বাহমানি শাসন দুর্বল হয়ে যায় এবং সুলতান কুলি স্বতন্ত্র শাসনব্যবস্থা চালু করেন।[৮] ১৫৩৮ সালে গোলকান্দায় কুতুব শাহী রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়।[৯] ৬২ বছর ধরে মাটির কেল্লাটি প্রথম তিনজন কুতুব শাহী সুলতানদের দ্বারা বর্তমান কাঠামোতে প্রসারিত হয়েছিল, যা গ্রানাইটের এক বিশাল দুর্গ হিসেবে হিসাবে প্রায় ৪ কিলোমিটার (৩.১ মাইল) পরিধি নিয়ে বিস্তৃত ছিল। হায়দরাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পরে ১৫৯০ অবধি এটি কুতুব শাহী রাজবংশের রাজধানী ছিল। এই দুর্গেই ১৫৯০ সাল পর্যন্ত হায়দ্রাবাদে স্থানান্তরিত হওয়ার আগে তাঁদের রাজধানী ছিলো। দুর্গটি ১৬৮৭ সালে পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয় এবং যখন মুঘল শাসক আওরঙ্গজেব হায়দ্রাবাদ দখল করেন তখন দুর্গটি মুঘল অধীনে চলে আসে।[১০]
গোলকোন্ডা দুর্গ কমপ্লেক্স আসলে চারটি দুর্গের সমস্টি যা চতুর্দিকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পেরিসিমার দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেয়ালের প্রতেকটি ভাজ এবং কোনা খুব মজবুত করে তৈরী করা। প্রবেশের জন্য আটটি গেট এবং চারটি স্থানান্তরযোগ্য ব্রিজ আছে।বালা হিসার গেট হচ্ছে প্রধান প্রবেশপথ। এটি পূর্ব দিকে অবস্থিত। ভিতরে আছে রাজকীয় আবাসন এবং দরবার হল, মন্দির, মসজিদ, অস্ত্রাগার, ইত্যাদি। একদম নিচে আছে সর্ববহিস্থ দেয়াল যা দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত ফাতেহ দরজা দিয়ে অতিক্রম করতে হয়। ফাতেহ দরজা অর্থ বিজয়ের দরজা (Victory gate)। সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সৈন্যবাহিনী বিজয়ীর বেশে এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছিলো। বড় লোহার স্পাইক দ্বারা গেট অলংকৃত। কথিত আছে যে দরবার হল থেকে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি প্রাসাদ পর্যন্ত গোপন সুড়ঙ্গ বিদ্যমান। চারমিনারের দিকেও একটি সুড়ংগ আছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
দুর্গের ভেতরের তিনটি মসজিদ হচ্ছে তারামতি মসজিদ, ইব্রাহীম মসজিদ এবং হীরাখানা মসজিদ। কুতুবশাহী সুলতানের রগজাও আছে। বহি:দেয়ালের থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।দুর্গের বাহিরের দিকে দুটো আলাদা প্যাভিলিয়ন দর্শনার্থীদের মনেযোগ আকর্ষণ করে। ভিতরে আরো ছিলো আশলাহ খানা, বন্দিশালা, হাবশি কামান, উটের আস্তাবল, নাগিনা বাগ, আম্বরখানা ইত্যাদি। পাশাপাশি কারখানাও ছিলো। সমসাময়িক প্রকৌশলবিদ্যার প্রয়োগ দেখা যায়। বিভিন্ন বিন্যাস এমনভাবে করা হয়েছে যাতে ঠান্ডা বিশুদ্ধ বাতাস দুর্গের বিভিন্ন অংশে প্রবাহিত হয়। উত্তম জল সরবরাহ ব্যবস্থা ছিলো।
দুর্গের ভিতরে ঢুকলে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত বিভিন্ন প্যাভিলিয়ন, দরজা, প্রবেশপথ এবং গম্ভুজের সৌন্দর্যে বিমোহিত হতে হয়। যদিও প্রায় চারশো বছর আগে ঘ্রান ছড়ানো বাগানগুলো এখন অনেকটাই ম্লান। বালা হিসার কেন্দ্রিভূত ধরনের খিলানে সমৃদ্ধ। মোড়ানো ধরনের নকশা বর্ডার টানা। স্প্যান্ড্রেলসগুলিতে ইয়ালিস নামে হিন্দু পুরানের বিভিন্ন চিত্র এবং গোলাকার অলংকরন বসানো আছে। দরজার উপরের অংশে খিলানময় কুলুঙ্গির প্রান্তভাগ জুড়ে পেখম ছড়ানো ময়ুরের নকশা। নিচে গ্রানাইট ব্লক লিন্টেলের গায়েও একই ধরনের গোলাকার সজ্জার কারুকাজ। ময়ুরএবং সিংহের কারুকাজ হিন্দু স্থাপত্যের পরিচয় বহন করে।
দুর্গের মধ্যে কুতুবশাহী সুলতানের রগজা অবস্থিত। পুরো এলাকাটা মনোহর বাগান এবং সৃদৃশ্য বড় পাথরে ঘেরা। মসজিদ ও রওজার স্থাপত্য শৈলীতে ইসলামিক রীতির প্রকাশ ঘটেছে। স্তাপত্য সৌন্দর্য এখন হারিয়ে যাচ্ছে।