চিত্রকার

১৯৪৭ সালে পৃথ্বী মান চিত্রকার কর্তৃক রচিত বৌদ্ধ দেবী সবুজ তারার চিত্রকর্ম
বিষ্ণু মণ্ডল প্রদর্শিত পৌভা চিত্র (১৫শ শতক)

চিত্রকার (দেবনাগরী: चित्रकार) নেপালের কাঠমান্ডু উপত্যকার নেওয়ার সম্প্রদায়ের একটি জাতি। নেওয়ারদের পেশা অনুসারে বিভক্ত বর্ণ ব্যবস্থানুসারে চিত্রকারেরা ছিলেন মূলত চিত্রশিল্পী এবং মুখোশ প্রস্তুতকারক।[] নেপাল ভাষায় এই গোত্রের মানুষকে "পুন্" (पुं)[] বা "পুনা" বলা হয়।[] সংস্কৃত ভাষায় চিত্রকার শব্দের আক্ষরিক অর্থ চিত্র নির্মাতা যেখানে সংস্কৃতে "চিত্র" হলো ছবি এবং "অকার" অর্থ নির্মাতা।

ঐতিহ্যবাহী পেশা

[সম্পাদনা]

চিত্রকার বা পুনেরা মন্দির, প্রার্থনা কক্ষ এবং মুরালগুলিতে ব্যবহারের জন্য পৌভা নামক শিল্পকর্ম, ধর্মীয় নৃত্যের জন্য ব্যবহৃত মুখোশ এবং ধর্মীয় উৎসবের সময় ব্যবহৃত চিনামাটিতে আঁকা ও কাঠের ব্লক প্রিন্ট তৈরি করে থাকে।[] প্রাচীন কাল থেকে শ্রমের বিভাজন অনুসারে এই কাজের দায়িত্ব বাবা থেকে পুত্রের হাতে সমর্পিত হয়ে আসছে। শৈল্পিক উদ্যোগে, মহিলারা সাধারণত গৌণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

জাতিগতভাবে, অন্যান্য নেওয়ার সম্প্রদায়ের মতো চিত্রকররা বিভিন্ন ইন্দো-আর্য এবং তিব্বত-বর্মণ উপজাতিসহ বিচিত্র উৎস থেকে জাত। এ কারণে সহজে ধারণা করা যেতে পারে যে, চিত্রকররা স্বজাতীয় বা জাতিগতভাবে সমজাতীয় গোষ্ঠীর চেয়ে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর। কাঠমান্ডুতে এই বর্ণপ্রথাটি ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হলেও, এখনও কিছু পুন বা চিত্রকর পরিবার শিল্পী হিসাবে তাদের ঐতিহ্যবাহী ভূমিকা অনুসরণ করে চলেছে। এই পুন বা চিত্রকারেরা তান্ত্রিকতায় বিশ্বাসী এবং এরা বৌদ্ধহিন্দু উভয় ধর্মই অনুশীলন করে থাকেন।

চিত্রশিল্পী চিত্রকরদের নিয়ে ফরাসি পণ্ডিত জেরার্ড টফিনের রচনায়, তিনি তাদের দুটি প্রধান গুঠিতে (গুথি এবং দেশলা গুঠি দেখুন) ভাগ করেছেন যেখানে আত্মীয়তা এবং বিবাহের ধরন এবং অবশ্যই তাদের শিল্পকে কেন্দ্র করেছেন। বলা যায়, যা কখনও কখনও ঔষধ হিসাবেও কাজ করে। টফিন বর্ণনা করেছেন যে তারা জওয়ানাকাইয়ের সাথে কীভাবে আচরণ করে, যা ধারণা করা হয় যে, তারা সাপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এজন্য তিনি তার ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের পাশে দুটি সিংহ আঁকেন।

"পুন" শব্দটি পালি অথবা সংস্কৃত শব্দ "পুয়ন্ত্র", "পট্টা", "পট" বা "কাপড়" থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। "পৌভা" নামে পরিচিত ধর্মীয় চিত্রটিও "পুরাণ" বা "পট্টা" থেকে এসেছে। এই চিত্রগুলো সাধারণত কাপড় বা সুতি কাপড়ের উপর প্রাণীজ আঠা এবং কাদামাটি দিয়ে তৈরি করা হয়ে থাকে।

উল্লেখযোগ্য চিত্রকার

[সম্পাদনা]
  • জয়তেজা পুন (আনুমানিক ১৫শ শতাব্দীর প্রথমাংশ): সে এই চিত্রকর্মটি পেশ করায় ১৪২০ খ্রিষ্টাব্দের বিষ্ণু মন্ডালায় উৎসর্গকৃত শিলালিপিতে তাঁর উল্লেখ রয়েছে।
  • আদায়রাজ পুন এবং উদয়রাম পুন (আনুমানিক ১৫শ শতাব্দীর শেষাংশে): দুই স্ত্রীকে নিয়ে দোলখার এক উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা গগনসিংহের বিখ্যাত চিত্রটি আঁকেন।
  • ইন্দ্ররাজ চিত্রকার এবং জগিদেব চিত্রকার (আনুমানিক ১৭শ শতাব্দী): ১৭ শতকের মডেল-বইয়ে (থায়াসফু) তার কথা উল্লেখিত হয়েছিল।
  • রাজ মান সিংহ চিত্রকার (১৭৯৭): নেপালে জলরঙের চিত্রকলার পরিচিতি ঘটান, ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত শিল্পী ব্রায়ান হাউটন হজসনের সরকারী।
  • ভাজু মন চিত্রকার: শিল্পী বা দরবারের চিত্রশিল্পী, প্রধানমন্ত্রী জঙ্গ বাহাদুর রানার সাথে ১৮৫০ সালে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে ভ্রমণ করেন।[] []
  • দীর্ঘ মান চিত্রকার: দরবারের আলোকচিত্রী যেটি প্রথম নেপালি আলোকচিত্রীদের অন্যতম, তিনি সেই আলোকচিত্রটির জন্য বড় ফরম্যাটের ক্যামেরা এবং ভেজা প্লেট ব্যবহার করেছিলেন। ১৯০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শমসেরের সাথে ইংল্যান্ডে গমন করেন।[]
  • গণেশ মান চিত্রকার: ফটোগ্রাফার, নেপালের প্রথম বায়বীয় চিত্র তিনি তুলেন।[]
  • কাজী কৃষ্ণ লাল চিত্রকারর: রাজা ত্রিভুবন বীর বিক্রম শাহের পক্ষে কাজ করেন এবং কাজীর পদ অর্জন করেন, যা তৎকালীন সর্বোচ্চ নাগরিক র‌্যাঙ্কিংয়ের অন্যতম ছিল।
  • তেজ বাহাদুর চিত্রকার (১৮৯৮-১৯৭১): বিখ্যাত চিত্রশিল্পী, যুধ আর্ট স্কুলের প্রধান, 'চিত্রকলা উদ্যোগ সংঘ' (বর্তমানে অবরুদ্ধ) এর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শমসের জঙ্গ বাহাদুর রানা ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় শিল্প থেকে আধুনিক পাশ্চাত্য ধাঁচের শিল্পকলার মাধ্যমে নেপালি শিল্পের পরিবর্তন আনার জন্য কলকাতার সরকারী আর্ট স্কুলে তার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছিলেন।[] [১০]
  • অমর চিত্রকার: শিল্পী, রাজকীয় নেপাল একাডেমির জীবন সদস্য, তাঁর চিত্রকর্মগুলি জাদুঘর এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে।
  • দিল বাহাদুর চিত্রকর: শিল্পী।
  • মনোহরমন পুন (মনোহরমন চিত্রকর) (১৯১৪-১৯৯০): শিল্পী।
  • মদন চিত্রকর: শিল্পী, শিল্প লেখক।
  • সুজন চিত্রকর : কাঠমান্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পী, শিল্প লেখক, বিএফএ প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর, কাঠমান্ডূ বিশ্ববিদ্যালয়, আর্ট স্কুল, সেন্টার অবস আর্ট অ্যান্ড ডিজাইনের কোঅর্ডিনেটর।
  • প্রেম মান চিত্রকার: তিনি ছিলেন নেপালি পৌভা শিল্পী, কবি ও লেখক।

সংস্থা

[সম্পাদনা]
  • চিত্রকার সমাজ / চিত্রকার সমিতি
  • চিত্রকার সোসাইটি অ্যান্ড হিমালেশিয়া ফাউন্ডেশন

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. The Newar Caste System According to Hierarchical Position (Gurung, 2000:39)
  2. von der Heide, Susanne (ডিসেম্বর ১৯৯৭)। "The Past in the Present: Cultural Development in the Kathmandu Valley and the Significance of the Chitrakars as Painters" (পিডিএফ)Changing Faces of Nepal - The Glory of Asia's PastRatna Pustak Bhandar for the UNESCO Division of Cultural Heritage and HimalAsia। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জুন ২০১২ 
  3. P.Pal, Art of Nepal: A Catalogue of the Los Angeles County Museum of Art Collection, University of California Press
  4. Chitrakar, Madan (২০১২)। "Paubha Art"। Nepali Art। Teba-Chi Studies Centre। পৃষ্ঠা 35–52। আইএসবিএন 978-9937-2-4933-1 
  5. Chitrakar, Madan। "Bhaju Man Chitrakar (1817 – 1874C)"Praxis। ৩ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ নভেম্বর ২০১৩ 
  6. Newar, Naresh (১–৭ অক্টোবর ২০০৪)। "Giving their art and soul: The Chitrakars have dominated Nepal's art scene for three centuries"Nepali Times। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জুন ২০১২ 
  7. Newar, Naresh (১–৭ অক্টোবর ২০০৪)। "Giving their art and soul: The Chitrakars have dominated Nepal's art scene for three centuries"Nepali Times। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জুন ২০১২ 
  8. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ নভেম্বর ২০২০ 
  9. Chitrakar, Madan (2004), Tej Bahadur Chitrakar: Icon of a Transition, Kathmandu: Teba-Chi (TBC) Studies Centre. আইএসবিএন ৯৯৯৩৩৮৭৯৭-৫.
  10. Bajracharya, Saroj (সেপ্টেম্বর–অক্টোবর ২০০৯)। "The Post-Modern Tendency in Nepali Contemporary Art"Spaces। ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জুন ২০১২ 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]