চৌম্বক বিচ্যুতি, বা চৌম্বক অবস্থান্তর হল অনুভূমিক তলে চৌম্বক উত্তর (চৌম্বক কম্পাসের উত্তর মেরু নির্দেশক কাঁটা যেদিক দেখায়, এটি পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের বলরেখার সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ) এবং প্রকৃত উত্তরের (একটি দ্রাঘিমা বরাবর ভৌগোলিক উত্তর মেরুর দিকে দিশা) মধ্যে কোণ। পৃথিবী পৃষ্ঠের ওপর অবস্থান এবং সময়ের সাথে সাথে এই কোণটির পরিবর্তন হয়।
কিছুটা আনুষ্ঠানিকভাবে, বোডিচ অবস্থান্তরকে "যে কোনও স্থানে চৌম্বকীয় এবং ভৌগোলিক দ্রাঘিমাগুলির মধ্যে কোণ, যেটি পূর্ব বা পশ্চিম এবং ডিগ্রি ও মিনিটের আকারে প্রকাশ করা হয়, প্রকৃত উত্তর থেকে চৌম্বকীয় উত্তরের দিশা নির্দেশ করতে। চৌম্বক এবং গ্রিড দ্রাঘিমার মধ্যে কোণকে গ্রিড চৌম্বক কোণ, গ্রিডের অবস্থান্তর বলা হয়।”[১]
প্রচলিত রীতি অনুসারে, চৌম্বক উত্তরদিকটি যখন প্রকৃত উত্তরের পূর্বদিকে থাকে তখন বিচ্যুতিটি ধনাত্মক হয়, এবং পশ্চিমদিকে থাকলে বিচ্যুতি ঋণাত্মক হয়। পৃথিবী পৃষ্ঠের ওপর সমোচ্চ রেখাগুলি বরাবর বিচ্যুতির মান অপরিবর্তনীয় থাকে, এবং যে রেখা বরাবর বিচ্যুতির মান শূন্য হয় তাকে অ্যাজোনিক রেখা বলা হয়। চৌম্বক বিচ্যুতির প্রতীক হিসাবে ছোট হাতের গ্রিক অক্ষর δ (ডেল্টা) ব্যবহৃত হয়।
অনেক সময়েই চৌম্বক বিচ্যুতির অনুরূপ অর্থে চৌম্বক বিচলন শব্দটি ব্যবহৃত হয়, তবে আরও সঠিকভাবে বিচলন হল কাছের কোন ধাতব বস্তুর উপস্থিতির ফলে কোনও কম্পাসের পাঠের ত্রুটি। জাহাজে বা বিমানে লোহা থাকলে এই ত্রুটি ঘটতে পারে।
চৌম্বক বিচ্যুতি ও চৌম্বক বিনতির মধ্যে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। বিনতি কোণ হল অনুভূমিক তলের নীচের দিকের সাথে ভূচৌম্বকীয় ক্ষেত্র রেখার কোণ।
চৌম্বক বিচ্যুতি স্থানের এবং সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, যখন কোনও ভ্রমণকারী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল ভ্রমণ করে, মেইনে বিচ্যুতির পরিমান ১৬ ডিগ্রি পশ্চিম থেকে ফ্লোরিডায় ৬ ডিগ্রি, তার থেকে লুইজিয়ানায় শূন্য ডিগ্রি এবং সেখান থেকে টেক্সাসে ৪ ডিগ্রি পূর্বে। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে এই বিচ্যুতি এক ডিগ্রি পশ্চিমে ছিল (২০১৪), ২০২০ এর শুরুর দিকে হয়ে গেছে শূন্য ডিগ্রি। [২][৩]
বেশিরভাগ অঞ্চলে, স্থানিক পার্থক্য থেকে আসলে পৃথিবীর গভীরে প্রবাহের পরিবর্তনশীলতা প্রতিফলিত হয়; কিছু অঞ্চলে পৃথিবীর ভূত্বকে আকরিক লোহা বা ম্যাগনেটাইটের ভাণ্ডার থাকার ফলে বিচ্যুতি ঘটে। একইভাবে, যুগব্যাপী এই প্রবাহে পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর একই বিন্দুতে ক্ষেত্রের শক্তি এবং দিকের ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘটে।
কোন অঞ্চলের চৌম্বক বিচ্যুতি (সম্ভবত) সময়ের সাথে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে পারে, সম্ভবত প্রতি কয়েকশত বছরে ২–২.৫ ডিগ্রি, অঞ্চলটি চৌম্বক মেরু থেকে কতটা দূরে তার উপর এটি নির্ভর করে। আইভুজিভিকের মত অঞ্চল, যেটি মেরুর কাছাকাছি অবস্থিত, তার বিচ্যুতি প্রতি তিন বছরে ১ ডিগ্রি হতে পারে। এটি বেশিরভাগ ভ্রমণকারীদের কাছে তুচ্ছ হতে পারে, তবে নির্ভুলভাবে পুরানো বর্ণনাচিত্র থেকে চৌম্বক নির্দেশনাগুলি ব্যবহার করলে অথবা স্থানগুলির পরিমাপ এবং সীমানা (দিকনির্দেশ) বোঝার জন্য পুরানো কাজগুলির প্রয়োজন হলে এটি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
সময়ের সাথে কীভাবে অবস্থান পরিবর্তিত হয় তার উদাহরণ হিসাবে, নীচে একই অঞ্চলের (লং আইল্যান্ড সাউন্ডের পশ্চিম প্রান্ত) দুটি বর্ণনাচিত্র দেখুন, ১২৪ বছরের তফাতে সমীক্ষা করা হয়েছে। ১৮৮৪ সালের চিত্রে ৮ ডিগ্রি, ২০ মিনিট পশ্চিমের তারতম্য দেখায়। ২০০৮ সালের চিত্রে দেখা যাচ্ছে ১৩ ডিগ্রি, ১৫ মিনিট পশ্চিমের তারতম্য।
যে কোনও নির্দিষ্ট স্থানে চৌম্বক বিচ্যুতি সরাসরি আকাশস্থ মেরুর প্রসঙ্গ দিয়ে মাপা যায়—গগনমণ্ডলের যেসব বিন্দুর চারদিকে তারাগুলি আবর্তিত হয়, সেগুলি প্রকৃত উত্তর এবং প্রকৃত দক্ষিণ দিক চিহ্নিত করে। এই পরিমাপটি সম্পাদন করতে ব্যবহৃত সরঞ্জামটি কে বিচ্যুতি মাপক বলা হয়।
আকাশস্থ উত্তর মেরুর আনুমানিক অবস্থান নির্দেশ করে দেয় ধ্রুবতারা (উত্তর তারা)। উত্তর গোলার্ধে, চৌম্বক বিয়ারিং এবং ধ্রুবতারায় একটি চাক্ষুষ বিয়ারিংয়ের মধ্যে পার্থক্যকে বিচ্যুতি হিসাবে নির্ধারণ করা যেতে পারে। ধ্রুবতারা বর্তমানে উত্তর আকাশস্থ মেরুর চারপাশে ০.৭৩° ব্যাসার্ধের একটি বৃত্তকে ঘিরে আবর্তিত হয়। সুতরাং এই প্রযুক্তিটি এক ডিগ্রির মধ্যে নির্ভুল। উচ্চ অক্ষাংশে দিগন্তের কাছাকাছি কোনও প্রসঙ্গ বস্তুর সাপেক্ষে ধ্রুবতারাকে দেখার জন্য প্লামেট বা ওলনদড়ি সহায়ক, যেখান থেকে এর বিয়ারিং নেওয়া যেতে পারে।[৪]