মিয়া তানসেন (১৫০৬ - ১৫৮৯) প্রায় সকল বিশেষজ্ঞের ধারণা মতে উত্তর ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ। বর্তমানে আমরা যে হিন্দুস্তানী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সাথে পরিচিত তার মূল স্রষ্টা হলেন এই তানসেন। তার এই সৃষ্টি যন্ত্র সঙ্গীতের এক অনবদ্য অবদান। বহু প্রাচীনকালে সৃষ্টি হলেও এখন পর্যন্ত এর প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে। তার কর্ম এবং বংশীয় উত্তরাধিকারীদের মাধ্যমেই মূলত এই ধারাটি আজও টিকে রয়েছে। তিনি মুঘল বাদশাহ আকবরের রাজদরবারের নবরত্নের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাকে সঙ্গীত সম্রাট নামে ডাকা হয়।
তানসেন ভারতের গোয়ালিয়রে এক হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মুকুন্দ সেন ছিলেন একজন কবি। ছোটবেলায় তার নাম ছিল তনু সেন[১]। তার বাবা মূলত বিহাটের বাসিন্দা ছিলেন। ছেলের জন্মে তিনি অতি আনন্দিত হন এবং এই জন্মের পিছনে সাধু গাউসের আশীর্বাদ রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন। ছেলের নাম রাখেন রামতনু । ছোটবেলা থেকেই তানসেন সঙ্গীত শিক্ষা করতে শুরু করেন। এই শিক্ষায় তার গুরু ছিলেন বৃন্দাবনের তৎকালীন বিখ্যাত সঙ্গীত শিক্ষক হরিদাস স্বামী। মাত্র ১০ বছর বয়সে তার মেধার ক্ষমতা প্রকাশিত হয়। তার মেধা দেখে স্বামীজি বিস্মিত হন এবং তার বাবাকে বলে নিজের সাথে বৃন্দাবন নিয়ে যান। এই বৃন্দাবনেই তানসেনের মূল ভিত রচিত হয়। বিভিন্ন রাগের সুষ্ঠু চর্চার মাধ্যমে তিনি বিখ্যাত পণ্ডিত শিল্পীতে পরিণত হন। অনেক বিখ্যাত হওয়ার পরও তাই তিনি সময় পেলেই বৃন্দাবন আসতেন।
বৃন্দাবন থেকে বীহাটে ফিরে তানসেন শিব মন্দিরে সঙ্গীত সাধনা শুরু করেন। লোকমুখে বলতে শোনা যায়, তার সঙ্গীতে মন্দিরের দেয়াল আন্দোলিত হত। স্থানীয়রা পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, তানসনের সঙ্গীতের কারণেই মন্দিরটি এক দিকে একটু হেলে পড়েছে। তানসেন সম্বন্ধে আরও কিছু অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন : বৃক্ষ ও পাথরকে আন্দোলিত করা, নিজ থেকেই বাতি জ্বালানো এবং যখন বৃষ্টির কোনো চিহ্নই নেই তখন বৃষ্টি আনয়ন। বাবা-মার মৃত্যুর পর তিনি হযরত গাউসের নিকট আসেন।তিনি একই সাথে তানসেনের সাঙ্গীতিক ও আধ্যাত্মীক গুরু ছিলেন।তবে তানসেন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন কি না তা নির্ভরযোগ্য ভাবে জানা যায় না।এর পক্ষে ও বিপক্ষে দুইদিকেই প্রচুর মত পাওয়া যায়। যাই হোক, শিক্ষা শেষে তিনি রেওয়ার বান্ধবগড়ের রাজা রামচন্দ্রের রাজকীয় আদালতে সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে যোগ দেন। এরপর তিনি মুঘল বাদশাহ আকবরের রাজ দরবারে নবরত্নের একজন হিসেবে সঙ্গীতের সাধনা শুরু করেন। তানসেনের দুজন স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের খবর পাওয়া যায়।সন্তানদের নাম: হামির সেন,সুরাট সেন,বিলাস খান,তান্সান্স খান,সরস্বতী দেবী।
গোয়ালিয়রের মহান সুফি সাধক শেখ মুহাম্মদ গাউসের সমাধি কমপ্লেক্সেই মিয়া তানসেনে সমাধি রচিত হয়েছিল। এখনও এটি বিদ্যমান রয়েছে[২]। শেখ মুহাম্মদ গাউস ষোড়শ শতাব্দীর অন্যতম সুফী দরবেশ ও ফকির ছিলেন। সকল ধর্ম বিশ্বাসের লোকের কাছে তিনি স্বনামধন্য ছিলেন। গাউস এবং তানসেনের দুইটি সমাধি পাশাপাশি রয়েছে। এছাড়াও এই সমাধি সৌধে অন্যান্য কবর রয়েছে। প্রথাগত মুঘল স্টাইলে এই কমপ্লেক্সটি তৈরি করা হয়েছে। সমাধি ক্ষেত্রটি একটি বিশাল বর্গাকার মাঠের মত যার কেন্দ্র রয়েছে ষড়ভূজ আকৃতির কিছু স্তম্ভ। সমাধি সৌধের দালানগুলোর দেয়ালের মধ্যে পাথর কেটে নকশা করা হয়েছে। দেয়ালের একেক অংশে নকশা একেক রকম। পুরো দালানের উপর বিস্তৃত অংশ জুড়ে একটি বৃহৎ মিনার রয়েছে যা একসময় নীল রঙা টাইল্স দ্বারা আবৃত ছিল। সাধু গাউসের সমাধির ডান পাশে তানসেনের সমাধি অবস্থিত। সমাধিটি একটি বর্ধিত আয়তাকার কাঠামোর উপর অবস্থিত। কাঠামোটি মার্বেল পাথর দ্বারা নির্মিত। এর চারদিকে ছাঁইচবিশিষ্ট (eaves) প্যাভিলিয়ন রয়েছে যা বিভিন্ন নকশায় সুশোভিত।