দ্রৌপদী | |
---|---|
পঞ্চকন্যা গোষ্ঠীর সদস্য | |
অন্যান্য নাম |
|
দেবনাগরী | द्रौपदी |
অন্তর্ভুক্তি | |
গ্রন্থসমূহ | |
লিঙ্গ | নারী |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
জন্ম | |
মৃত্যু | |
মাতাপিতা |
|
সহোদর |
|
দম্পত্য সঙ্গী | পাণ্ডবগণ |
সন্তান | পুত্র
|
রাজবংশ | কুরুবংশ বিবাহসূত্রে |
দ্রৌপদী (দেবনাগরী: द्रौपदी) হলেন হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র । তিনি পঞ্চপাণ্ডবের সহধর্মিনী। তিনি দ্রুপদের কন্যা বলে তার নাম দ্রৌপদী। তিনি পাঞ্চালী ও যাজ্ঞসেনী নামেও পরিচিতা। মহাভারতে দ্রৌপদী অনিন্দ্য সুন্দরী ও তার সময়ের শ্রেষ্ঠ নারী রূপে চিত্রিত হয়েছেন। তিনি তার ধর্মশীলতা, সাহসিকতা ও বহুপতিত্বের জন্য পরিচিত।
রাজশেখর বসু তার মহাভারতের বাংলা সারানুবাদের ভূমিকাতে দ্রৌপদী সম্পর্কে লিখেছিলেন-
প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে অন্য কোনো নারী তার তুল্য জীবন্ত রূপে চিত্রিত হননি।[১]
রাজশেখর বসু তার সারানুবাদের ভূমিকাংশে আরও লিখেছিলেন-
দ্রৌপদী অবলা নন, জয়দ্রথ ও কীচককে ধাক্কা দিয়ে ভূমিশায়ী করেছিলেন। তিনি অসহিষ্ণু তেজস্বিনী স্পষ্টবাদিনী, তীক্ষ্ণ বাক্যে নিষ্ক্রিয় পুরুষদের উত্তেজিত করতে পারেন। তার বাগ্মিতার পরিচয় অনেক স্থানে পাওয়া যায়।[২]
মহাভারতে দ্রৌপদী এবং তার ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন পাঞ্চালের রাজা দ্রুপদ কর্তৃক আয়োজিত একটি যজ্ঞ থেকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অর্জুন স্বয়ংবরসভায় লক্ষ্যভেদ করার প্রতিযোগিতায় তাঁকে জয় করেছিলেন কিন্তু তার শাশুড়ি কুন্তী ভুলবশত পঞ্চপাণ্ডবের সাথে তার বাগদান করে দেন এবং তিনি পঞ্চপাণ্ডবকে বিবাহ করেন। পরবর্তীতে তিনি রাজচক্রবর্তী সম্রাট যুধিষ্ঠিরের সম্রাজ্ঞী রূপে রাজসূয় যজ্ঞে অংশগ্রহণ করেন। তিনি পঞ্চপাণ্ডবের ঔরসে পাঁচ পুত্র লাভ করেন । পাণ্ডবদের এই পাঁচপুত্রকে একত্রে বলা হয় উপপাণ্ডব।[৩] দ্রৌপদীর জীবনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল হস্তিনাপুরে পাশা খেলা। দুর্যোধন কর্তৃক আয়োজিত পাশা খেলায় যুধিষ্ঠির তার রাজ্য, সম্পত্তি, এমনকি স্ত্রী দ্রৌপদীকেও হারান। প্রতিহিংসাপরায়ণ কৌরব ভ্রাতৃগণ এবং সঙ্গে কর্ণও কুরুসভায় দ্রৌপদীকে অপমান করেন। দুঃশাসন হস্তিনাপুরের পূর্ণ রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের চেষ্টা করেন কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপে দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষার্থে শত শত বস্ত্র আবির্ভূত হয়। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের অপচেষ্টা ও তাতে দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষার্থে বস্ত্রের আবির্ভাব মহাভারতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা গুলোর একটি। এই ঘটনা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বীজ বপন করেছিল। পরবর্তীতে পাশা খেলার পণের কারণে দ্রৌপদী এবং পাণ্ডবরা ১২ বছরের বনবাস এবং ১ বছরের অজ্ঞাতবাস সহ মোট ১৩ বছরের জন্য নির্বাসিত হন। নির্বাসন কালীন দ্রৌপদী নানা সংঘর্ষের সম্মুখীন হন। অজ্ঞাতবাস শেষ হওয়ার পর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আরম্ভ হয়। পরিশেষে সব সংঘর্ষ অতিক্রম করে সম্রাজ্ঞী রূপে তিনি প্রতিষ্ঠিত হন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরে, তিনি সম্রাজ্ঞী রূপে ৩৬ বছর দায়িত্ব পালন করেন।[ক] তারপর তিনি তার স্বামী পাণ্ডবদের সাথে মহাপ্রস্থানে যান এবং হিমালয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন।[৪] দ্রৌপদী তার শাশুড়ি কুন্তীর মত প্রাতঃস্মরণীয় পঞ্চকন্যার অন্যতমা।[৫] তাছাড়া তিনি তার শাশুড়ি কুন্তীকে শ্রদ্ধাও করতেন। দ্রৌপদীর জীবনগাঁথা বিভিন্ন শিল্পকলা, অভিনয় এবং বিভিন্ন সাহিত্যে একটি অনুপ্রেরণা।[৬] হিন্দুধর্মে, তাঁকে পঞ্চকন্যা বা পাঁচ কুমারী নারীর সতীত্বের একজন শ্রেষ্ঠপ্রমাণ রূপে গণ্য করা হয় যাঁদের নাম পাঠ করলে পাপ দূর হয় বলে বিশ্বাস করা হয়।[৭] ভারত উপমহাদেশের কিছু অঞ্চলে, কিছু সম্প্রদায় বিদ্যমান যারা দ্রৌপদীকে দেবী রূপে পূজা করে ।[৮]
পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ ও দ্রোণাচার্য বন্ধু এবং সতীর্থ ছিলেন। পূর্বের বন্ধুত্ব স্মরণ করে দ্রুপদের কাছে দ্রোণাচার্য স্ত্রী ও পুত্রসহ গেলে দ্রুপদ তাকে অপমানিত করেন। রাজা হওয়ার অহংকারে দ্রুপদ মূলত এমন করেছিলেন। দ্রোণাচার্য যখন কুরুবংশের রাজকুমারদের শিক্ষা দেওয়া সমাপ্ত করেন তখন তিনি গুরুদক্ষিণা চান যে শিষ্যরা যেন দক্ষিণা রূপে তার কাছে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের পরাজয় এনে দেয়। মূলত এ পূর্বের অপমানের প্রতিশোধ ছিল। দ্রোণাচার্যের পক্ষে তার শিষ্য অর্জুন পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে পরাজিত করেছিলেন । দ্রোণ দ্রুপদকে অর্ধরাজ্যের শাসনভার দিয়ে পুনরায় মিত্রতা স্থাপনে আগ্রহী হন কিন্তু দ্রুপদ এই অপমান ভুলতে পারেননি । এজন্য তিনি দ্রোণবধ করতে সক্ষম এমন পুত্রলাভের জন্য উপযাজ মুনির শরণাপন্ন হলে তিনি তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা ঋষি যাজের কাছে নিয়ে যান । যাজ ও উপযাজ ঋষির সাহায্যে যজ্ঞ করে তিনি দ্রোণবধে সক্ষম পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকে লাভ করেন এবং সেই একই যজ্ঞবেদী থেকে দ্রৌপদীর জন্ম হয়।[১৪] দ্রুপদের কন্যা বলে তার নাম হয় দ্রৌপদী । তার জন্মের পর আকাশবাণী হয় তার থেকে কুরুবংশ ধ্বংস হবে[১৫] পরবর্তীতে কৌরবরা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের চেষ্টা করে যে অপরাধ করে তারই ফলস্বরূপ তারা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ধ্বংস হয় এবং আকাশবাণী সত্য প্রমাণিত হয়।
মহাভারতের আদিপর্বের অন্তর্গত চৈত্ররথপর্বাধ্যায়ের ১৬৬তম অধ্যায়ে মূলত দ্রৌপদীর দৈহিক গঠনের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে-
যার অর্থ : তখন যজ্ঞবেদী থেকে এক কুমারীও উৎপন্ন হলেন যিনি পাঞ্চালী নামে পরিচিতা হলেন । তিনি সৌভাগ্যশালিনী, সুদর্শনা এবং সুন্দর কৃষ্ণ আয়তাকার চক্ষুযুক্তা । তিনি শ্যামাঙ্গী, পদ্মপলাশাক্ষী, কুঞ্চিত বা কোঁকড়ানো ঘনকালো কেশবতী, তাম্রবর্ণ নখ, সুন্দর ভ্রূ এবং সুন্দর ও স্থূল স্তনের অধিকারিণী। তিনি মানুষের শরীরে সাক্ষাৎ দেবী। তার নীলপদ্মের ন্যায় অঙ্গসৌরভ একক্রোশ দূরেও অনুভূত হয় । তিনি পরম সুন্দর রুপধারিণী এবং তার কোনো তুলনা হয় না। এই দেবরূপিনী কন্যা দেব, দানব ও যক্ষেরও আকাঙ্ক্ষিত ।
যদিও দ্রুপদ অর্জুন কর্তৃক পরাস্ত হয়েছিলেন তবুও অর্জুনকেই জামাতারূপে পাওয়ার ইচ্ছা রাখতেন। তাই তিনি এক ভীষণ কঠিন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন যাতে অর্জুন তার ধনুর্বিদ্যায় দক্ষতা দেখিয়ে দ্রৌপদীকে জয় করতে পারেন। দ্রুপদ এমন ধনু নির্মাণ করান যা নোয়ানো দুঃসাধ্য। এরপর শূন্যে একটি যন্ত্র স্থাপন করে তাতে লক্ষ্যবস্তুটি রাখলেন।[১৭][১৮] যন্ত্রের ছিদ্র দিয়ে বাণ চালিয়ে লক্ষ্য বিদ্ধ করতে হবে প্রতিযোগীদের।[১৯] দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভায় ভারতবর্ষের অনেক রাজা আর রাজকুমার এলেন। দুর্যোধন ও অন্য ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ, কর্ণ, শকুনি, অশ্বত্থামা, ভগদত্ত, কলিঙ্গের রাজা, মদ্ররাজ শল্য, সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ, শিশুপাল, জরাসন্ধ ও আরও অনেক রাজা।[২০][২১] দ্বারকা থেকে কৃষ্ণ, বলরাম, প্রদ্যুম্ন প্রভৃতিও এলেন।[২২][২৩] আগত রাজাদের যথাযথ সেবার ব্যবস্থা করলেন দ্রুপদ। নগরের উত্তর-পূর্ব দিকে সমতলভূমিতে স্বয়ংবরের জন্য বিশাল সভা নির্মিত হলো।[২৪][২৫] এই সভায় দ্রৌপদীর ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্ন ঘোষণা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করছিলেন।[২৬] যে লক্ষ্যভেদ করতে পারবে সে দ্রৌপদীকে লাভ করবে এমনটা ঘোষণা দিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন।[২৭] স্বয়ংবরসভায় শিশুপাল ধনু তুলতে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলেন। জরাসন্ধ ও মদ্ররাজ শল্যও অক্ষম হলেন। কেউই ধনু ওঠাতে পারলেন না। কর্ণ সেই ধনু তুলতে অসমর্থ হলেন। ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশী অর্জুন অনায়াসে ধনুতে গুণ পরিয়ে লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে লাভ করেন। লক্ষ্য বিদ্ধ হয়েছে দেখে এবং অর্জুনকে নিরীক্ষণ করে দ্রৌপদী হাস্য না করেও যেন হাসতে লাগলেন।[২৮] এরপর দ্রৌপদী অর্জুনকে সর্বসমক্ষে বরমাল্য পরিয়ে দিলেন।[২৯]
অর্জুন ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে ছিলেন বলে অন্যরা তাকে ব্রাহ্মণই ভাবলেন। ক্ষত্রিয়রা থাকতে ব্রাহ্মণ প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে যাবে এ কথা অন্য রাজারা মানতে পারলেন না। তারা ক্রুদ্ধ হয়ে আক্রমণ করতে এলেন। রাজাদের আক্রমণ করতে দেখে ভীম একটি গাছ উপড়ে নিয়ে অর্জুনের পাশে দাঁড়ালেন। অর্জুনও ধনুর্বাণ নিয়ে প্রস্তুত রইলেন। এরপর অর্জুন কর্ণকে পরাজিত করলেন।[৩০][৩১] ভীম শল্যকে পরাজিত করলেন। কৃষ্ণের অনুনয়ে সকলে শান্ত হলেন।
অর্জুনকে বিজয়ী দেখে যুধিষ্ঠির, নকুল আর সহদেব পূর্বেই চলে গিয়েছিলেন। পরে দ্রৌপদীকে নিয়ে ভীম আর অর্জুন এলেন। তারা যে কুম্ভকারের কর্মশালায় আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে এসে ভীম আর অর্জুন আনন্দের সাথে জানালেন যে, তারা ভিক্ষা এনেছেন। কুন্তী না দেখেই বললেন, সকলে মিলে ভোগ কর। মূলত কুন্তী ভেবেছিলেন যে তারা হয়তো ভিক্ষার দ্বারা কিছু সামগ্রী পেয়েছে। তাই তিনি লব্ধবস্তু সকলকেই ভোগ করতে বললেন। কিন্তু পরে দেখলেন যে তাদের সাথে দ্রৌপদী। এতে তার বোধোদয় হলো। কুন্তী তাই বললেন, আমি অন্যায় কথা বলে ফেলেছি। যুধিষ্ঠির সব শুনে বললেন যে, অর্জুন তুমি দ্রৌপদীকে জয় করেছ তাই তুমি তাকে বিবাহ কর। অর্জুন সম্মত হলেন না। কারণ কুন্তী ভুল করে পাঁচ ভাইয়ের সাথেই দ্রৌপদীর বাগদান করে দিয়েছেন। মূলত মহাভারতের যুগে পণ, প্রতিজ্ঞা, মুখের কথা ইত্যাদিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতো। মহাভারতে বহুস্থানে এমন ঘটনা উদ্ধৃত হয়েছে। যেমন: ভীষ্ম তেমন উপযুক্ত কারণ ছাড়াই পিতা শান্তনুর সাথে সত্যবতীর বিবাহের জন্য সিংহাসনের উত্তরাধিকার ছেড়েছিলেন। [৩২] যেকোনোভাবে প্রতিজ্ঞারক্ষা করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। এ ঘটনার পর যুধিষ্ঠির দ্রুপদের কাছে এসে বললেন, দ্রৌপদী তাদের পাঁচ ভাইয়েরই পত্নী হবেন। দ্রুপদ বললেন, এক পুরুষের বহু স্ত্রী হতে পারে কিন্তু এক স্ত্রীর বহু পতি শোনা যায় না। তখন যুধিষ্ঠির বহুপতিত্বের কিছু উদাহরণ দিলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, পুরাণে শুনেছি গৌতমবংশীয়া জটিলা সাতজন ঋষিকে বিবাহ করেছিলেন। প্রাচীনকালে এক মুনিকন্যাও দশজন ভাইকে একত্রে বিবাহ করেছিলেন। ব্যাস ঋষিও যুধিষ্ঠিরের কথার সমর্থন দিয়েছিলেন। ঋষি বেদব্যাস দ্রুপদকে বলেছিলেন যে, যুধিষ্ঠির যা বলেছেন তাই সনাতন ধর্ম, যদিও সকলের পক্ষে নয়। অর্থাৎ তিনি এই পরিস্থিতিতে শুধু দ্রৌপদীর বহুবিবাহকে অনুমোদন দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি আপদ্ধর্মের ব্যাপারে বলেছেন যে ধর্ম আপদের সময় পালন করা হয় কিন্তু সাধারণ পরিস্থিতে এমন কাজ করা উচিত নয়। পরবর্তীতে ব্রহ্মর্ষি ব্যাসের পৌরোহিত্যে পঞ্চপাণ্ডবের সাথে দ্রৌপদীর বিবাহ সম্পন্ন হয়।
কিন্তু দ্রৌপদীর এরূপ বিবাহ নির্দিষ্ট নিয়মে বাঁধা ছিল। বিশৃঙ্খলা যাতে না হয় তাই স্বামীরা নিজের ইচ্ছানুযায়ী দ্রৌপদীর কাছে যেতে পারতেন না। দ্রৌপদী একেকজনের গৃহে একেক বৎসর বাস করতেন।[৩৩] এভাবে এক বছর করে তিনি প্রত্যেকের নিকট থাকতেন। নিয়ম ছিল এ সময় অন্য কোনো ভ্রাতা যদি তাদের দেখেন তবে তাকে সন্ন্যাসী হয়ে বারো বৎসর বনবাস যাপন করতে হবে।[৩৪] দ্রৌপদী পতিব্রতা ছিলেন এবং বিবাহের পর সর্বদাই নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতেন। স্বামীরা স্নান-ভোজন অথবা শয়ন না করলে তিনিও তা করতেন না।[খ][৩৫][৩৬] তারা অন্য স্থান থেকে এলে তিনি আসন ও জল দিয়ে প্রথমে তাদের অভ্যর্থনা করতেন।[গ][৩৭][৩৮] তিনি রন্ধন-ভোজনের পাত্র ও গৃহ সর্বদাই পরিষ্কার রাখতেন এবং যথা সময়ে রন্ধন করতেন।[৩৯][৪০] স্বামীরা যা আহার বা পান করতেন না দ্রৌপদীও তা করতেন না।[৪১][৪২] বনপর্বে তিনি সত্যভামাকে বলেছিলেন যে, এসব কারণেই তিনি স্বামীদের প্রিয় পত্নী। দ্রৌপদী সত্যভামাকে আরও বলেছিলেন যে, ধনবান, রূপবান, অলঙ্কারধারী, যুবক, দেবতা, মানুষ বা গন্ধর্ব অন্য কোনো পুরুষকে তিনি কামনা করেন না।[ঘ][৪৩][৪৪]
অর্জুন দ্রৌপদীর প্রথম অনুরাগের পাত্র।[৪৫] কারণ অর্জুনের সঙ্গেই প্রথম দ্রৌপদীর বিবাহ হওয়ার কথা ছিল। দৈবক্রমে তাকে পাঁচ পাণ্ডবকেই বিবাহ করতে হয়েছিল। নিয়মানুযায়ী দ্রৌপদীর কক্ষে যুধিষ্ঠির বাস করছিলেন। সেই কক্ষেই অর্জুনের অস্ত্র ছিল। বাধ্য হয়েই অর্জুন দ্রৌপদীর কক্ষে প্রবেশ করেন। কারণ গোধন চুরি হয়েছিল আর তা রক্ষা করতে অর্জুনের তার অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল। এজন্য উপায় না দেখে তিনি দ্রৌপদীর কক্ষে যান এবং নিজের অস্ত্র নিয়ে চুরি হওয়া গরু উদ্ধার করতে যান। পরে চুরি হওয়া গরু নিয়ে তিনি ফিরে আসেন এবং নিয়মানুযায়ী বনবাসে যান। কারণ এ নিয়ম পূর্বেই করা হয়েছিল যে দ্রৌপদীর সঙ্গে বসবাসের নির্ধারিত এক বৎসর যে স্বামীর জন্য নির্ধারিত তিনি ছাড়া অন্য কোনো স্বামী তার কক্ষে প্রবেশ করলে তাকে বার বৎসরের জন্য বনবাসে গিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। বিশৃঙ্খলা এড়াতে তারা সকলেই এ নিয়ম কঠোরভাবে পালন করতেন। তাই অর্জুন এ নিয়মের ব্যতিক্রম না করে বনবাসে যান।
অর্জুন বনবাস শেষে দ্বারকায় সুভদ্রাকে বিবাহ করেন। অর্জুন সুভদ্রাকে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে আসেন এবং অর্জুনের অন্য পত্নীর আগমনে দ্রৌপদী ক্রুদ্ধ হন। তখন সুভদ্রা দ্রৌপদীর কাছে যান। তিনি দ্রৌপদীকে প্রণাম করে বলেন যে আমি আপনার দাসী। [৪৬][৪৭]সুভদ্রার মিষ্টবাক্যে তুষ্ট হয়ে দ্রৌপদী তাকে আলিঙ্গন করেন। দ্রৌপদীর ক্রোধ শান্ত হয়। ইন্দ্রপ্রস্থে বসবাসকালীন দ্রৌপদী আর সুভদ্রার সুসম্পর্ক অক্ষুণ্ন ছিল। বনবাস থেকে ফিরে আসার পর দ্রৌপদীর গর্ভে অর্জুনের সন্তান শ্রুতকর্মা জন্মগ্রহণ করে।[৪৮]
শকুনি ও দুর্যোধন বারণাবতে অগ্নিদগ্ধ করে পাণ্ডবদের হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। তারপরও পাণ্ডবরা জীবিত ছিল এবং স্বয়ংবরে অর্জুন দ্রৌপদীকে জয় করাতেও দুর্যোধনাদি অসন্তুষ্ট ছিল।[৪৯] দ্রৌপদীকে বিবাহ করে পাণ্ডবগণ আবার হস্তিনাপুরে ফিরে আসেন। তখন সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে পুরাতন সমস্যা আবার প্রকট হয়। এরপর ধৃতরাষ্ট্র কুরুরাজ্যকে বিভাজন করে খাণ্ডবপ্রস্থসমেত অর্ধ রাজ্য পাণ্ডবদের দেন। দ্রৌপদীকে নিয়ে পাণ্ডবগণ এ জনমানবহীন অঞ্চলে আসেন। এখানেই তারা তাদের নতুন সমৃদ্ধ নগরী স্থাপন করেন যা ইন্দ্রপ্রস্থ নামে পরিচিত হয়। দ্রৌপদী তার পঞ্চস্বামীর সাথে এখানেই বাস করতে লাগলেন।
ইন্দ্রপ্রস্থে প্রতিষ্ঠালাভের পর যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের পরামর্শে রাজসূয় যজ্ঞ করতে উদ্যোগী হন। পাণ্ডবরা সে উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষব্যাপী দিগ্বিজয় করতে থাকেন। ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চল এতে যুধিষ্ঠিরের পদানত হয়।[৫০] এরপর যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করে চক্রবর্তী(সার্বভৌম) সম্রাট হন। দ্রৌপদী হন তার সম্রাজ্ঞী। রাজসূয় যজ্ঞে আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতেন দ্রৌপদী। তিনি প্রতিদিন অভুক্ত থেকে দেখতেন সকলের আহারাদি সমাপ্ত হয়েছে কিনা।[৫১] সম্রাজ্ঞী রূপে দ্রৌপদী অত্যন্ত ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করতেন। তার ব্যস্তজীবনের বর্ণনা মহাভারতের বনপর্বে সত্যভামার সাথে তার কথোপকথন থেকে জানা যায়।[৫২] দ্রৌপদী সকলের আগে জাগতেন কিন্তু সকলের শেষে নিদ্রা যেতেন।[৫৩][৫৪] তিনি অন্তঃপুর পরিচালনা করতেন এবং প্রাসাদের সব ভৃত্য বা দাসদাসী কি করে সে সব সংবাদ রাখতেন; এমনকি প্রাসাদের গোপালক-মেষপালক পর্যন্ত সকলের সংবাদ জানতেন।[৫৫][৫৬] পাণ্ডবগণ সমস্ত পোষ্যবর্গের ভার দ্রৌপদীকে দিয়ে অন্য কার্য করতে পারতেন।[৫৭][৫৮] সাম্রাজ্যের সকল আয়-ব্যয় সম্পর্কে একমাত্র দ্রৌপদী জানতেন।[৫৯][৬০] রাজকোষাগারের সমস্ত বিষয় তিনি জানতেন।[৬১] দ্রৌপদী সবকিছু ত্যাগ করে নিজের কর্তব্যের ভার বহন করতেন।[৬২][৬৩] তাই তার কাছে দিবারাত্রও সমান মনে হতো।[৬৪]
ইন্দ্রপ্রস্থতে অধিকার লাভের পর পাণ্ডবরা দিগবিজয় করেন । এর পর যুধিষ্ঠির কৃষ্ণ এর পরামর্শমত রাজসূয় যজ্ঞ শুরু করেন এবং সকল রাজাকে নিমন্ত্রণ করেন । দুর্যোধনও সেই যজ্ঞে গিয়েছিলেন । তিনি পাণ্ডব্দের ঐশ্বর্য দেখে ঈর্ষাগ্রস্ত হন । একদিন তিনি মায়াসভায় ঘুরছিলেন এমন সময় স্ফটিকময় স্থানে জল আছে মনে করে পরিধেয় বস্ত্র টেনে তুললেন, পরে ভ্রম বুঝতে পেরে লজ্জায় বিষণ্ণ হলেন । আর এক স্থানে পদ্মশোভিত সরোবর ছিল, স্ফটিক নির্মিত মনে করে চলতে গিয়ে তিনি তাতে পড়ে গেলেন । ভৃত্যরা হেসে তাকে অন্য বস্ত্র এনে দিল । তিনি বস্ত্র পরিবর্তন করে এলে ভীমার্জুন প্রভৃতিও হাসলেন, দুর্যোধন ক্রোধে তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন না । অন্য এক স্থানে তিনি দ্বার আছে মনে করে স্ফটিকময় প্রাচীরের ভিতর দিয়ে যাবার সময় মাথায় আঘাত পেলেন । আর এক স্থানে কপাট আছে ভেবে ঠেলতে গিয়ে সম্মুখে পড়ে গেলেন এবং অন্যত্র দ্বার খোলা থাকলেও বদ্ধ আছে ভেবে ফিরে এলেন । এইরূপ নানা প্রকারে বিড়ম্বিত হয়ে তিনি অপ্রসন্ন মনে হস্তিনাপুরে ফিরে এলেন ।[৬৫]
পাণ্ডবদের সমৃদ্ধি দেখে অসন্তোষ নিয়ে দুর্যোধন হস্তিনাপুরে ফিরে এল। ঈর্ষান্বিত দুর্যোধন পাণ্ডবদের সাম্রাজ্যের এত সমৃদ্ধি কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। শকুনি দুর্যোধনকে জানাল যে দ্যূতক্রীড়া বা পাশা খেলার মাধ্যমে সে পাণ্ডবদের সাম্রাজ্য জয় করতে পারে। যুদ্ধে তাদের সাম্রাজ্য জয় করা দুঃসাধ্য। আর শকুনি পাশা খেলায় সুদক্ষ। এরপর পিতা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে দুর্যোধন তার হতাশার কারণ ব্যক্ত করল। তারপর দ্যূতক্রীড়া বা পাশা খেলার আয়োজন করার বিষয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে সম্মত করাল। ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে পাঠালেন পাণ্ডবদের এ দ্যূতসভায় নিমন্ত্রণ করতে। ধৃতরাষ্ট্র ডেকেছেন শুনে ও ধৃতরাষ্ট্রের সম্মানে যুধিষ্ঠির দ্যূতসভায় আসতে সম্মত হলেন; পাশা খেলার ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল না। এরপর যুধিষ্ঠির তার ভ্রাতা ও দ্রৌপদীকে নিয়ে হস্তিনাপুরে দ্যূতক্রীড়ার জন্য এলেন।
শকুনি পাশা খেলায় নিপুণ। সে ধীরে ধীরে যুধিষ্ঠিরের সবকিছু জয় করতে লাগল। যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় তার সব সম্পত্তি পণ রেখে তা হেরে গেলেন। শকুনি কপট দ্যূতক্রীড়ায় সব জয় করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির শকুনির ষড়যন্ত্রে প্রথমে তার ভ্রাতা নকুলকে হারলেন। এরপর একে একে সহদেব, অর্জুন ও ভীমকেও হেরে গেলেন। যুধিষ্ঠির নিজেকে পণ রেখে নিজের স্বাধীনতাও হারালেন। এরপর শকুনির কথায় যুধিষ্ঠিরকে পত্নী দ্রৌপদীকেও পণ রাখতে হলো। এতে ভীষ্ম, দ্রোণ, মহামন্ত্রী বিদুর সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। যুধিষ্ঠির এবার দ্রৌপদীকেও হারলেন। দুর্যোধন আনন্দিত হয়ে দ্রৌপদীকে দাসী রূপে সভায় আনার আদেশ দিলেন। দুর্যোধন তার অনুচর প্রাতিকামীকে আদেশ দিল যেন সে দ্রৌপদীকে সভায় নিয়ে আসে। প্রাতিকামী গিয়ে দ্রৌপদীকে এ সমাচার দিল। কিন্তু দ্রৌপদী সভায় আসতে অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি জানতে চাইলেন যে যুধিষ্ঠির প্রথমে নিজেকে হেরেছেন নাকি তাকে। কারণ যদি যুধিষ্ঠির প্রথমে নিজের স্বাধীনতাই হেরে গিয়ে থাকেন তবে দ্রৌপদীকে পণ রাখা যুধিষ্ঠিরের অধিকারের বহির্ভূত। প্রাতিকামী সভায় এসে দ্রৌপদীর প্রশ্ন জানালে যুধিষ্ঠির কিছুই উত্তর দিতে পারলেন না।
দ্রৌপদী কিছুতেই আসছেন না দেখে দুর্যোধন দুঃশাসনকে পাঠাল। তার কথাতেও দ্রৌপদী অস্বীকৃতি জানালেন। দুঃশাসন দ্রৌপদীর কেশ ধরে বলপূর্বক তাকে সভায় নিয়ে এল। বিক্ষিপ্তকেশে অর্ধস্খলিতবসনে দ্রৌপদী সভায় আনীত হলেন। দ্রৌপদীর এমন অপমান দেখে ভীম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি যুধিষ্ঠিরের হস্ত দগ্ধ করার সংকল্প করলেন। কারণ ভীম দ্রৌপদীর দুর্দশার জন্য যুধিষ্ঠিরকেই দায়ী করলেন। দ্রৌপদী এমন অন্যায় আচরণে কুরুসভার সকলের নীরবতা দেখে সকলকে ধিক্কার দিলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, মহামন্ত্রী বিদুর প্রভৃতি অতিশয় দুঃখিত হলেন। কিন্তু তারা দুর্যোধনের সম্মুখে সবাই নীরব হয়ে রইলেন। দ্রৌপদীর পক্ষে কোনো যুক্তি দেখাতে পারলেন না। দ্রৌপদী সভায় নানাভাবে অপমানিত হতে লাগলেন। দুর্যোধনের ভ্রাতাদের মধ্যে একমাত্র বিকর্ণ দ্রৌপদীর পক্ষে যুক্তি দিলেন। কর্ণ বিপরীত যুক্তি দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলেন। কর্ণ সভার মাঝে দ্রৌপদীকে বেশ্যা বললেন।[৬৬][৬৭] ভীম দ্রৌপদীর অপমান দেখে প্রতিজ্ঞা করলেন যে, তিনি দুঃশাসনের বুক চিরে তার রক্ত পান করবেন। সভার মাঝে দুর্যোধন অশালীনভাবে দ্রৌপদীকে নিজের বাম ঊরু দেখিয়েছিল। ভীম ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে সে ঊরু ভেঙ্গে দেওয়ার সংকল্প করলেন।
দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করার অপচেষ্টা করেছিল। কিন্তু দ্রৌপদী কৃষ্ণকে স্মরণ করতে লাগলেন। কৃষ্ণের দৈবিক হস্তক্ষেপে দ্রৌপদী রক্ষা পেলেন। স্বয়ং ধর্ম বস্ত্রের রূপ ধরে আবির্ভূত হলেন। সভায় শত শত বস্ত্র দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষার্থে আবির্ভূত হয়ে তাকে আবৃত করে ফেলল। আশ্চর্য ঘটনা দেখে সকলেই অবাক হলেন। দুঃশাসন বস্ত্র ধরে টানতে লাগল কিন্তু সেসব বস্ত্র রাশীকৃত হলো তবুও দ্রৌপদী নির্বস্ত্র হলেন না। পরিশেষে দুঃশাসন শ্রান্ত হয়ে গেল।
বনবাসের শেষ বছরে একদিন জয়দ্রথ কাম্যকবনে উপস্থিত হন । তিনি বিবাহ কামনায় শাল্বরাজ্যে যাচ্ছিলেন । তিনি কাম্যকবনে দ্রৌপদীকে দেখে মুগ্ধ হন । সে সময় পাণ্ডবরা ধৌম্য পুরোহিতকে দ্রৌপদীর পাহারায় রেখে শিকারে যান । জয়দ্রথ আশ্রমে আসলে দ্রৌপদী তাকে পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে সম্মান করেন কারণ তিনি দুঃশলার স্বামী ছিলেন । কিন্তু জয়দ্রথ তাকে বল্পূর্বক নিজের রথে তোলার চেষ্টা করলে দ্রৌপদী তাকে ধাক্কা দিয়ে ভূপাতিত করে সাহায্যের জন্য ধৌম্যকে ডাকতে থাকেন । ধৌম্য জয়দ্রথকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন । এসময় পাণ্ডবরা শিকার থেকে ফিরে এসে দ্রৌপদীর দাসীর মুখে সব কথা শুনে তাকে উদ্ধারের জন্য বের হন । ভীমকে দেখে জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে রথ থেকে ফেলে দেন । ভীম জয়দ্রথের রথের পিছনে ধাওয়া করে তাকে ধরে ফেলেন । কিন্তু যুধিষ্ঠির ভীমকে জয়দ্রথকে হত্যা করতে নিষেধ করেন কারণ সে তাদের বোনের স্বামী । ভীম জয়দ্রথের মাথা ন্যাড়া করে শুধু পাঁচটি চূড়া রেখে দিলেন এবং বললেন সে যেন নিজেকে পাণ্ডবদের দাস বলে পরিচয় দেয় । জয়দ্রথ " তাই হবে " বললে ভীম তাকে ছেড়ে দেন ।
দ্বাদশবর্ষ বনবাস শেষে পাণ্ডবগণ ও দ্রৌপদী অজ্ঞাতবাসের জন্য বিরাট রাজার দেশ মৎসদেশে গিয়েছিলেন । দ্রৌপদী সেখানে বিরাটের স্ত্রী সুদেষ্ণার সৈরিন্ধ্রী হিসেবে ছিলেন । একবার বিরাটের শ্যালক কীচক দ্রৌপদীকে দেখে ফেলেন এবং মুগ্ধ হয়ে তার বোনের কাছে দ্রৌপদীকে প্রার্থনা করেন । তিনি দ্রৌপদীকে নিজের বাসনার কথা বললে দ্রৌপদী তাকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন পাঁচজন গন্ধর্ব তাকে রক্ষা করেন । কিন্তু কীচক তার লোভ ত্যাগ করতে পারে না । তাই সুদেষ্ণা একদিন সুরা আনবার জন্য দ্রৌপদীকে কীচকের ভবনে পাঠান এবং কীচক তাকে কাছে পেয়ে হাত ধরেন । এতে দ্রৌপদী ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বিরাটের সভার দিকে দৌড়াতে থাকেন । কীচক তার পিছ পিছন গিয়ে তাকে কেশাকর্ষন করে পদাঘাত করেন । দ্রৌপদী বিচার চাইলে বিরাট বিচার করেন না কারণ কীচক তার সেনাপতি ছিল । দ্রৌপদী ভীমকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উত্তেজিত করেন । ভীম তাকে রাত্রিবেলায় কন্যাদের নৃত্যশালায় কীচককে নিয়ে যেতে বলেন । পরদিন দ্রৌপদীর কথায় কীচক তার সাথে মিলনের আশায় নৃত্যশালায় যান । কিন্তু ভীম সেখানে দ্রৌপদীর ছদ্মবেশে উপস্থিত ছিলেন । তিনি কীচককে দ্বন্দযুদ্ধে বধ করেন । এ সময় বৃহন্নলা রূপী অর্জুন তাদের দ্বন্দের শব্দ ঢাকার জন্য মৃদঙ্গ বাজিয়েছিলেন । পরদিন কীচকের ভাইয়েরা দ্রৌপদীকে মেরে ফেলার চেষ্টা করলে তারাও ভীমের হাতে নিহত হয় ।
দ্রৌপদীকে শ্রীকৃষ্ণ নিজের সখী ও ভগিনী মনে করতেন । কাশীদাসী মহাভারতে দ্রৌপদী বলেন -
তুমি অনাথের নাথ বলে সর্বজনে
- চারি কর্মে আমি নাথ তোমার রক্ষণে
- সম্বন্ধে গৌরবে স্নেহে আর প্রভুপণে
- দাসী জ্ঞানে মোরে প্রভু রাখিবা চরণে
— কৃষ্ণের প্রতি দ্রৌপদী[৬৮]
দ্রৌপদীর কাছে একবার দুর্যোধনের প্ররোচনায় ক্রোধী ঋষি দুর্বাসা তার অযুত শিষ্য সহ পাণ্ডবদের আশ্রমে উপস্থিত হলেন । তার পূর্বেই পঞ্চপাণ্ডব সহ দ্রৌপদী আহার করে ফেলেছিলেন । যুধিষ্ঠির ঋষিদের নদী থেকে স্নান করে আসতে বললেন । অন্নের কী আয়োজন হবে এই ভেবে দ্রৌপদী আকুল হয়ে কৃষ্ণের স্তব করে বললেন " হে দুঃখনাশন, তুমি এই অগতিদের গতি হও, দ্যূতসভায় দুঃশাসনের হাত থেকে যেমন আমাকে উদ্ধার করেছিলে সেই রূপ আজ এই সংকট থেকে আমায় ত্রাণ কর । " তখন কৃষ্ণ হঠাৎ উপস্থিত হয়ে বললেন তিনি খুব ক্ষুধার্ত । দ্রৌপদী তাকে শূন্য পাতিল দিলে তিনি দেখলেন তার পাশে সামান্য শাকান্ন লেগে আছে । তিনি তা খেয়ে বললেন " বিশ্বাত্মা যজ্ঞভোজী দেব তৃপ্তি লাভ করুন । " হঠাৎ পেট ভরে যাওয়ায় এবং পাণ্ডবরা হরির আশ্রিত জেনে দুর্বাসা তার শিষ্যদের নিয়ে ফিরে গেলেন।
মহাপ্রস্থানের পথে পাণ্ডবগণ বালুকার্ণব ও মেরুপর্বত দর্শন করে যাওয়ার পথে হঠাৎ দ্রৌপদী পড়ে যান। ভীম দ্রৌপদীর এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু দেখে যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করলেন যে, দ্রুপদনন্দিনী কৃষ্ণা কোনো অধর্মাচরণ করেননি; তবু কেন পড়ে গেলেন।[৬৯] উত্তরে যুধিষ্ঠির বললেন যে অর্জুনের প্রতি এর বিশেষ পক্ষপাত ছিল। তারই ফল লাভ করলেন।[৭০] দ্রৌপদী পঞ্চস্বামীর প্রতি কর্তব্য পালন করতেন। এ কারণে তিনি পাঁচজনেরই প্রিয় ছিলেন তা মহাভারতের বিভিন্ন অংশে উল্লেখ আছে। তবে পতিপ্রাণা হলেও তিনি অর্জুনকে অধিক ভালবাসতেন ।[৬৮] তাছাড়া অর্জুনের সাথেই তার বিবাহ হওয়ার কথা ছিল। তাই অর্জুনই তার প্রথম অনুরাগের পাত্র।
‘নারদ পুরাণ’ এবং ‘বায়ু পুরাণ’ অনুযায়ী, দ্রৌপদী একাধারে ধর্মপত্নী দেবী শ্যামলা, বায়ুপত্নী দেবী ভারতী এবং ইন্দ্রপত্নী দেবী শচী, অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের পত্নী ঊষা এবং শিবপত্নী পার্বতীর অবতার। বিগত জন্মে তিনি ছিলেন রাবণকে অভিসম্পাত-প্রদানকারী বেদবতী। তার পরের জন্মে তিনি সীতা। তারই তৃতীয় ও চতুর্থ জন্ম দময়ন্তী এবং তার কন্যা নলযানী। পঞ্চম জন্মে তিনি দ্রৌপদী। পূর্বজন্মে দ্রৌপদী ১৪টি গুণসম্পন্ন স্বামীর জন্য তপস্যা করেন। শিব তাকে সেই মতো বরদানও করেন। কিন্তু একটি মানুষের মধ্যে এতগুলি গুণ থাকা সম্ভব নয়। তখন শিব তাকে জানান যে পাঁচজন মানুষের মধ্যে এমন গুণের সমাহার ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে পঞ্চস্বামী বরণ করতে হতে পারে। দক্ষিণ ভারতে দ্রৌপদীকে দেবী কালিকার অবতার মনে করা হয়। তিনি দুষ্ট রাজাদের সংহারকল্পে আবির্ভূতা হন।[৭১]
ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক এবং তামিলনাডু ও ভারতের বাইরেও শ্রীলঙ্কা,মরিশাস, দক্ষিণ আফ্রিকা অঞ্চলে দ্রৌপদীকে উৎসর্গীকৃত অনেক মন্দির রয়েছে।[৭২] দ্রৌপদী দক্ষিণ ভারতের তামিলনাডু অঞ্চলের কিছু জাতিগোষ্ঠীর দ্বারা পূজিত হন।[৭৩][৭৪][৭৫]
দ্রুপদ দ্রৌপদীর পঞ্চপাণ্ডবের সাথে বিবাহে আপত্তি করলে ব্যাস দ্রুপদকে নিয়ে অন্য গৃহে গেলেন এবং দুটি উপাখ্যান বললেন।[৭৬] প্রথম উপাখ্যানে, ইন্দ্র দেখলেন হিমালয়শিখরে সিদ্ধাসনে বসে এক যুবক এক যুবতীর সঙ্গে পাশা খেলছেন। তারা পাশা খেলায় ব্যতিব্যস্ত বলে ইন্দ্রকে ফিরেও দেখল না। ইন্দ্র অহংকারে ও ক্রোধে তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, এই বিশ্ব আমারই অধীন জেনো, আমি এর ঈশ্বর। বাস্তবে যুবকটি ছিলেন মহাদেব। তিনি ইন্দ্রের দিকে তাকাতেই ইন্দ্র নিশ্চল হয়ে পড়লেন। আর ওই রমণীর স্পর্শে অবশ হয়ে ইন্দ্র ভূমিতে পড়ে গেলেন। এই রমণীই পূর্বজন্মের দ্রৌপদী। মহাদেব বললেন, ইন্দ্র, আর কখনো দর্প প্রকাশ করও না। তারপর মহাদেব আরও চারজন তেজস্বী পুরুষকে দেখালেন। ব্যাস বললেন, এরা চারজন এবং ইন্দ্রের বরে অর্জুন এই পাঁচজন পঞ্চপাণ্ডব রূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। আর মহাদেবের আদেশে ওই রমণী এদের পাঁচজনের পত্নী হবেন। ইনিই দ্রৌপদী।
ব্যাস পূর্বে পাণ্ডবদের এই উপাখ্যান বলেছিলেন।[৭৭] এবার দ্রুপদকে বললেন। মহাদেবের কাছে এক ঋষিকন্যা পতিলাভের জন্য প্রার্থনা করেছিল। সে পাঁচবার পতি চেয়েছে। এজন্য মহাদেব বললেন, পরজন্মে তোমার পাঁচটি ভরতবংশীয় পতি হবে।এই কন্যাই দ্রৌপদী।
১৯৮৮ সালের বলদেব রাজ চোপড়ার মহাভারতে দ্রৌপদীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন রূপা গাঙ্গুলী।২০১৩ সালের স্টার প্লাসের মহাভারতে দ্রৌপদীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন পূজা শর্মা এবং তিনি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন।[৭৮][৭৯] ভারতের বাইরেও ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে পূজা শর্মার অনেক খ্যাতি রয়েছে যেখানে ডাবিংকৃত মহাভারত সম্প্রচারিত হয়েছিল। স্টার ভারতের রাধাকৃষ্ণ ধারাবাহিকে দ্রৌপদী চরিত্রটি রূপায়ণ করেন ঈশিতা গাঙ্গুলী। হিন্দি অ্যানিমেশন মহাভারতে দ্রৌপদীর কণ্ঠ দেন বিদ্যা বালান। সনি টিভির "সূর্যপুত্র কর্ণ" নামক ধারাবাহিকে দ্রৌপদী ছিলেন পঙ্খুরী আওয়াস্থি।
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; kk
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; Hiltebeitel
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নিএই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |