ধূমপান হচ্ছে তামাক জাতীয় দ্রব্যাদি বিশেষ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে শ্বাসের সাথে তার ধোঁয়া শরীরে গ্রহণের প্রক্রিয়া। সাধারণ যেকোনো দ্রব্যের পোড়ানো ধোঁয়া শ্বাসের সাথে প্রবেশ করলে তাকে ধূমপান বলা গেলেও মূলত তামাকজাতীয় দ্রব্যাদির পোড়া ধোঁয়া গ্রহণকেই ধূমপান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ বিড়ি, সিগারেট, চুরুট ইত্যাদিতে আগুন লাগিয়ে তার ধোঁয়া গ্রহণ করাই হল ধূমপান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিকগণসহ মোটামুটি সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত যে, ধূমপান যক্ষ্মা, ফুসফুসের ক্যান্সার সহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
'ধূমপান' শব্দটি 'ধূম' এবং 'পান' শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে গঠিত। ধূম হলো 'ধোঁয়া' বা বাষ্পের প্রতিশব্দ। যেহেতু তামাকজাতীয় পদার্থের ধোঁয়া গ্রহণ করা হয় বা পান করা হয়, তাই একে 'ধোঁয়া পান' করা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, সে হিসেবে ধূমপান শব্দটি গঠিত।
গবেষণায় দেখা গেছে সিগারেটের ধূমপানে নিকোটিনসহ ৫৬ রকমের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ শরীরে প্রবেশ করে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বের ১৯২টি দেশে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, নিজে ধূমপান না করলেও অন্যের ধূমপানের (পরোক্ষ ধূমপান) প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৬,০০,০০০ মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে ১,৬৫,০০০-ই হলো শিশু। শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের কারণে নিউমোনিয়া ও অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ে। এছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণে হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার সহ শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগও দেখা দেয়। গবেষণায় এও বেরিয়ে এসেছে যে, পরোক্ষ ধূমপান পুরুষের তুলনায় নারীর উপর বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৮১,০০০ নারী মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে পরিচালিত এজাতীয় আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিলো যে, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ৪০% শিশু, ৩৩% অধূমপায়ী পুরুষ এবং ৩৫% অধূমপায়ী নারী রয়েছেন। তাতে এও ফুটে ওঠে যে, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন ইউরোপ ও এশিয়ার মানুষ।[১]
, যার ডাক্তার ধূমপানের কারণে সৃষ্ট মুখের ক্যান্সারের কারণে তার আত্মহত্যায় সহায়তা করেছিলেন [২]
এসব ছাড়াও নিয়মিত ধূমপানে ক্যান্সার নামে দুরারোগ্য ব্যাধি হওয়ার প্রবণতা যে বাড়ে সে বিষয়ে সব বিজ্ঞানী একমত। ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট, আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি ব্যাপকভাবে গবেষণা ও সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন ধূমপানে যে ফুসফুসে ক্যান্সার ঘটে সেটা একেবারেই নিশ্চিত। দেখা গেছে অধূমপায়ীদের তুলনায় নিয়মিত ধূমপায়ীদের ফুসফুসে ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার আপেক্ষিক ঝুঁকি ৩ থেকে ৩৪ পর্যন্ত হতে পারে।[৩]
বেশিরভাগ তামাক ধূমপায়ী কৈশোর বা প্রাথমিক বয়ঃসন্ধিকালে ধূমপান শুরু করে। ধূমপানে ঝুঁকি গ্রহণ এবং বিদ্রোহের উপাদান আছে, যা প্রায়ই তরুণদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। উচ্চ মর্যাদার মডেল এবং সমবয়সীদের উপস্থিতি ধূমপানকে উৎসাহিত করতে পারে। যেহেতু কিশোর-কিশোরীরা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় তাদের সমবয়সীদের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়,[৪] তাই মানুষকে ধূমপানের চেষ্টা থেকে বিরত রাখার জন্য পিতামাতা, স্কুল এবং স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের প্রচেষ্টা সবসময় সফল হয় না।
ধূমপায়ীরা প্রায়ই রিপোর্ট করে যে সিগারেট মানসিক চাপ দূর করতে সাহায্য করে। যাইহোক, প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ীদের মানসিক চাপের মাত্রা অধূমপায়ীদের তুলনায় সামান্য বেশি। কিশোর ধূমপায়ীরা জানাচ্ছেন যে ধূমপানের নিয়মিত অভ্যাস বৃদ্ধির সাথে সাথে মানসিক চাপ বেড়ে যায়, এবং ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করার পর মানসিক চাপ কমে যায়। মেজাজ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হিসেবে কাজ করার বদলে, এর ফলে যে নিকোটিন নির্ভরতার সৃষ্টি হয় তা মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়। ধূমপায়ীদের বর্ণনা করা দৈনন্দিন মেজাজের অবস্থা থেকে এটা নিশ্চিত করা হয়েছে যে, ধূমপানের সময় মেজাজ স্বাভাবিক থাকে এবং যখন ধূমপান করা হয়না তখন মেজাজ খারাপ খারাপ হয়ে যায়। এইভাবে, ধূমপানের আপাত চাপ নিরসনমূলক প্রভাব কেবলই নিকোটিন হ্রাসের সময়কার (যখন ধূমপান করা হয়না) বিকশিত উত্তেজনা এবং বিরক্তিরই প্রতিফলন। ধূমপানে নির্ভরশীল ব্যক্তির স্বাভাবিক বোধের জন্য নিকোটিনের প্রয়োজন হয়।[৫]
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে হ্যান্স আইসেঙ্কের মত মনোবিজ্ঞানীরা সেই সময়ের সাধারণ ধূমপায়ীদের জন্য একটি ব্যক্তিত্ব প্রোফাইল তৈরি করেন; এক্সট্রাভারশন বা বহির্মুখিতা ধূমপানের সাথে জড়িত ছিল, এবং ধূমপায়ীদের সামাজিক, আবেগপ্রবণ, ঝুঁকি গ্রহণ এবং উত্তেজনা অনুসন্ধানকারী হবার দিকে প্রবণতা দেখা যায়।[৬] যদিও ব্যক্তিত্ব এবং সামাজিক উপাদান মানুষকে ধূমপান করতে বাধ্য করতে পারে, প্রকৃত অভ্যাসটি আসলে অপারেন্ট কন্ডিশনিং এর একটি ফল। প্রাথমিক পর্যায়ে, ধূমপান আনন্দদায়ক অনুভূতি প্রদান করে (ডোপামিন ব্যবস্থার উপর তার ক্রিয়ার কারণে) এবং এইভাবে ইতিবাচক পুনর্প্ররোচনা বা পজিটিভ রিইনফোর্সমেন্ট এর একটি উৎস হিসেবে কাজ করে। একজন ব্যক্তি বহু বছর ধরে ধূমপান করার পর, প্রত্যাহারের উপসর্গ এবং নেতিবাচক পুনর্প্ররোচনা বা নেগেটিভ রিইনফোর্সমেন্টকে এড়ানোই প্রধান প্রেরণা হয়ে ওঠে। সকল আসক্তিমূলক পদার্থের মতই, কতটুকু নিকোটিন গ্রহণের ফলে নিকোটিনের উপর নির্ভরশীলতা তৈরি হবে তা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে।
সিগারেটের ধোঁয়ায় ক্যান্সার সৃষ্টিকারী মিউটাজেন থাকে। এরা মানুষের মুখ, শ্বাসনালি,গ্রাসনালি এবং ফুসফুসে ক্যান্সার সৃষ্টি করে।
ধূমপান থেকে শ্বাসনালিতে প্রদাহ এবং কাশির সৃষ্টি হয়। একে ব্রংকাইটিস বলে। এতে শ্বাসনালি ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়। হাঁপানি শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি হয়। ফুসফস অনেকাংশে নিষ্ক্রিয় হয়।
ধূমপানের ফলে শ্বাসনালিগুলোর বায়ুপথসমূহ সরু হয় এবং ফুসফুসে অতি স্ফীতি দেখা দেয়। একে এমফাইসিমা বলে। এর ফলে ফুসফুসে জটিল পরিবর্তন লক্ষিত হয়।
ধূমপানের জন্য অনেকের প্রচন্ড কাশি এবং কাশির সাথে ফুসফুস থেকে মিউকাস বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। একে উদ্গারি কাশি বলে।
শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের চিকিৎসকদের শিক্ষা এবং কাউন্সেলিং তামাক ব্যবহারের ঝুঁকি কমাতে কার্যকর হতে দেখা গেছে।[৭] পদ্ধতিগত পর্যালোচনায় দেখা যায় যে সমাজমনস্তাত্ত্বিক হস্তক্ষেপ মহিলাদের গর্ভাবস্থার শেষ দিকে ধূমপান বন্ধ করতে সাহায্য করতে পারে, এবং নিম্ন ওজনের সন্তান প্রসব এবং অকাল জন্ম কমাতে সাহায্য করতে পারে।[৮] ২০১৬ সালের একটি কোচরেন পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে ওষুধ এবং আচরণগত সমর্থনের সমন্বয় ন্যূনতম হস্তক্ষেপ বা স্বাভাবিক যত্নের চেয়ে বেশি কার্যকর ছিল।[৯] কোচরেনের আরেকটি পর্যালোচনা "পরামর্শ প্রদান করে যে ধূমপান বন্ধ করা বা হঠাৎ করে ত্যাগ করার ফলে উচ্চতর ত্যাগের হার বৃদ্ধি পায় না; তাই কীভাবে ধূমপান ত্যাগ করা যেতে পারে সে ব্যাপারে জনগণকে একাধিক বিকল্প দেওয়া যেতে পারে, এবং যারা বিশেষভাবে ধূমপান কমাতে চান তাদের সমর্থন প্রদান করা যেতে পারে।[১০]
সমাজ শব্দের অর্থ সহযোগিতা। আপনি, আমি বা আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ধূমপানের বিপক্ষে অর্থাৎ ধূমপানের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ সহ প্রতিকার করতে পারি। যা শুরু হতে পারে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, পাড়া, মহল্লা, থানা, উপজেলা, জেলা, বিভাগ ক্রমান্নয়ে দেশ পর্যায়ে যারা কর্তা ব্যক্তি প্রশাসনে আছেন সবার আগে তাদের আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ধূমপান বন্ধ করার জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে। বেসরকারী এনজিও, ইলেক্ট্রনিক্স ওি প্রিন্ট মিডিয়া সরাসরি ধূমপানের কুফল সম্পর্কে বিজ্ঞাপন, নাটোক, সিনেমা, আর্টিকেল সহ এর বিরুপ প্রভাব সম্পর্কে জনগণের কাছে সরাসরি প্রচার করতে হবে।
বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসন যদি প্রত্যক্ষ করে তাদের ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারেন তাহলে তামাক বা ধুমাপান বন্ধ করা সহজ থেকে সহজতর হবে। শুধু তাই নয়, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা বা সকল প্রকার ধর্মীয় উপসানলয়ে দায়িত্বরত কর্তা ব্যক্তিরা ধূমপানের কুফল সম্পর্কে প্রচার করে ভাল ফল পাওয়া সম্ভব।
ধূমপান ছাড়ার উপায় ধূমপান যেহেতু আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর সেহেতু এই নেশা প্রত্যেকের ছাড়া উচিত ।জেনে নিন ধূমপান ছাড়ার সহজ ও কার্যকরী উপায় ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৭ অক্টোবর ২০২০ তারিখে।এমন কিছু উপায় আলোচনা করা হল -
দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশে প্রচলিত ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ এর ৪ ধারা অনুযায়ী প্রকাশ্যে ধূমপানের ফলে জরিমানা হিসেবে প্রথমবার অনধিক ৳৩০০ (তিন শত) টাকা এবং দ্বিতীয় বা পরবর্তী প্রতিবারের জন্য দ্বিগুন টাকা দিতে হয়।[১৫]। এছাড়া ১০ধারা অনুযায়ী সিগারেট, বিড়ি ইত্যাদি তামাকজাতীয় দ্রব্যের মোড়কে 'ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর' কিংবা 'ধূমপান হৃদরোগের কারণ' লেখা বাধ্যতামূলক।
|শিরোনাম-সংযোগ=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
Laws of Bangladesh http://bdlaws.minlaw.gov.bd/bangla_all_sections.php?id=927