নমস্কার (উচ্চারণ: [nomoʃkar] অথবা উচ্চারণ: [nɔmoʃkar]; এছাড়াও নমস্তে এবং নমস্কারম্) হল ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষত ভারত ও নেপালে, এবং ভারতীয় প্রবাসীদের মধ্যে প্রচলিত হিন্দু রীতি থেকে উদ্ভূত একটি সম্মানীয় সম্ভাষণ। এটি অভিবাদন ও সম্ভাষণ উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়।[১][২] এই রীতিটি বাঙালি হিন্দুদের মধ্যেও বিশেষ জনপ্রিয় এবং বাংলা সম্ভাষণের প্রধান নিজস্ব ভঙ্গি। নমস্কার কথাটি উচ্চারণ করা হয় হাতের তালুদুটোকে পরস্পর সংলগ্ন করে কিছুটা নত হয়ে, এই সময় আঙুলগুলো উপরের দিকে নির্দেশিত থাকে আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ বুকের কাছে থাকে। এই ভঙ্গিটিকে অঞ্জলি মুদ্রা বা প্রণামাসন বলা হয়।[৩] আবার কোনো শব্দ উচ্চারণ না করেও এই ভঙ্গিমাটি সম্পন্ন করা যায়, এতে অর্থের কোনো পরিবর্তন হয় না। কোভিড-১৯ এর পর, এই সম্ভাসনের প্রচলন সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
অঞ্জলি মুদ্রা (সংস্কৃত: अञ्जलि मुद्रा) হল একটি হাতের অঙ্গভঙ্গি যা মূলত ভারতীয় ধর্ম ও শিল্পকলার সাথে যুক্ত, যা এশিয়া জুড়ে এবং তার বাইরেও দেখা যায়। এটি ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য ভঙ্গির একটি অংশ যেমন ভরতনাট্যম,[৪] যোগ অনুশীলন,[৫] এবং নমস্তে অভিবাদনের অংশ। পরিবেশন শিল্পকলার মধ্যে, অঞ্জলি মুদ্রা হল শ্রোতাদের সাথে অ-মৌখিক, চাক্ষুষ যোগাযোগের একটি রূপ। এটি ভারতীয় শাস্ত্রীয় শিল্পকলার ২৪টি সম্যুক্ত মুদ্রার মধ্যে একটি।[৪] অঞ্জলি মুদ্রার বিভিন্ন রূপ রয়েছে যেমন ব্রাহ্মাঞ্জলি।[৬] অঞ্জলি (अंजलि) হল একটি সংস্কৃত শব্দ যা হাত দুটো একত্রে ভাঁজ করে হাতের তালুর মাঝখানে গঠিত গহ্বরকে বোঝায়, এভাবে ফুল বা জল দেওয়া বা দান করা বা কিছু গ্রহণ করা।[৭][৮] যখন হাত একসাথে চাপা হয় এবং উত্থাপিত হয়, এটি "সম্মান", "শ্রদ্ধা", "আশীর্বাদ", "অভিবাদন" বা "প্রার্থনা" এর একটি রূপকে বোঝায়।[৭][৮] এটি anj থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ "সম্মান করা বা উদযাপন করা"।[৯] অঞ্জলি একটি "ঐশ্বরিক প্রস্তাব", "শ্রদ্ধার অঙ্গভঙ্গি" বোঝায়।
অঙ্গভঙ্গিটি অনেক যোগাসনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[১০] আধুনিক যোগের ভঙ্গি প্রণামাসনে (সংস্কৃত: प्रणामासन) অঞ্জলি মুদ্রায় হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানো ভঙ্গি আছে।
সাধারণ একটি অঙ্গভঙ্গি হিসাবে, এটি ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, বার্মা, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় সম্মানের চিহ্ন বা নীরব অভিবাদন হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি পূর্ব এশীয় বৌদ্ধ, চীনা ধর্মাবলম্বী এবং শিন্টো এবং অনুরূপ এশীয় ধারার অনুসারীরাও এই অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করে। অনেক ভারতীয় ধর্ম এবং অন্যান্য প্রাচ্য ধর্মে প্রার্থনার অংশ হিসাবে বা উপাসনার জন্য এই অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করা হয়।
নমস্কার (নমস্ + কার) শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষার নমস্কার (সংস্কৃত: नमस्कार, উচ্চারিত [nəməskaːrə]) শব্দ থেকে, নম এবং কৃ ধাতুর সাথে ঘঞ্ প্রত্যয়ের সংযুক্তিতে সৃষ্ট কার (কৃ + ঘঞ্) শব্দের সন্ধিতে।[১১] ক ধ্বনিটির আগে নমঃ শব্দটি বসায় সন্ধির জন্য তা নমস্ হয়েছে।[১২][১৩]
নম কথাটির অর্থ 'প্রণাম', 'অভিবাদন', 'সম্মাননা' বা 'নত হওয়া'(ঈশ্বরের কাছে)[১৪] এবং কার কথার অর্থ 'কার্য' বা 'করা' ('কৃ' ধাতুর কর্ম কারক)। অর্থাৎ, নমস্কার কথাটির আভিধানিক অর্থ হল "প্রণাম করা", "সম্মান করা" অথবা "ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নত হওয়া"।[১৫]
যখন কোন দেবতা বা ভগবানের উদ্দেশ্যে নমস্কার শব্দের ব্যবহার হয়, তখন তা দেবতা বা ভগবানের উদ্দেশ্যে নত হওয়াকে বোঝায়। অন্যদিকে, নমস্কার শব্দটি যখন কোন মানুষকে বলা হয়, তখন তা সেই মানুষটিকে সম্মান বা অভিবাদন জানানো বোঝায়।
বাংলা ছাড়া ভারতের কিছু অঞ্চলে অভিবাদনের এই রীতিটি নমস্তে (সংস্কৃত: नमस्ते, উচ্চারিত [nəməst̪eː]) নামে পরিচিত। এই শব্দটিও সংস্কৃত থেকে আগত। এর অর্থ "তোমাকে প্রণাম"। নম এবং তে (যুষ্মদ্ বা তুমি শব্দের ষষ্ঠীর একবচন রূপ) শব্দদ্বয়ের সন্ধিতে তৈরি হয়েছে শব্দটি। সন্ধির জন্যই নমঃ রূপান্তরিত হয়েছে নমস্-এ।
সংস্কৃতে তিন বা ততোধিক ব্যক্তিকে এই সম্ভাষণ করা হলে বলা হয় নমোবঃ। নম এবং যুষ্মদ্ শব্দের ষষ্ঠী বা সম্বন্ধ পদের বহুবচন রূপ বঃ সন্ধি করে শব্দটি সৃষ্টি করেছে।[১১] ব ধ্বনির আগে বসায় নমঃ হয়েছে নমো। নমোবঃ-এর ব্যবহার তুলনামূলক কম।[১২]
আরো কম প্রচলিত একটি রূপভেদ হল নমোবাম্। দু'জন ব্যক্তিকে সম্ভাষণ করতে হলে এটি ব্যবহৃত হয়। বাম্ হল যুষ্মদ্ শব্দের ষষ্ঠীর দ্বিবচন রূপ।[১১]
সিন্ধু সভ্যতায় খননকার্যে প্রচুর পুরুষ ও নারীর টেরাকোটা মূর্তি পাওয়া গেছে, যারা নমস্কার ভঙ্গিরত।[১৬][১৭] প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এই মূর্তিগুলির আনুমানিক সময়কাল নির্ধারণ করেছেন ৩০০০ থেকে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।[১৮][১৯]
এই রীতিটি ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, এশিয়ার অন্য কিছু অঞ্চল এবং যেখানে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আদি মানুষ বসবাস করে, সেখানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।[২০] নমস্কার বা নমস্তে সম্ভাষণ, অভিবাদন এবং আত্মীয়, অতিথি কিংবা আগন্তুককে স্বাগত জানবার একটি সম্মানজনক রীতি।[২] কিছু গ্রন্থে বলা আছে, কারোর কোনো দান বা উপহার গ্রহণে বিনয় জানাতে, অথবা কোনো ব্যক্তির কৃপার প্রতি ধন্যবাদ জানাতেও নমস্কার ব্যবহার করা যেতে পারে।[২১]
আবার মন্দিরে বা পূজার ষোড়শ উপচারের মধ্যে নমস্কার অন্যতম উপচার। অর্থাৎ শাস্ত্র অনুসারে, নমস্কার যেমন দেবদেবীর পুজোর একটি আচার, তেমনিই অতিথি বা অন্য ব্যক্তিকে সম্ভাষণেরও এক অঙ্গ।[২২][২৩] এর মাধ্যমে একজন অপরকে নম্রতা, বিনয়, সম্মান ও যত্ন প্রকাশ করতে পারেন। এমনকি এর মাধ্যমে বিদায়ও জানানো যায়। তৈত্তিরীয় উপনিষদ্ নামক প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থে নমস্কারকে "অতিথিদেবো ভব" নামে অভিহিত করা হয়েছে (অর্থাৎ, অতিথি দেবতাতুল্য)।[২৪][২৫]
প্রণামের ছয়টি রূপের একটি হল নমস্কার। ভারতে নমস্কার এবং প্রণামকে অভিন্ন হিসেবেই মনে করা হয়।[২৬][২৭]
বাংলায় অভিবাদনের এই রীতিটি নমস্কার নামেই পরিচিত, আবার কখনো-কখনো আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে প্রণাম কথাটিও বলা হয়। অসমীয়া (নমস্কাৰ) এবং ওড়িয়ায় (ନମସ୍କାର) "নমস্কার" কথাটিই বলা হয়। হিন্দি ও নেপালিতে "নমস্তে" (नमस्ते) এবং "নমস্কার" (नमस्कार) দুটোই বলা হয়। নেপালে নমস্কার শব্দটি সাধারণত গুরুজনদের ডাকা ও শ্রদ্ধা জানাতে ব্যবহার করা হয়। কন্নড়ে একজন ব্যক্তিকে "নমস্কারা" (ನಮಸ್ಕಾರ) আর একাধিক ব্যক্তিকে "নমস্কারাগলু" (ನಮಸ್ಕಾರಗಳು) বলে সম্ভাষণ জানানো হয়। তেলুগুতে একজনের জন্য "দণ্ডমু" (దండము) বা "নমস্কারম্" (నమస్కారం) এবং একের বেশিজনের ক্ষেত্রে "দণ্ডালু" বা "নমস্কারালু" বলা হয়। এছাড়াও আনুষ্ঠানিক "প্রণামমু" (ప్రణామము) প্রচলিত। তামিলে নমস্কারকে বলা হয় ভানাক্কম বা "বণক্কম" (வணக்கம்), এর উৎপত্তি "বণঙ্গু" (வணங்கு) শব্দ থেকে, যার অর্থ সম্ভাষণ। মলয়ালম ভাষায় নমস্কারম্ (നമസ്കാരം) শব্দটি ব্যবহৃত হয়।