পশুপতি সিলমোহর, যেখানে একটি বসা এবং সম্ভবত ত্রিমুখী প্রতিকৃতি দেখা যাচ্ছে, যা প্রাণী দ্বারা বেষ্টিত; আনুমানিক ২৩৫০–২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
পশুপতি সীলমোহর (যা মহাযোগী সীলমোহর[১]বা প্রোটো-শিব সীলমোহর নামেও পরিচিত,[২] ক্ষেত্রবিশেষে "তথাকথিত" বিশেষণটিও "পশুপতি"-র আগে ব্যবহৃত হয়)[৩] হলো সিন্ধু সভ্যতার একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এটি একটি স্টিয়াটাইট পাথরের তৈরি সীলমোহর যা ১৯২৮-২৯ সালে মহেঞ্জোদাড়োতে (বর্তমানে পাকিস্তান) খননকালে আবিষ্কৃত হয়। সেই সময় এই অঞ্চলটি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল এবং খননকার্যটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ কর্তৃক পরিচালিত হয়। সীলমোহরটিতে একটি উপবিষ্ট মূর্তি খোদাই করা আছে, যা সম্ভবত ত্রিমস্তকবিশিষ্ট (তিনটি মাথাযুক্ত)। এই মূর্তিটিকে প্রায়ই ইথিফ্যালিক (উত্থিত লিঙ্গযুক্ত) হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, যদিও এই ব্যাখ্যাটি অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ দ্বারা সমালোচিত হয়েছে।[৪] তবে, সিন্ধু সভ্যতা বিশেষজ্ঞ জোনাথন মার্ক কেনোয়ার ২০০৩ সালের একটি প্রকাশনায় এই মতামত সমর্থন করেন।[৫] মূর্তিটির মাথায় শিংযুক্ত একটি শিরোভূষণ রয়েছে এবং এটি বিভিন্ন পশু দ্বারা পরিবেষ্টিত। ধারণা করা হয় এই মূর্তিটি কোনো শিংযুক্ত দেবতার প্রতিনিধিত্ব করে।[৬][৭][৮][৯]
সিন্ধু নদের উপত্যকার প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রাপ্ত হাজার হাজার মোহরের মধ্যে এই মোহরটির নকশা অন্যতম জটিল। অন্যান্য মোহরের বিপরীতে, যেখানে সাধারণত পশুর ছবি প্রধান আকর্ষণ থাকে, এই মোহরটিতে একটি মানবমূর্তি প্রধান এবং বৃহত্তম উপাদান হিসেবে বিদ্যমান।[১০] অনেকেই দাবি করেন যে এটি হিন্দু দেবতা শিবের প্রাচীনতম চিত্রের মধ্যে একটি—'পশুপতি' (অর্থাৎ পশুদের প্রভু) তাঁর একটি উপাধি, অথবা এটি 'প্রোটো-শিব' (শিবের আদি রূপ) এর প্রতিমূর্তি।[৯][১১]
পশুপতি সিলমোহরের উপাদানের সমন্বয় যদিও অনন্য, তবুও অন্যান্য সিন্ধু সিলমোহরেও এর কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। মহেঞ্জোদাড়োতে প্রাপ্ত আরেকটি নিদর্শন (যার নম্বর ডিকে ১২০৫০) বর্তমানে ইসলামাবাদে আছে। এতে দেখা যায়, তিন মুখওয়ালা এক নগ্ন শিংওয়ালা দেবতা একটি সিংহাসনে যোগাসনে বসে আছেন এবং তাঁর হাতে চুড়ি পরা আছে। এই ক্ষেত্রে কোনো প্রাণী দেখানো হয়নি এবং চিত্রটির দাড়ি আছে বলে মনে হলেও এর লিঙ্গ নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে।[১২]
পশুপতি সিলমোহরটি বর্তমানে নয়াদিল্লির জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এটি স্বাধীনতার পূর্বে মহেঞ্জোদাড়ো থেকে পাওয়া অন্যান্য নিদর্শনের সঙ্গে সেখানে স্থানান্তরিত হয়। এই নিদর্শনগুলি ভবিষ্যতের জাতীয় জাদুঘরের জন্য সংরক্ষিত ছিল, যা অবশেষে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় সিলমোহরটি ভারত অধিরাজ্যের জন্য বরাদ্দ করা হয়।[১৩]
মহেঞ্জোদাড়ো প্রত্নতাত্ত্বিক খননস্থলের একটি দৃশ্য। ডিকে-জি এলাকাটি মহাস্নানাগার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত, যেখানে সীলমোহরটি আবিষ্কৃত হয়।[১৪]
১৯২৮-২৯ সালে মহেঞ্জোদাড়োর ডিকে-জি এলাকার দক্ষিণাংশের ১ নম্বর ব্লকের ৩.৯ মিটার গভীরে এই সীলমোহরটি আবিষ্কৃত হয়।[১৫] মহেঞ্জোদাড়ো খনন কাজের তত্ত্বাবধায়ক আর্নেস্ট জে.এইচ. ম্যাকাওয়ের ১৯৩৭-৩৮ সালের প্রতিবেদনে এই সীলটিকে মধ্যবর্তী ১ সময়কালের (যা বর্তমানে আনুমানিক ২৩৫০-২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হিসেবে ধরা হয়) বলে উল্লেখ করা হয়। এই প্রতিবেদনে সীলটির ক্রমিক নম্বর ৪২০ হওয়ার সুবাদে, এটি "সীল ৪২০" নামেও পরিচিত।[১৬]
↑প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ওয়েন্ডি ডনিগার তাঁর "দ্য হিন্দুস: অ্যান অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি" (The Hindus: An Alternative History) গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, একসময় যে সিন্ধু মোহরটিকে ভগবান শিবের লিঙ্গায়িত রূপের প্রতিমূর্তি হিসেবে মনে করা হতো, সম্ভবত তা আসলে কোনো ব্যক্তি পদ্মাসনে বসারত অবস্থায় রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে এভাবে পা মুড়ে বসার প্রবণতা রয়েছে এবং সম্ভবত মোহরটিতে সেই দৃশ্যই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
↑Witzel 2008, পৃ. 68–70, 90: "অভ্যন্তরীণ প্রমাণ থেকে জানা যায় যে বৈদিক গ্রন্থসমূহ মৌখিকভাবে উত্তর ভারতে রচিত হয়। প্রথমে এগুলি বৃহত্তর পাঞ্জাবে এবং পরবর্তীতে আরো পূর্ববর্তী অঞ্চল, যার মধ্যে উত্তর বিহার অন্তর্ভুক্ত, আনুমানিক ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০–৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কালে রচিত হয়। প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদ সম্ভবত উত্তর সিরিয়া/ইরাকের মিতানি গ্রন্থগুলোর (১৪৫০–১৩৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) সমসাময়িক ছিল।" (পৃ. ৭০) "হারাপ্পার কিছু সিলমোহরে পাওয়া তথাকথিত শিবা পশুপতির সঙ্গে বৈদিক সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা যায়নি (ডি. শ্রীনিবাসন ১৯৮৪); বরং এটি ইউরেশীয় সমাজগুলোর প্রচলিত ধারণা "পশুর অধিপতি"র সঙ্গে সম্পর্কিত, যিনি বহু নবপলীয় শিকারি সমাজে পূজিত ছিলেন।" (পৃ. ৯০)।
Kenoyer, J.M., প্রবেশিকা: Matthiae, P; Lamberg-Karlovsky, Carl Clifford, প্রথম নগরগুলোর শিল্প: খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের ভূমধ্যসাগর থেকে সিন্ধু অবধি, পৃ. 403, 2003, মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্ট (নিউ ইয়র্ক, এন.ওয়াই.), গুগল বই
সিংহ, কবিতা, "জাদুঘর জাতীয়", অধ্যায় ৪, Mathur, Saloni এবং সিংহ, কবিতা (সম্পাদক), No Touching, No Spitting, No Praying: The Museum in South Asia, 2015, Routledge, একাডেমিয়া ডট ইডুতে পিডিএফ