পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস |
---|
ধারাবাহিকের একটি অংশ |
![]() |
বিষয়ক ধারাবাহিক নিবন্ধশ্রেণীর অংশ |
![]() |
স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস সূচিত হয় ১৯৪৭ সালে। এই বছরই অবিভক্ত ব্রিটিশ বাংলা প্রদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তানভুক্ত হয়। পাকিস্তানের প্রদেশটির নাম হয় পূর্ব বাংলা ও ভারতের অংশটি পশ্চিমবঙ্গ নাম ধারণ করে।[১] ১৯৫০ সালে কোচবিহার রাজ্যটি পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়।
দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। এই ব্যাপক অভিবাসনের ফলে পশ্চিমবঙ্গে খাদ্য ও বাসস্থানের সমস্যা দেখা দেয়। ১৯৫০ সালে দেশীয় রাজ্য কোচবিহারের রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলে কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় পরিণত হয়। ১৯৫৫ সালে ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। বিহারের কিছু বাংলা-ভাষী অঞ্চলও এই সময় পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিপর্যয়, ধর্মঘট ও সহিংস মার্ক্সবাদী-নকশালবাদী আন্দোলনের ফলে রাজ্যের শিল্প পরিকাঠামো ভেঙে পড়ে। এর ফলে এক অর্থনৈতিক স্থবিরতার যুগের সূত্রপাত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়। সেই সময় নকশালবাদের সাথে কংগ্রেসের চক্রান্তের ফলে রাজ্যের পরিকাঠামোয় গভীর চাপ সৃষ্টি হয়।[২] ১৯৭৪ সালের বসন্ত মহামারীতে রাজ্যে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৭৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে পরাজিত করে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ এক রাজনৈতিক পরিবর্তন সূচিত হয়। এরপর তিন দশকেরও বেশি সময় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) (সিপিআই(এম)) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যে শাসনভার পরিচালনা করে।[৩]
১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগে ভারত সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কার এবং ২০০০ সালে সংস্কারপন্থী নতুন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্বাচনের পর রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত হয়। বর্তমানে রাজ্যের বিভিন্ন অংশে ছোটোবড়ো বেশ কয়েকটি সশস্ত্র জঙ্গিহানার ঘটনা ঘটেছে।[৪][৫] আবার শিল্পায়নের জন্য জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীদের একাধিক সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।[৬][৭]
২০০৬ সালে হুগলির সিঙ্গুরে টাটা ন্যানো কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে তীব্র গণ-অসন্তোষ দেখা যায়। জমি অধিগ্রহণ বিতর্কের প্রেক্ষিতে সিঙ্গুর থেকে টাটা গোষ্ঠী কারখানা প্রত্যাহার করে নিলে, তা রাজ্য রাজনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।[৮] ২০০৭ সালে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (SEZ) জন্য জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে অশান্তির জেরে পুলিশের গুলিতে ১৪ জন মারা গেলে রাজ্য রাজনীতি ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন, ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন ও ২০১০ সালের পৌরনির্বাচনে শাসক বামফ্রন্টের আসন সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। অবশেষে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে পরাজিত হয়ে রাজ্যের ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের অবসান হয়।
১৯৫০ সালে কোচবিহারের রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভারতের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করলে রাজ্যটি পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। [৯]
১৯৫৫ সালে চন্দননগরের ফরাসী উপনিবেশ, যেটি ১৯৫০ সালে ভারত সরকারের অধীনে আসে, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয়। সাথে সাথে বিহারের কিছু অঞ্চলও সংযুক্তি লাভ করে।
বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে অনেকগুলি শিল্পের বিকাশ ঘটে। ১৯৫৪ সালে পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়।
১৯৬৭ সালের রাজ্যসভা নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের সরকারের সিপিআই(এম) প্রধান চালিকাশক্তি ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার লাভ করেন বাংলা কংগ্রেসের অজয় মুখোপাধ্যায়।
১৯৬৭ সালে উত্তরবঙ্গে নকশালবাড়িতে সিপিআই(এম) নেতা চারু মজুমদার ও কানু সান্যালের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। সরকার কড়া হাতে আন্দোলন দমন করে। ১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকে ক্রমাগত মার্ক্সবাদী ও নকশালবাদী পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৯৬৭-র নভেম্বরে, কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করে। শুরুতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে একটি সংখ্যালঘু সরকার গঠন করলেও সেই মন্ত্রিসভা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। যুক্তফ্রন্ট সরকার উৎখাত হওয়ার ঘোষণার পর রাজ্যজুড়ে ২৪-ঘণ্টার এক জোরদার হরতাল সংঘটিত হয়। ঘোষ মন্ত্রিসভার পতনের পর রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়।
১৯৬৯-এ রাজ্যে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সর্ববৃহৎ দলরূপে আত্মপ্রকাশ করে।[১০] কিন্তু সিপিআই ও বাংলা কংগ্রেসের সক্রিয় সমর্থনে অজয় মুখোপাধ্যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদে পুনঃবহাল হন। ১৯৭০এর ১৬ই মার্চ তিনি পদত্যাগ করলে রাজ্যে আবার রাষ্ট্রপতি শাসন ফিরে আসে।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ১৯৭২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং বিজয়ী নেতা সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মুখ্যমন্ত্রী হন। এই পর্যায়ে, ১৯৭৫ সালে, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশজুড়ে জরুরী অবস্থা জারি করেন।
এই সময়কাল রাজ্যে পুলিশবাহিনীর সঙ্গে নকশালপন্থীদের চরম হিংসাত্মক লড়াই ও শেষ পর্যন্ত আন্দোলন দমনের জন্য চিহ্নিত হয়ে আছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিলে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।
[২] ১৯৭৪এ, বসন্তরোগের মহামারীতে হাজারো মানুষের মৃত্যু ঘটে। ১৯৭৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে পরাজিত করলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এক বিশাল পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়।
১৯৭৭-এর বিধানসভা নির্বাচনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) নেতৃত্বাধীন বামজোট ২৪৩ আসনে জয়লাভ করে সংখ্যাগুরুত্ব অর্জন করে। জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রীত্বে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী) নেতৃত্বাধীন বামজোট পরবর্তী তিন দশক ধরে রাজ্যের শাসনভার পরিচালনা করে।[১১]
পরপর পাঁচবার বামফ্রন্ট সরকারকে নেতৃত্ব প্রদানের পর জ্যোতি বসু সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে তাঁর উত্তরসূরী হিসাবে নিযুক্ত করেন। পাঁচ বছর পর মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাত ধরে বামফ্রন্ট আবার ক্ষমতায় আসে।[১২]
এই সময়ের সরকার তৎকালীন ভাগ চাষী দের আন্দোলন কে সংহতি জানিয়ে কৃষি ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনেন। অপারেশন বর্গা এবং ভাগ চাষ বিলের মাধ্যমে ভূমি সংস্কার আইন লাগু হয় এবং কৃষি ব্যবস্থায় আমূল উন্নয়ন ঘটে। জমি দার দের হাত থেকে জমি ছিনিয়ে নিয়ে প্রকৃত কৃষক দের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে কৃষিক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে।
ভারতবর্ষের আইন ব্যবস্থায় যে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা রয়েছে তার বাস্তবায়ন ঘটে এই সময়। অসংখ্য প্রান্তিক মানুষ সরকারকে তাদের প্রয়োজনে তাদের দুয়ারে পায়। জনগণ সক্রিয় ভাবে সরকারের ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে।
এছাড়াও এই সময় সরকারি চাকুরীজীবি, কৃষক, শ্রমিকদের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ঘটে। সকলের দৈনিক রোজগার বৃদ্ধি পায়। শ্রমিক , ছাত্ররা ইউনিয়ন এর অধিকার পায়। কৃষিক্ষেত্রে ধানে দেশে প্রথম, সবজিতে প্রথম ও আলুতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে রাজ্য।
১৯৯০-এর দশকের শুরুতে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রবর্তনে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি পুনরুজ্জীবন লাভ করে ২০০০ সালে সংস্কারভাবাপন্ন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সহযোগিতায়। ২০০৭-এ, কিছু স্পর্শকাতর এলাকায় শিল্প-সংক্রান্ত ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে প্রশাসনের সঙ্গে মতান্তরের ফলে[১৭][১৮] সশস্ত্র আন্দোলনকারিরা রাজ্যের কিছু জায়গায় সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ সংঘটিত করে।[১৯][২০]
২০০৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ইন্দোনেশীয় সালিম গ্রুপের[২১] মাধ্যমে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে ১০,০০০ একর (৪০ বর্গ কিমি) জুড়ে 'বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল' (SEZ) গঠনের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দমন করতে ৪,০০০ সশস্ত্র পুলিশের একটি বাহিনী প্রেরণ করে। পুলিশবাহিনীর গুলিতে অন্ততপক্ষে ১৪ জন নিহত হয় এবং ৭০ জন আহত হয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ২০১১র নির্বাচনে তৃণমূল ও বাংলা কংগ্রেসের জোট সরকার জয়ী হয়। ২০১৩তে তৃণমূল জাতীয় কংগ্রেসের জোট থেকে বেরিয়ে আসে। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল এককভাবে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসে। এই সময়ে রাজ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী মনোভাব বেড়ে যায় এবং শাসক দল কমিউনিস্টদের দমনে নেমে পড়ে।
২০১৬ সাল থেকে বাংলার অর্থনীতিতে ভালো বৃদ্ধি চোখে পড়ে, মমতা ব্যানার্জির একাধিক সামাজিক প্রকল্পে বাংলা আবার এগোতে শুরু করে, ২০২০ সালে অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বাংলার শেষ দশকের জিডিপি প্রবৃদ্ধি চোখে পড়ে, বাংলায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে ওঠে, যা বাংলার ভবিষ্যতকে ত্বরান্বিত করে।[নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি প্রশ্নবিদ্ধ]