গোপাল | |
---|---|
পাল | |
রাজত্ব | ৭৫০ - ৭৮১ |
পূর্বসূরি | কেউই না |
উত্তরসূরি | ধর্মপাল (পাল সম্রাট) |
দাম্পত্য সঙ্গী | দেদ্দাদেবী (ভদ্র রাজবংশের রাজকুমারী) |
বংশধর | ধর্মপাল (পাল সম্রাট) |
প্রাসাদ | পাল রাজবংশ |
পিতা | বপ্যট |
ধর্ম | বৌদ্ধধর্ম |
গোপাল ছিলেন বাংলার পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৭৫০ থেকে ৭৮১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। গোপাল বাংলার শতবর্ষব্যাপী চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করে শাসনভার গ্রহণের জন্য সুপরিচিত। তার নামের সঙ্গে যুক্ত "পাল" তার কোনো জাতিগত পরিচয়কে নির্দেশ করে না। "পাল" অর্থ রক্ষাকর্তা বা রক্ষক। তার সম্পর্কে তার নিজস্ব কোনো উৎস থেকে কিছু জানা যায়নি। তার বংশধরদের তাম্রশাসন বা তাম্রলিপি ও পাল সভাকবিদের কাব্য থেকে তার ও তার রাজত্ব সম্পর্কে কিছুটা জানা যায়।
গোপালের জাতি-পরিচয় সঠিক ভাবে জানা যায় নি। গোপালের পুত্র ধর্মপালের রাজত্বের ৩৪তম বর্ষে রচিত খালিমপুর তাম্রলিপি থেকে জানা যায়, গোপাল ছিলেন বপ্যট(শত্রু ধ্বংসকারী) নামে এক যোদ্ধার পুত্র এবং "দয়িতবিষ্ণু" নামে এক সর্ববিদ্যাবিশারদ পণ্ডিতের পৌত্র।[১][২][৩] পাল সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দী "রামচরিত" কাব্যে পাল রাজাদের "সমুদ্রকূলোদ্ভূত" বলেছেন। বরেন্দ্র পাল রাজাদের পিতৃভূমি ("জনকভূ") বলা হয়েছে।[৪] "জনক" অর্থ পিতা এবং "ভূ" অর্থ ভূমি। প্রথম মহীপালের বারগড় তাম্রশাসনে উত্তরবঙ্গকে অন্য বিশেষণ দিয়ে রামচরিত কাব্যের অনুরূপ বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এতে উল্লিখিত "রাজ্যম পিতরম" সংস্কৃত শব্দদ্বয় সম্ভবত উত্তরবঙ্গকে নির্দেশ করে।[৫] সব তথ্যসূত্রই বাংলা অঞ্চলের কোনো এক স্থানকেই পালদের আদি বাসস্থান রূপে নির্দেশ করে।
তিব্বতী বৌদ্ধ পণ্ডিত তারানাথ ও খালিমপুর তাম্রলিপির বর্ণনা অনুসারে, গৌড়রাজ শশাঙ্কের মৃত্যুর পর এক শতাব্দী কাল ছিল বাংলার ইতিহাসে ঘোর অরাজকতা ও গৃহবিবাদের যুগ। বাংলার ইতিহাসে এই যুগটি "মাৎস্যন্যায়" নামে পরিচিত। মৎস্যকূলে বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে গিলে খায়, তেমনি বাংলায় এই সময় শক্তিমানেরা দুর্বলদের উপর নিরন্তর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছিল। দেশের জনসাধারণের দুর্দশার অন্ত ছিল না। ব্যবসাবাণিজ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সর্বোপরি বাংলার প্রধান পোতাশ্রয় তাম্রলিপ্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
খালিমপুর তাম্রশাসনে সংস্কৃত ভাষায় বর্ণিত হয়েছে,
মাৎস্যন্যায়মপোহিতুং প্রকৃতিভির্লক্ষ্ম্যাঃ করং গ্রাহিতঃ শ্রীগোপাল ইতি ক্ষিতীশ- শিরসাং চূড়ামণিস্তুৎসুতঃ যস্যানুক্রিয়তে সনাতন যশোরাশিদিশামাশয়ে শ্বেতিম্না যদি পৌর্ণমাস-রজনী জ্যোৎস্নাতিভরশ্রিয়া।[৬]
এর ভাবানুবাদ হলো দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচারমূলক 'মাৎস্যন্যায়' অরাজকতা দূর করার অভিপ্রায়ে প্রকৃতিপুঞ্জ (জনগণ; সংস্কৃত ভাষায় প্রকৃতি অর্থ সাধারণ মানুষও হয়) রাজলক্ষ্মীর কর নিয়ে যাকে রাজা নির্বাচন করেছিলেন তিনি নরপাল কূলচূড়ামণি (বংশের শ্রেষ্ঠ) গোপাল এক প্রসিদ্ধ রাজার থেকে জন্ম নিয়েছিলেন।(অনুবাদক: অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)[৭]
সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার হাত থেকে মুক্তি পেতে, ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে 'প্রকৃতিপুঞ্জ' অর্থাৎ, বাংলার প্রধান নাগরিকবৃন্দ গোপাল নামে এক জনপ্রিয় সামন্ত নেতাকে বাংলার রাজপদে নির্বাচিত করেন।[৮][৯] রমেশচন্দ্র মজুমদার, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ পণ্ডিতগণ জনগণ কর্তৃক রাজা গোপালের নির্বাচনকে সমর্থন করেছেন।[১০]
তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিক পালযুগের আদিকালে এমন গণতন্ত্রের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিশেষত ড. আব্দুল মমিন চৌধুরী এ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন।[১১] রাজা গোপাল অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে শাসনকাল আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু খালিমপুর তাম্রশাসনে তিনি প্রকৃতির দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার কথা রয়েছে। "প্রকৃতি" শব্দের অর্থ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে "প্রকৃতি" অর্থ এখানে যে জনগণ না এমন মতও পাওয়া যায়। এর দ্বারা শুধু জনগণ না বুঝিয়ে প্রধান ব্যক্তিগণকে বুঝিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
তবে ঐতিহাসিকগণ অষ্টম শতকে পালরাজের সময়ে এমন গণতন্ত্র নিয়ে সন্দেহ পোষণ করলেও এমন ঘটনা একেবারেই অসম্ভব নয়। কারণ লৌহযুগে ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আংশিক প্রয়োগ দেখা যায় যা উত্তর-পূর্ব ভারত অর্থাৎ বাংলার অনেক নিকটবর্তী স্থানে গড়ে উঠেছিল। লিচ্ছবি,মল্ল সহ কিছু জনপদ গণতান্ত্রিক ছিল ও লৌহযুগে ষোড়শ মহাজনপদের অংশ ছিল।[১২] বাংলার নিকটবর্তী স্থান থেকে এ ধারণা পাওয়া একেবারেই অস্বাভাবিক কিছু নয়।
ষোড়শ শতাব্দীর তিব্বতীয় ঐতিহাসিক লামা তারানাথ গোপালের ক্ষমতালাভ নিয়ে রূপকথাধর্মী কাহিনী বর্ণনা করেছেন।
দেশে বহুদিন যাবৎ অরাজকতার ফলে দুঃখকষ্টের সীমা ছিল না। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা মিলিত হয়ে সুশৃঙ্খল শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একজন রাজা নির্বাচন করেন।রাত্রে রাজাকে এক কুৎসিত নাগরাক্ষসী হত্যা করে। এভাবে প্রত্যেক রাতেই নতুন নতুন নির্বাচিত রাজাগণ নিহত হতে থাকেন। এভাবে কিছু বছর অতিবাহিত হয়। অবশেষে একদিন সকালে এক বাড়িতে সবাই বিষণ্ণ বসে ছিল। কারণ ঐ বাড়িরই এক ছেলে সকালে রাজা নির্বাচিত হয়েছে। আজ রাতে নাগরাক্ষসী তাকে হত্যা করবে ভেবে সবাই বিষণ্ণ ছিল। কিন্তু সেখানে এক আগন্তুক আসে। সে ঐ ছেলের পরিবর্তে রাজা হতে সম্মত হয়। সেই রাতে লাঠির আঘাতে নাগরাক্ষসীকে সে হত্যা করে। সকালবেলা আগন্তুককে জীবিত দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। তারপর সাতবার এভাবে তিনি রাজা নির্বাচিত হন। তাঁকে স্থায়ী রাজা রূপে অভিষিক্ত করা হয় এবং নাম দেওয়া হয় গোপাল।[১৩]
তারানাথের মতে, গোপাল ছিলেন গোঁড়া বৌদ্ধ এবং ওদন্তপুরী মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা।[১৪] তার বংশধররা প্রায় সকলেই ছিলেন পূর্বপুরুষ গোপালের ধর্মাদর্শের অনুসারী। ষোড়শ শতাব্দীর পর্যটক তারানাথ তাঁকে গোঁড়া বলে থাকলেও পাল শাসকদের অন্য ধর্মের প্রতি উদারতার কথাও জানা যায়।
গোপালের রাজত্বকাল বা রাজ্যবিস্তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় নি।আর্য- মঞ্জুশ্রীমূলকল্প নামক বৌদ্ধগ্রন্থে আছে , গোপাল ২৭ বছর রাজত্ব করেন এবং ৮০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[১৫]:৩৯ তার মৃত্যুর পর তার পুত্র ধর্মপাল রাজা হন এবং পাল সাম্রাজ্যের গৌরব বৃদ্ধি করেন। তার বংশধর দেবপালের মুঙ্গের তাম্রলিপিতে আছে যে তিনি সমুদ্র পর্যন্ত ধরণীমণ্ডল জয় করেছিলেন।[১৬]সম্ভবত "সমুদ্র পর্যন্ত জয় করা" এর অর্থ সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল জয় করা। এটি বাংলার দক্ষিণে সমুদ্র তীরবর্তী রাঢ় অঞ্চলকে নির্দেশ করে থাকতে পারে।[১৭]
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; Susan1984
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি|তারিখ=
(সাহায্য)পূর্বসূরী গুপ্ত সাম্রাজ্য |
পাল সাম্রাজ্য ৭৫০-৭৭০ খ্রিস্টাব্দ |
উত্তরসূরী ধর্মপাল |