প্রহ্লাদ | |
---|---|
অসুররাজ[১] | |
![]() প্রহ্লাদের একটি ম্যুরাল | |
দেবনাগরী | प्रह्लाद |
অন্তর্ভুক্তি | বিষ্ণুভক্ত অসুর |
পূর্বসূরি | হিরণ্যকশিপু |
উত্তরসূরি | বিরোচন |
গ্রন্থসমূহ | ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, যোগবশিষ্ট, কূর্ম পুরাণ, বামন পুরাণ |
লিঙ্গ | পুরুষ |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
মাতাপিতা |
|
সহোদর | সংহ্লাদ, অনুহ্লাদ, শিবি, এবং বাস্কল (ভাই) |
দম্পত্য সঙ্গী | ধৃতি |
সন্তান | বিরোচন, কুম্ভ এবং নিকুম্ভ |
প্রহ্লাদ (সংস্কৃত: प्रह्लाद) হলেন হিন্দু পুরাণে বর্ণিত অসুরদের রাজা। তিনি ছিলেন হিরণ্যকশিপু ও কয়াধুর সন্তান এবং বিরোচনের পিতা৷ তিনি পালনকর্তা ভগবান বিষ্ণুর অনন্য ভক্ত হিসেবে খ্যাত। তার কথা বিষ্ণুদেবের নৃসিংহ অবতার উপাখ্যানে বর্ণিত হয়েছে। অর্ধ সিংহ, অর্ধ মনুষ্য দেহধারী নৃসিংহ, প্রহ্লাদকে রক্ষা করেন তার পিতা অহংকারী অসুররাজ হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করে।[২] ভগবান বিষ্ণুর প্রতি আনুগত্য ও অনন্য ভক্তির কারণে বিভিন্ন হিন্দু পুরাণে প্রহ্লাদকে সাধুসুলভ শুদ্ধচরিত্র ও বিষ্ণুভক্তরূপে বর্ণনা করা হয়৷ তাঁর প্রতি তাঁর পিতার আসুরিক অত্যাচার ও তাচ্ছিল্য সত্ত্বেও তিনি কখনো বিষ্ণুর প্রতি ভক্তিতে ত্রুটি করেন নি৷[৩] বৈষ্ণবদের মধ্যে তিনি শ্রীবিষ্ণুর পরমভক্ত ও "মহাজন" বলে পরিগণিত হন এবং নৃসিংহদেবের প্রধান অনুগামী বলেও উল্লিখিত হন৷ ভাগবত পুরাণের একটি স্কন্দে ভক্তদের মধ্যে প্রহ্লাদকে বিষ্ণুর প্রতি আনুগত্যের শিক্ষা প্রসারের উৎস হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন পুরাণে প্রহ্লাদ সংক্রান্ত অধিকাংশ কাহিনীই তার বাল্য ও কৈশোরকাল অবধিই বিশেষ সীমাবদ্ধ এবং তার পিতার মৃত্যুর পর বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায় না৷ আধুনিক ও পুরাতন শাস্ত্রীয় চিত্রকরদের চিত্রপটে প্রহ্লাদকে কুমার রূপেই দেখানো হয়েছে৷ হিন্দু ধর্মের সাথে কিছু বিশ্বাসগত পার্থক্য থাকলেও সেমিটিক ধর্ম তথা ইসলাম, ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্মালম্বীরা প্রহ্লাদ তথা ইব্রাহিমকে আল্লাহর নির্বাচিত মহাপুরুষদের মধ্যে গণ্য করেন। এবং পবিত্র কুরআনে তাঁর ব্যাপারে সুবিন্যস্ত বর্ণনা রয়েছে।
প্রহ্লাদ হলে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু ও তার স্ত্রী কয়াধুর পুত্র৷ হিরণ্যকশিপু দেবতাদের থেকে বরলাভ করেছিলেন যে মাতৃজঠর থেকে জাত কেউ, কোনো মানব বা প্রাণী দিনে বা রাতে ঘরে বা ঘরের বাইরে ভূমি বা বাতাস বা জলে কোনো মানবসৃষ্ট বা দৈব অস্ত্র দিয়ে হত্যা করতে পারবে না৷ হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে হত্যা করার ও অবদমিত করার একাধিক চেষ্টা করলে প্রহ্লাদপ্রভু শ্রী বিষ্ণু নরসিংহ অবতার গ্রহণ করে মর্তে অবতীর্ণ হন ও দৈত্যরাজকে হত্যা করে প্রহ্লাদকে উদ্ধার করেন৷ প্রাপ্ত বর অনুসারে অর্ধসিংহ অর্ধমানর নৃসিংহ নগরের স্তম্ভ থেকে সৃষ্ট হয়ে সন্ধ্যাকালে নিজের উরূর উপর নিজের ধারালো নখের সাহায্যে হত্যা করেন৷ "নৃসিংহ" বা "নরসিংহ" শব্দটি এসেছে দুটি সংস্কৃত শব্দ "নর" অর্থাৎ মানুষ (পুং) ও "সিংহ"-এর মিলনে৷ মনুষ্য জ্ঞানের অতীত দৈব শক্তির অধাকারী নৃসিংহ হিরণ্যকশিপু বধের সকল শর্ত পূরণ করে দৈত্যবধে সক্ষম হন৷[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
পিতার মৃৃত্যুর পর প্রহ্লাদ তাঁর পিতার রাজত্বের রাজ্যভার গ্রহণ করে এবং শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মকে পুনস্থাপনা করে নিজ কার্যভার সম্পন্ন করেন৷ তিনি তাঁর বদান্যতা ও প্রজাদের প্রতি করুন স্বভাবের জন্য সুখ্যাতি লাভ করেন৷ তার এই গুনগুলি পরবর্তীতে তার পুত্র বিরোচন ও পৌত্র মহাবলীর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়৷[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
মাতৃ জঠরে থাকাকালীন কয়াধুর মাধ্যমে প্রহ্লাদ নারদের হরিগুণগানে বিভোর থাকতেন৷ জন্মলাভের পর বাল্যকাল অবধি তিনি নারদের কাছে বিদ্যালাভও করেছিলেন৷ এর ফলে প্রহ্লাদ শ্রীবিষ্ণুর এক প্রিয় ভক্ত হয়ে ওঠেন৷ অপরদিকে তার পিতার ভগবানের প্রতি অনীহা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতি অনাস্থার দরুণ প্রহ্লাদ বারবার নিজ পিতার থেকে সাবধানবাণী পান৷ একাধিকবার এরূপ সতর্কতা উপেক্ষা করেও বিষ্ণুর প্রতি তাঁর বিশ্বাস একটুও কম হয়নি৷ ফলস্বরূপ হিরণ্যকশিপু পুত্রকে হত্যা করতে উদ্যত হলেও বিষ্ণুর কৃপায় বারবার বেঁচে যায় প্রহ্লাদ৷ তাঁর হাতি দ্বারা পদদলিত করার পরিকল্পনাও বিফলে যায়৷ পরে দৈত্যরাজ নিজ পুত্রকে সর্পসংকুল কক্ষে আবদ্ধ করলে সর্পকুল প্রহ্লাদের জন্য পালঙ্ক নির্মাণ করে দৈত্যরাজের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে৷[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এসবের পরেও প্রহ্লাদকে দৈত্যচেরীগণ নদীতে নিক্ষেপ করলে বিষ্ণুই তাকে উদ্ধার করেন৷
হিরণ্যকশিপুর ভগিনী হোলিকা বরপ্রাপ্ত ছিলেন যে অগ্নি তাকে ভস্ম করতে পারবে না৷ হিরণ্যকশিপুর পরিকল্পনায় হোলিকা জ্বলন্ত চিতার ওপর নিজ ভ্রাতুষ্পুত্রকে কোলে নিয়ে ঝাঁপ দেয়৷ প্রহ্লাদের প্রার্থনায় ও বিষ্ণুর ছলনার দ্বারা ঐ আগুনে হোলিকাদহন ঘটলেও প্রহ্লাদ প্রাণে বেঁচে যায়৷ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই ঘটনাটিই হোলিকা দহন বা বাংলায় ন্যাড়াপোড়া নামে পরিচিত৷[৪]
প্রহ্লাদের প্রতি হিরণ্যকশিপুর এইরূপ আচরণের পর বিষ্ণু অর্ধনর অর্ধসিংহ তথা নৃসিংহ অবতার গ্রহণ করে দৈত্যপুরীর স্তম্ভ চিড়ে প্রকাশিত হন ও সায়ংকালে ঘরের চৌকাঠে নিজের উরূর ওপর রেখে নৃসিংহ ধারালো নখর দিয়ে হিরণ্যকশিপুর পেট চিড়ে তাকে বধ করেন৷[৫]
পরে প্রহ্লাদ দৈত্যরাজ রূপে শাসনভার গ্রহণ করেন ও মৃত্যুর পর বিষ্ণুর এই পরমভক্ত স্বমহিমায় বৈকুণ্ঠলোকের প্রতি যাত্রা নিশ্চিত করেন৷[৬]
ভাগবত পুরাণের দশ অধ্যায়ে ত্রিশতম শ্লোক অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে বিবরণ করতে গিয়ে প্রহ্লাদের প্রসঙ্গ টেনে বলছেন:
অনুবাদ:
"সমস্ত দৈত্যকুলের মধ্যে আমিই সেই ভক্ত প্রহ্লাদ, পরাক্রমশালী শক্তিতে আমিই সময়, প্রাণিকুলে আমিই সিংহ আবার আমিই পক্ষীকুলশ্রেষ্ঠ গরুড়৷"[৭]
বিষ্ণুর প্রতি একনিষ্ঠ ভক্তি ও অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের নিকট পটু শিক্ষালাভের ফলে প্রহ্লাদ অসুররাজ্যের সর্ব্বৈব সর্বশক্তিমান শাসকরূপে চিহ্নিত হন৷ ধীরে ধীরে প্রহ্লাদ তার পিতা হিরণ্যকশিপুর থেকেও অধিক সমর্থ রাজা হয়ে ওঠেন৷
কোনো প্রকার অস্ত্রপ্রয়োগ না করে সুশ্রী আচরণের দ্বারা প্রহ্লাদ ত্রিভূবন জয় করতে সমর্থ হলে দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গরাজ্য ত্যগ করেন৷ ইন্দ্রদেব প্রতারনার দ্বারা নিজ স্বর্গরাজ্য আবার ফেরৎ পান৷ এরূপ প্রতারনার ফলে অসুরকুল দেবকুলের প্রতি বেশ ক্ষুব্ধ হয় এবং স্বর্গরাজ্যের উদ্দেশ্যে আক্রমণ করেন৷ দেবতাগণ এই আক্রমণে যথেষ্ট ভীতসন্ত্রস্ত হন ও যযাতি, রজি ও কাকুৎস্থ নামক মানবরাজাদের সাহায্যপ্রার্থী হয়ে অসুরকুলকে পরাস্ত করেন৷
প্রহ্লাদ নিয়মিত একাধিক ব্রাহ্মণকে ব্রাহ্মণসেবা করতেন৷ একদা অজ্ঞাতে প্রহ্লাদ একজন ব্রাহ্মণকে দান দিতে ভুলে যান৷ ফলত ব্রাহ্মণ প্রহ্লাদকে অভিশম্পাত করে বলেন যে সে তার ইষ্টদেব বিষ্ণুকে ভুলে অধর্মের পথেই পা বাড়াবে৷ এই অভিশাপ তখনই খণ্ডিত হবে যদি স্বয়ং বিষ্ণু প্রহ্লাদকে পরাস্ত করেন৷
প্রহ্লাদ করে নিজে থেকেই স্বর্গরাজ্য আক্রমণ করেন ও দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাস্ত করলে জীবনে ঝুঁকি নিয়ে দেবরাজ বাধ্য হন তার রাজ্য ছাড়তে৷ ইন্দ্র রাজ্য পুনরুদ্ধারে বিষ্ণুর সাহায্যপ্রার্থী হন৷ বিষ্ণুর মায়াবলের সহায়তায় ইন্দ্রদেব প্রহ্লাদকে পরাস্ত করতে সমর্থ হন৷ বিষ্ণুর হস্তক্ষেপের কথা বুঝতে পেরে প্রহ্লাদ নিজেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজ সৈন্য সরিয়ে নেন৷ প্রহ্লাদ নিজ রাজ্য অন্ধককে প্রদান করে গেলে মহাদেব শিব অন্ধককে পরাস্ত করলে প্রহ্লাদ নিজের পুত্র বিরোচনকে রাজ্যভার দিয়ে তীর্থক্ষেত্রে বেরিয়ে পড়েন৷[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]