হিন্দুধর্ম |
---|
ধারাবাহিকের অংশ |
|
প্রার্থনা (সংস্কৃত: प्रार्थना) বলতে প্রাকৃত বা অতিপ্রাকৃত সত্ত্বার নিকট 'অনুরোধ করা' বা 'আকুতি করা' কে বোঝায়।[১][২] হিন্দুধর্মে, প্রার্থনা আচার ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত।[৩] ভক্তিমূলক উপাসনায় এটি হিন্দুদের প্রেম ও ভক্তি প্রকাশের মাধ্যম, এবং নীরব ও উচ্চস্বরে প্রার্থনা উভয়কেই অনুমোদন করে।[৩][৪][৫] বৈদিক মন্ত্র বা স্তোত্র প্রার্থনার প্রধান উপকরণ।[৩] যোগ ও ধ্যানকেও ভক্তিমূলক সেবার রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
হিন্দুধর্মে প্রার্থনা বিশেষ ব্যক্তি বা সমগ্র সম্প্রদায়ের কল্যাণের জন্য দেবতা বা বিভিন্ন অলৌকিক শক্তিকে আহ্বান করতে ব্যবহৃত হয়।[৩] প্রার্থনা ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ করার পদ্ধতিগুলির মধ্যে একটি।[৬] বৈদিক ভাষায়, প্রার্থনা ছিল মন্ত্রের সমার্থক, ধর্মীয় মন্ত্র বা মন্ত্র, যা দেবতাদের সাথে যোগাযোগ করতে এবং তাদের কাছ থেকে কিছু ধরনের বৈষয়িক সুবিধা বা অনুগ্রহ কামনা করতে ব্যবহৃত হত।[৭] সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মন্ত্র হলো গায়ত্রী মন্ত্র।[৮][৯]
হিন্দু ঐতিহ্যে, প্রার্থনা অন্যান্য সংস্কৃতির তুলনায় ভিন্ন ও অসংখ্য রূপ নেয়, যদিও উদ্দেশ্য একই থাকে।[৬] প্রার্থনা তিন ভাগে বিভক্ত - আধ্যাত্মিক বা মানসিক, মৌখিক বা ভাষ্যিক এবং শারীরিক বা কায়িক।[৬]
মৌখিক প্রার্থনায়, বেশ কিছু অতীন্দ্রিয় শব্দাংশ ব্যবহার করা হয়।[৬] কিছু প্রার্থনা নির্দিষ্ট সময়ে পুনরাবৃত্তি হয়, এবং বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য প্রার্থনা করা হয়।[৬]
হিন্দু প্রার্থনা শুধুমাত্র ঈশ্বর বা দেবতা এবং তাদের প্রতিনিধিত্বকারী মূর্তিগুলির জন্যই করা হয় না, বরং এমন অনেক জিনিসের জন্যও যা পবিত্র বলে বিবেচিত হয় কারণ তারা চূড়ান্তের প্রকাশ।[৬] সুতরাং, হিন্দুরা বিভিন্ন ঋষি, সাধু ও উপদেশক, পর্বত, নদী এমনকি গাছের কাছে প্রার্থনা করে।[৬]
হিন্দুধর্মে অনেক ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। এর মধ্যে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত, ভগবদ্গীতা, শ্রীশ্রীচণ্ডী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব ধর্মগ্রন্থে ঈশ্বরের স্তব ও প্রার্থনামূলক অনেক মন্ত্র ও শ্লোক রয়েছে।
প্রার্থনামূলক মন্ত্র হিসেবে বেদের উল্লেখযোগ্য স্তোত্রগুলো নিন্মে দেয়া হলো:
ॐ भूर्भुवः स्वः
तत्स॑वितुर्वरे॑ण्यं
भर्गो॑ देवस्य॑ धीमहि।
धियो यो नः॑ प्रचोदया॑त्॥ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ
তৎ সবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি
ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ।।সর্বলোকের প্রকাশক সর্বব্যাপী সবিতা মণ্ডল জগৎ প্রসবকারী সেই পরম দেবতার বরেণ্য জ্ঞান ও শক্তি ধ্যান করি; যিনি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি প্রদান করেছেন।
सहस्रशीर्षा पुरुषः सहस्राक्षः सहस्रपात। सभूमिं विश्वतो वर्त्वात्यतिष्ठद
दशाङगुलम।।সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাত।
স ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বা অত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গলম্।।পরম পুরুষ বা ঈশ্বরের সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু ও সহস্র চরণ। তিনি জগৎকে সর্বত্র অতিক্রম করে দশ অঙ্গুলি পরিমাণ অতিরিক্ত হয়ে অবস্থান করেন।
দৃতে দৃংহ মা মিত্রস্য মা চক্ষুষা সর্বাণি ভূতানি সমীক্ষন্তাম্। মিত্রস্যাহং চক্ষুষা সর্বাণি ভূতানি সমীক্ষে।
মিত্রস্য চক্ষুষা সমীক্ষামহে।।হে ঈশ্বর, আমাকে এমন দৃঢ় কর যাতে সকল প্রাণী আমাকে বন্ধুর চোখে দেখে। আমিও তাদের বন্ধুর চোখে দেখি। আমরা সকলেই যেন পরস্পরকে বন্ধুর চোখে দেখি।
— শুক্ল যজুর্বেদ ৩৬.১৮[১৭]
শুক্ল যজুর্বেদের এ-মন্ত্রে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে - ঈশ্বর যেন আমাদের জ্ঞান ও শক্তিতে এমন দৃঢ় করেন যাতে সকল প্রাণী আমাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করে। আমরাও যেন সকলের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করি। কাউকে যেন হিংসা না করি। এভাবে আমরা সকলেই যেন সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করি। এর ফলে জীবন হবে শান্তিময়। বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক - এ প্রার্থনা-মন্ত্রটির মধ্য দিয়ে সেই প্রত্যাশাই ব্যক্ত করা হয়েছে।
প্রার্থনামূলক মন্ত্র হিসেবে উপনিষদের উল্লেখযোগ্য স্তোত্রগুলো নিন্মে দেয়া হলো:
असतो मा सद्गमय।
तमसो मा ज्योतिर्गमय।
मृत्योर्मा अमृतं गमय।
ॐ शान्तिः शान्तिः शान्तिः॥
অসতো মা সদ্গময়।
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।
ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি।
অসত্য থেকে সত্যের দিকে নিয়ে যাও।
অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যাও।
মৃত্যু থেকে আমাদের অমরত্বের দিকে নিয়ে যাও।
ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি।
ईशावास्यमिदँ सर्वं यत्किञ्च जगत्यां जगत्।
तेन त्यक्तेन भुञ्जीथा मा गृधः कस्यस्विद्धनम्॥१॥ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ ধনম্।।ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু অনিত্য বস্তু আছে, তা ঈশ্বরের দ্বারা আচ্ছাদিত। উত্তমরূপ ত্যাগের সঙ্গে ভোগ করবে, কারও ধনে লোভ করবে না।
यस्मात्परं नापरमस्ति किंचित् यस्मान्नाणीयो न ज्यायोऽस्ति कश्चित्। वृक्ष इव स्तब्धो दिवि तिष्ठत्येकः तेनेदं पूर्णं पुरुषेण सर्वम्।।
যস্মাৎ পরং নাপরমস্তি কিঞ্চিদ্
যস্মান্নাণীয়ো ন জ্যায়োহস্তি কিঞ্চিৎ।
বৃক্ষ ইব স্তব্ধো দিবি তিষ্ঠত্যেক -
স্তেনেদং পূর্ণং পুরুষেণ সর্বম্।।যা থেকে উৎকৃষ্ট আর কিছু নেই, যা থেকে ক্ষুদ্রতর বা বৃহত্তর কিছুই নেই, যে অদ্বিতীয় পরমাত্মা বৃক্ষের ন্যায় নিশ্চলভাবে স্বমহিমায় বিরাজিত, সেই পরমপুরুষের দ্বারাই সমস্ত জগৎ পরিব্যাপ্ত।
— শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, ৩.৯[২২]
কেশব ক্লেশহরণ নারায়ণ জনাৰ্দ্দন।
গোবিন্দ পরমানন্দ মাং সযুদ্ধর
মাধব॥হে কেশব, হে ক্লেশ বিনাশকারী, হে নারায়ণ, হে জনার্দন, হে গোবিন্দ-পরমানন্দ, হে মাধব আমাকে উদ্ধার কর।
— গোপালতাপনী উপনিষদ, ১৭
প্রার্থনামূলক মন্ত্র হিসেবে ভগবদ্গীতার উল্লেখযোগ্য স্তোত্রগুলো নিন্মে দেয়া হলো:
न हि ज्ञानेन सदृशं पवित्रमिह विद्यते। तत्स्वयं योगसंसिद्ध: कालेनात्मनि विन्दति॥ ३८ ॥
ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে।
তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি
বিন্দতি।।এই জগতে জ্ঞানের তুল্য পবিত্র আর কিছু নেই। যোগসিদ্ধগণ যথাসময়ে সে জ্ঞানকে নিজ আত্মাতে অনুভব করেন।
श्रद्धावाँल्लभते ज्ञानं तत्परः संयतेन्द्रियः। ज्ञानं लब्ध्वा परां शान्तिमचिरेणाधिगच्छति॥ ३९ ॥
শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ।
জ্ঞানং লব্ধা পরাং পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি।।শ্রদ্বাবান, একনিষ্ঠ এবং জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি জ্ঞান লাভ করে থাকেন। জ্ঞান লাভ করার পর শীঘ্র তিনি পরম শান্তি পেয়ে থাকেন।
প্রার্থনামূলক মন্ত্র হিসেবে শ্রীশ্রীচণ্ডীর উল্লেখযোগ্য স্তোত্রগুলো নিন্মে দেয়া হলো:
সর্ব্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্ব্বার্থ - সাধিকে শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোস্তুতে।।
হে দেবী শিবের পত্নী সকল মঙ্গলে তুমি মঙ্গল স্বরূপা, কল্যাণদাত্রী, সর্বসিদ্ধি প্রদায়িনী, আশ্রয়দাত্রী, ত্রিনয়না, গৌরবর্ণা, নারায়ণী তোমাকে প্রনাম জানাই।
— শ্রীশ্রীচণ্ডী, ১১.৩৭
সর্বভূতা যদা দেবী
স্বর্গমুক্তিপ্রদায়িনী।
ত্বং স্তুতা স্তুতয়ে কা বা ভবন্তু পরমোক্তয়ঃ।।তুমি সর্বস্বরূপা দেবী, তুৃমি স্বর্গ এবং মুক্তি দান করে থাক। কাজেই তোমাকে স্তব করতে হলে কোন শ্রেষ্ঠ বা পরম বাক্য তোমার স্তবের জন্য যোগ্য হবে।
— শ্রীশ্রীচণ্ডী, ১১.৭