প্লাজমোডিয়াম | |
---|---|
একটি স্পোরোজয়েটের ফলস-কালারড ইলেকট্রন মাইক্রোগ্রাফ | |
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস | |
জগৎ: | Chromalveolata |
পর্ব: | Apicomplexa |
শ্রেণী: | Aconoidasida |
বর্গ: | Haemosporida |
পরিবার: | Plasmodiidae |
গণ: | Plasmodium Marchiafava & Celli, 1885 |
প্রজাতিসমূহ | |
প্রায় ২০০ টি। যেমন- |
প্লাজমোডিয়াম (ইংরেজিতে: Plasmodium) একটি এককোষী সুকেন্দ্রিক জীবের গণ, যারা মেরুদণ্ডী প্রাণী এবং কীটপতঙ্গের মধ্যে বাধ্যতামূলক পরজীবী হিসেবে বসবাস করে।প্লাজমোডিয়াম প্রজাতির জীবনচক্রের ক্রমবিকাশ সংঘটিত হয় একটি রক্ত-খেকো কীট পোষকের ভিতর, যা পরবর্তীতে রক্ত পান করার সময় অন্য একটি মেরুদণ্ডী প্রাণীতে পরজীবীগুলো ঢুকিয়ে দেয়। মেরুদণ্ডী প্রাণীর রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে লোহিত রক্তকণিকাগুলোকে সংক্রমিত করার আগে পরজীবীগুলো তার দেহ টিস্যুতে (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যকৃতে) বিকাশলাভ করে। পোষক দেহের লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে রোগ সৃষ্টি হতে পারে, যা ম্যালেরিয়া নামে পরিচিত। চলমান সংক্রমণের সময়, একটি রক্ত-খেকো কীট (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মশা) অসুস্থ প্রাণীটিকে কামড় দিলে কিছু পরজীবী কীটের ভেতর প্রবেশ করে এবং এর ফলে পরজীবীর জীবনচক্র অব্যাহত থাকে।[১]
প্লাজমোডিয়াম গণ এপিকমপ্লেক্সা পর্বের (Phylum Apicomplexa) একটি সদস্য। এপিকমপ্লেক্সা পর্ব পরজীবী ইউক্যারিওটসমূহের একটি বৃহৎ গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত। প্লাজমোডিয়াম গণ এপিকমপ্লেক্সা পর্বের মধ্যে বর্গ হেমোস্পোরিডা (Order Haemosporida) এবং গোত্র প্লাজমোডিডা (Family Plasmodiidae)-তে অবস্থিত।প্লাজমোডিয়াম এর ২০০ টিরও বেশি প্রজাতি বর্ণিত হয়েছে, যার মধ্যে অনেকগুলো পরজীবীর অঙ্গসংস্থান এবং পোষকের পরিসরের উপর ভিত্তি করে ১৪ টি উপগণে বিভক্ত হয়েছে। বিভিন্নপ্লাজমোডিয়াম প্রজাতির মধ্যে বিবর্তনীয় সম্পর্ক সর্বদা ট্যাক্সোনোমিক সীমানা অনুসরণ করে না; কিছু প্রজাতি অঙ্গসংস্থানের দিক থেকে অনুরূপ হলেও বা একই পোষককে সংক্রমিত করলেও, দেখা যায় তারা দূর সম্পর্কিত।
প্লাজমোডিয়াম এর প্রজাতিসমূহ বিশ্বব্যাপী যেখানেই উপযুক্ত পোষক পাওয়া যায় সেখানেই ছড়িয়ে রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পোষক কীটসমূহ হল কিউলেক্স এবংঅ্যানোফিলিস গণের মশারা। মেরুদণ্ডী পোষকের মধ্যে রয়েছে সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ীরা। ঊনিশ শতকের শেষ দিকে শার্ল লুই লাভরঁ সর্বপ্রথম প্লাজমোডিয়াম পরজীবী শনাক্ত করেন। বিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন পোষকের মধ্যে অন্যান্য অনেক প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং তাদের শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে, এর মধ্যে পাঁচটি প্রজাতি নিয়মিতভাবে মানুষকে সংক্রমিত করে: প্লাজমোডিয়াম ভিভ্যাক্স (Plasmodium vivax), প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপ্যারাম (Plasmodium falciparum), প্লাজমোডিয়াম ম্যালেরি (Plasmodium malariae), প্লাজমোডিয়াম ওভালি (Plasmodium ovale) এবংপ্লাজমোডিয়াম নোলেসি (Plasmodium knowlesi)। এদের মধ্যে মানবদেহে সবচেয়ে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটায় প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপ্যারাম, যার সংক্রমণে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। প্লাজমোডিয়াম সংক্রমণের চিকিৎসা করার জন্য অনেকগুলো ওষুধ উদ্ভাবিত হয়েছে; তবে পরজীবীগুলো বিকশিত প্রতিটি ওষুধের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স গড়ে তুলেছে।
এরা অপকারী অন্তঃপরজীবী আদ্যপ্রাণী ও প্লাজমোডিয়াম (Plasmodium) গণভুক্ত। এদের জীবনচক্রের একটি অংশ মানুষ বা অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণী এবং পরবর্তী অংশ স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার দেহে সম্পন্ন হয়। কেবল স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা এই রোগ (ম্যালেরিয়া) ছড়ায়।
মানব ম্যালেরিয়া রোগের লক্ষণগুলি হল জ্বর, ক্লান্তি, বমি এবং মাথাব্যথা।[২][৩] গুরুতর ক্ষেত্রে, এটি জন্ডিস, খিঁচুনি, কোমা বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।[২][৪]
প্লাজমোডিয়াম গণ এপিকমপ্লেক্সা পর্বের সমস্ত ইউক্যারিওট নিয়ে গঠিত, যা পোষকের লোহিত রক্তকণিকার অভ্যন্তরে "মেরোগোনি" নামক অযৌন জনন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় এবং পোষকের হিমোগ্লোবিন পরিপাক করে উপজাত হিসেবে স্ফটিক রঞ্জক পদার্থ "হিমোজয়েন" (Hemozoin) তৈরি করে।[৫] অন্যান্য ইউক্যারিওটদের সাথে প্লাজমোডিয়াম প্রজাতিগুলোর অনেক বৈশিষ্ট্যের মিল রয়েছে, তবে তাদের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য শুধু তাদের পর্ব ও গণের ভিতর বিরাজ করে। নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকা ১৪টি আলাদা আলাদা ক্রোমোজোম নিয়ে প্লাজমোডিয়াম জিনোম গঠিত। প্লাজমোডিয়াম পরজীবীগুলো জীবনচক্রের অধিকাংশ সময় জিনোমের একটিমাত্র অনুলিপি বজায় রাখে, কেবল পোষকের মধ্যপাকনালিতে (Midgut) সংক্ষিপ্ত যৌন বিনিময়ের জন্য জিনোমকে দ্বিগুণ করে।[৬] নিউক্লিয়াসের সাথে সংযুক্ত এন্ডোপ্লাজমিক জালিকা (Endoplasmic reticulum বা ইআর) অন্যান্য ইউক্যারিওটের ইআর এর মতোই কাজ করে। প্রোটিনগুলো ইআর থেকে পরিবাহিত হয় গলগি বস্তুতে যা এপিকমপ্লেক্সানদের ভিতর সাধারণত একটি একক ঝিল্লি-আবদ্ধ প্রকোষ্ঠ দিয়ে গঠিত।[৭] এখান থেকে প্রোটিনগুলো কোষের বিভিন্ন অংশে বা কোষের পৃষ্ঠতলে পরিবাহিত হয়।
অন্যান্য এপিকমপ্লেক্সানদের (Apicomplexans) মতো, প্লাজমোডিয়াম প্রজাতিরদেরও দেহের শীর্ষ প্রান্তে বেশ কয়েকটি কোষীয় গঠন কাঠামো রয়েছে, যেগুলো পোষক দেহের মধ্যে বিভিন্ন কার্যকরী পদার্থ ক্ষরণের জন্য বিশেষায়িত অঙ্গাণু হিসেবে কাজ করে। সবচেয়ে লক্ষণীয় হল কন্দাকার রপ্ট্রিগুলো (bulbous rhoptries), যেগুলো পোষক কোষ আক্রমণ করার জন্য এবং পোষকের ভিতর একবার প্রবেশ করলে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরজীবী প্রোটিনসমূহ ধারণ করে।[৮] রপ্ট্রিগুলোর পাশেই মাইক্রোনিম (microneme) নামের এক ধরনের ছোট কাঠামো রয়েছে যা সঞ্চালনের পাশাপাশি পোষক চিহ্নিত করতে এবং তার সাথে যুক্ত হতে দরকারি প্রোটিনসমূহ ধারণ করে।[৯] পরজীবীর দেহ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বহু ক্ষরণকারী ভেসিকল যা ঘন দানাদার বস্তু (Dense granules) নামে পরিচিত। এগুলো পোষক ও পরজীবীকে পৃথক করে রাখার যে পর্দা রয়েছে, যাকে প্যারাসাইটোফোরাস গহ্বর (Parasitophorous vacuole) বলা হয়, তার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনসমূহ ধারণ করে।
প্লাজমোডিয়াম প্রজাতিতে এন্ডোসিম্বায়োটিক উৎসের দুটি বড় আকারের ঝিল্লিযুক্ত অঙ্গাণু থাকে, যথা- মাইটোকন্ড্রিয়ন এবং এপিকোপ্লাস্ট (Apicoplast), উভয়ই পরজীবীর বিপাকে মূল ভূমিকা পালন করে। প্লাজমোডিয়াম কোষগুলো স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কোষের মত অনেকগুলো মাইটোকনড্রিয়া ধারণ না করে একটিমাত্র বড় আকারের মাইটোকনড্রিয়ন ধারণ করে, যেটি প্লাজমোডিয়াম কোষের সাথে এর বিভাজনকে সমন্বয় করে নেয়।[১০] অন্যান্য ইউক্যারিওটের মতো প্লাজমোডিয়াম মাইটোকন্ড্রিয়ন ক্রেবস চক্রের মাধ্যমে ATP রূপে শক্তি উত্পাদন করতে সক্ষম; তবে এই ক্রিয়াটি কেবল কীট পোষকের ভিতর পরজীবীর বেঁচে থাকার জন্য দরকারি এবং লোহিত রক্তকণিকাতে বৃদ্ধির জন্য এর প্রয়োজন পড়ে না। এপিকোপ্লাস্ট নামে দ্বিতীয় অঙ্গাণুটি একটি গৌণ এন্ডোসিম্বায়োসিস ঘটনা থেকে উদ্ভূত।[১১] এপিকোপ্লাস্ট ফ্যাটি অ্যাসিড, আইসোপ্রিনয়েডস্, আয়রন-সালফার ক্লাস্টার এবং হিম জৈবসংশ্লেষণের উপাদানগুলো সহ বিভিন্ন বিপাকীয় প্রিকার্সর উপাদান সংশ্লেষণে জড়িত।[১২]
প্লাজমোডিয়াম এর জীবনচক্রটি কীটপতঙ্গ এবং মেরুদণ্ডী পোষকের ভিতর বিভিন্ন স্বতন্ত্র পর্যায়ের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয়। পরজীবীগুলো সাধারণত একটি কীট পোষকের (সাধারণত একটি মশা, সরীসৃপের কিছু প্লাজোডিয়াম প্রজাতি ব্যতীত) কামড় দ্বারা একটি মেরুদণ্ডী পোষকে প্রবর্তিত হয়।[১৩] পরজীবী প্রথমে যকৃত বা অন্যান্য টিস্যুতে সংক্রমণ ঘটায়, পোষকের টিস্যু কোষ থেকে বের হয়ে লোহিত কণিকাগুলোকে সংক্রমিত করার আগে সেখানে তারা একটি বড় বিভাজন চক্র সম্পন্ন করে।[১৪] এই মুহুর্তে, প্রাইমেটদের কয়েকটিপ্লাজমোডিয়াম প্রজাতি একটি দীর্ঘজীবী সুপ্ত অবস্থা গঠন করতে পারে, যা হিপনোজয়েট (Hypnozoite) নামে পরিচিত।[১৫] এটি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে যকৃতে বেঁচে থাকতে পারে।[১৬] তবে বেশিরভাগ প্লাজমোডিয়াম প্রজাতির ক্ষেত্রে, যকৃতের সংক্রমিত কোষগুলোতে কেবল মেরোজয়েট নামের পরজীবীগুলোই থাকে। লিভার থেকে বের হওয়ার পরে, তারা উপরে বর্ণিত উপায়ে লোহিত রক্তকণিকায় প্রবেশ করে। এরপরে তারা এরিথ্রোসাইট সংক্রমণের অবিরাম চক্রের মধ্য দিয়ে যায়, যখন অল্প কিছু পরজীবী গ্যামেটোসাইটে পরিণত হয়,কোন কীট পোষক রক্ত পান করার সময় সেগুলো তার দেহের ভিতর প্রবেশ করে। কিছু মেরুদণ্ডী পোষকেপ্লাজমোডিয়াম প্রজাতি দ্বারা এরিথ্রোসাইটের সংক্রমণের ফলে রোগ সৃষ্টি হতে পারে, যা ম্যালেরিয়া নামে পরিচিত। এটি কখনো কখনো গুরুতর হতে পারে এবং দ্রুত পোষকের মৃত্যু ঘটাতে পারে (যেমন- মানুষের প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপারাম সংক্রমণ)। অন্যান্য পোষকে, প্লাজমোডিয়াম সংক্রমণ আপাত উপসর্গবিহীন হতে পারে।
লোহিত রক্তকণিকাগুলোর মধ্যে, মেরোজয়েটগুলো প্রথমে একটি রিং-আকৃতির গঠনে পরিণত হয় এবং এরপর আকারে বড় হয়ে ট্রফোজয়েটে পরিণত হয়। ট্রফোজয়েটগুলো তারপর সাইজন্টে পরিণত হয়, যেগুলো বেশ কয়েকবার বিভাজিত হয়ে নতুন আরও মেরোজয়েট উত্পন্ন করে। সংক্রমিত লোহিত রক্তকণিকাটি অবশেষে ফেটে যায় এবং নতুন মেরোজোয়েটগুলো রক্তপ্রবাহের মধ্য দিয়ে নতুন লোহিত কণিকাদের আক্রমণ করে। বেশিরভাগ মেরোজয়েট এই বিভাজন চক্র অব্যাহত রাখে, তবে রক্তকণিকাগুলোকে সংক্রমিত করার পর কিছু মেরোজয়েট পুরুষ বা স্ত্রী গ্যামোটোসাইটে রূপান্তরিত হয়। এই গ্যামোটোসাইটগুলো মশকী দ্বারা গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত রক্তে সঞ্চালিত হতে থাকে। পরবর্তীতে আক্রান্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীর দেহ থেকে রক্ত পান করার সময় পরজীবীর গ্যামেটোসাইটগুলো মশকীর দেহে প্রবেশ করে।[১৪]
মশকীর মধ্যে গ্যামেটোসাইটগুলো গৃহীত রক্তের সাথে মশকীর মধ্যপাকনালিতে চলে যায়। এখানে গ্যামেটোসাইটগুলো পুরুষ এবং স্ত্রী গ্যামেটে পরিণত হয়ে নিষেক সম্পন্ন করে, ফলে জাইগোট সৃষ্টি হয়। জাইগোট তারপর সচল ঊওকিনেটে পরিণত হয়, যা মিডগাটের প্রাচীর ভেদ করে। মিডগাটের প্রাচীরটি অতিক্রম করার পরে, ঊওকিনেট (Ookinete) পাকনালির বহিঃপ্রাচীরে নিহিত হয় এবং একটি ঊওসিস্টে পরিণত হয়। ঊওসিস্ট (Oocyst) বহুবার বিভাজিত হয়ে অসংে স্পোরোজয়েটে পরিণত হয়। এই স্পোরোজয়েটগুলো মশকীর লালা গ্রন্থিতে স্থানান্তরিত হয়। এ সময় অন্য কোন সুস্থ পোষককে দংশন করলে মশকীর লালার সাথে স্পোরোজয়েটগুলো সেই পোষক দেহে প্রবেশ করে এবং পুনরায় চক্রটি সংঘটিত হয়।[১৪]
প্লাজমোডিয়াম এপিকমপ্লেক্সা পর্বে অন্তর্গত, যা কোষের এক প্রান্তে 'ক্ষরণকারী অঙ্গাণু' বিশিষ্ট এককোষী পরজীবীদের একটি ট্যাক্সোনমিক গোষ্ঠী।[১৭] এপিকমপ্লেক্সার মধ্যে প্লাজমোডিয়াম বর্গ হেমোস্পোরিডা (Order Haemosporida)-র অন্তর্গত, এটি রক্তকোষে বসবাস করে এমন সব এপিকমপ্লেক্সানদের নিয়ে গঠিত একটি গ্রুপ।[১৮] রঞ্জক পদার্থ হিমোজয়েনের উপস্থিতি এবং অযৌন জনন পদ্ধতির ভিত্তিতে বর্গটি পুনরায় চারটি গোত্রে বিভক্ত হয়, যার মধ্যে প্লাজমোডিয়াম গোত্র প্লাজমোডিডা (Family Plasmodiidae)-তে অবস্থিত।[১৯]
প্লাজমোডিয়াম গণ ২০০ টিরও বেশি প্রজাতি নিয়ে গঠিত, যেগুলো সাধারণত সংক্রমিত প্রাণীর ব্লাড ফিল্মে কিরূপে প্রতীয়মান হয় তার উপর ভিত্তি করে বর্ণিত হয়।[২০] এই প্রজাতিগুলোকে পরজীবীর অঙ্গসংস্থান এবং পোষকের পরিসরের উপর ভিত্তি করে ১৪ টি উপগণে বিভক্ত করা হয়েছে:[১৯]
Plasmodium falciparum এবং Plasmodium reichenowi (যারা একত্রে উপগণ Laverania গঠন করে) ব্যতীত বানর এবং নরবানরে সংক্রমণ ঘটানো অন্যান্য প্রজাতিসমূহ উপগণ প্লাজমোডিয়াম এর মধ্যে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। কিছু প্রাইমেট (যেমন- লেমুর এবং অন্যান্য) সহ অন্য স্তন্যপায়ীদের সংক্রমিত করে যেসব পরজীবীরা, সেসব উপগণ Vinckeia তে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। পাঁচটি উপগণ Bennettinia, Giovannolaia, Haemamoeba, Huffia এবং Novyella পরিচিত অ্যাভিয়ান ম্যালেরিয়ার প্রজাতিসমূহ ধারণ করে।[২১] বাকী উপগণ : Asiamoeba, Carinamoeba, Lacertamoeba, Ophidiella, Paraplasmodium, এবং Sauramoeba তে বিচিত্রসব পরজীবীরা অন্তর্ভুক্ত যারা সরীসৃপে সংক্রমণ ঘটায়।[২২]
আণবিক পদ্ধতি ব্যবহার করে প্লাজমোডিয়াম প্রজাতির উপর সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, এই গোষ্ঠীর বিবর্তন সঠিকভাবে ট্যাক্সোনমি অনুসরণ করেনি।[৫] বহুপ্লাজমোডিয়াম প্রজাতি অঙ্গসংস্থানের দিক থেকে অনুরূপ হলেও বা একই পোষককে সংক্রমিত করলেও, দেখা যায় তারা দূর সম্পর্কিত।[২৩] ১৯৯০-এর দশকে, অনেক গবেষণাতে বিভিন্ন প্রজাতির রাইবোজমীয় RNA এবং একটি পৃষ্ঠতল প্রোটিন জিনের মধ্যে তুলনা করে প্লাজোডিয়াম প্রজাতিসমূহের বিবর্তনীয় সম্পর্কের মূল্যায়ন করার চেষ্টা করা হয়, দেখা যায় যে, মানুষের পরজীবী Plasmodium falciparum, প্রাইমেটেদের অন্যান্য পরজীবীগুলোর চেয়ে পাখিদের পরজীবীগুলোর সাথে আরও ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত।[১৯] তবে পরবর্তীতে আরও বেশি পরিমাণে প্লাজমোডিয়াম প্রজাতির নমুনা নিয়ে গবেষণায় করে দেখা গেছে যে, স্তন্যপায়ীদের পরজীবীরা Hepatocystis গণের সাথে একটি ক্লেইড (Clade) গঠন করে, অপরদিকে টিকটিকি বা পাখিদের পরজীবীরা উপগণটি অনুসরণ না করে, বিবর্তনীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি পৃথক ক্লেইড গঠন করে:[২৪]
Leucocytozoon | ||||||||||||||||||||||||||||
| ||||||||||||||||||||||||||||
প্লাজমোডিয়াম এর বিভিন্ন বংশানুক্রমিক ধারা সঠিক কখন বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, তা নিয়ে ব্যাপক ভিন্নমত রয়েছে। অনুমান করা হয়, প্রায় ১.৬২ থেকে ১০ কোটি বছর পূর্বে হেমোস্পোরিডা বর্গের বৈচিত্রতা সৃষ্টি হয়।[১৯] চিকিৎসা ক্ষেত্রে গুরত্বের কারণে মানব পরজীবী Plasmodium falciparum ঠিক কবে প্লাজমোডিয়াম এর অন্যান্য বংশানুক্রমিক ধারা থেকে পৃথক হয়ে যায়, তা নির্ণয় করার জন্য গবেষকদের মাঝে বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। অনুমান করা হয়, এ ঘটনা ঘটেছিল প্রায় ১.১ লাখ থেকে ২৫ লাখ বছর আগে।
প্লাজমোডিয়াম প্রজাতিসমূহ সারা বিশ্ব জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে। সকল প্লাজমোডিয়াম প্রজাতিই পরজীবী এবং তাদের জীবনচক্র সম্পন্ন করতে একটি মেরুদণ্ডী পোষক এবং একটি কীট পোষকের মধ্য দিয়ে যাওয়া আবশ্যক। প্লাজমোডিয়াম এর একেক প্রজাতি একেক রকম পোষক পরিসীমা প্রদর্শন করে। কিছু প্রজাতি রয়েছে যারা কেবল একটি মেরুদণ্ডী এবং কীট পোষকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, অন্য প্রজাতিসমূহ কয়েকটি প্রজাতির মেরুদণ্ডী এবং/অথবা কীটকে সংক্রমিত করতে পারে।
সরীসৃপ, পাখি এবং স্তন্যপায়ী সহ বৃহৎ পরিসরের মেরুদণ্ডী প্রাণীদের ভিতর প্লাজমোডিয়াম পরজীবী বর্ণিত হয়েছে।[২৫] যদিও অনেক প্রজাতি একাধিক মেরুদণ্ডী পোষককে সংক্রমিত করতে পারে, তবে তারা সাধারণত একটি শ্রেণীতে নির্দিষ্ট থাকে (যেমন- পাখি)।[২৬]
মানুষ সাধারণত প্লাজমোডিয়াম এর পাঁচটি প্রজাতি দ্বারা সংক্রমিত হয় এবং এদের ভিতর অধিকাংশক্ষেত্রে মারাত্মক রোগ ও মৃত্যু ঘটে প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপারাম সংক্রমণের কারণে।[২৭] কিছু প্রজাতি মানুষকে সংক্রমিত করার পাশাপাশি অন্যান্য প্রাইমেটদেরকেও সংক্রমিত করতে পারে এবং কিছু প্রজাতি (যেমন- Plasmodium knowlesi) অন্যান্য প্রাইমেট থেকে মানুষে জুনোটিক সংক্রমণ ঘটাতে পারে। অ-মানব প্রাইমেটে বিভিন্ন ধরনের প্লাজমোডিয়াম প্রজাতি থাকে, যেগুলো সাধারণত মানুষকে সংক্রমিত করে না। এদের মধ্যে কয়েকটি প্রজাতি প্রাইমেটে গুরুতর রোগ সৃষ্টি করতে পারে,আর অন্যরা রোগ সৃষ্টি না করেই দীর্ঘদিন ধরে পোষকের দেহে থাকতে পারে।[২৮] অন্যান্য অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণীরাও প্লাজমোডিয়াম প্রজাতিসমূহ বহন করে, যেমন বিভিন্ন রকমের ইঁদুর, খুরওয়ালা প্রাণী এবং বাদুড় । এক্ষেত্রেও দেখা যায় যে প্লাজমোডিয়াম এর কিছু প্রজাতি এই পোষকগুলোর কোন কোনটাতে মারাত্মক রোগ ঘটাতে পারে, আবার কোনটাতে ঘটায় না।[২৯]
প্লাজমোডিয়াম এর দেড় শতাধিক প্রজাতি বিভিন্ন ধরনের পাখিকে সংক্রমিত করে। সাধারণতপ্লাজমোডিয়াম এর প্রতিটি প্রজাতিই একটি থেকে শুরু করে কয়েকটি প্রজাতির পাখিকে সংক্রমিত করতে পারে।[৩০] যেসব প্লাজমোডিয়াম পরজীবী পাখিদের সংক্রমিত করে, একটি নির্দিষ্ট পোষকে তারা বহুবছর ধরে বা পোষকটির পুরো জীবনকাল ধরে বেঁচে থাকতে পারে, যদিও কিছু ক্ষেত্রে প্লাজমোডিয়াম সংক্রমণ গুরুতর অসুস্থতা এবং দ্রুত মৃত্যু ঘটাতে পারে।[৩১][৩২] স্তন্যপায়ীদের সংক্রামক প্লাজমোডিয়াম প্রজাতিগুলো না থাকলেও, পাখিদের সংক্রমিত করে এমন প্রজাতিগুলো সারা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে।
প্লাজমোডিয়াম এর কতিপয় উপগণের প্রজাতিসমূহ বিচিত্রসব সরীসৃপকে সংক্রমিত করে। প্লাজমোডিয়াম পরজীবীসমূহ বেশিরভাগ টিকটিকি পরিবারগুলোতে বর্ণিত হয়েছে এবং পাখিদের পরজীবীর মতো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে রয়েছে।[৩৩] এক্ষেত্রেও, পরজীবীর কারণে মারাত্মক রোগ কিংবা পরজীবী ও পোষকের উপর নির্ভর করে আপাতদৃষ্টিতে অ্যাসিম্পটোমেটিক (বা উপসর্গহীন) হতে পারে।
মেরুদণ্ডী পোষকগুলোতে, বিশেষ করে মানুষের মধ্যে প্লাজমোডিয়াম সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বেশ কয়েক বছর ধরে বহুসংখ্যক ওষুধ বিকাশ লাভ করেছে। ১৭ শতক থেকে ২০ শতকের গোড়ার দিকে ব্যাপক প্রতিরোধ্যতা আবির্ভূত হওয়া অবধি কুইনাইন একটি সম্মুখ সারির অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ড্রাগ হিসেবে ব্যবহৃত হত।[৩৪] কুইনাইন রেজিস্ট্যান্স বিংশ শতাব্দীতে অসংখ্য অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ড্রাগের বিকাশ ত্বরন্বিত করেছে, যেমন- ক্লোরোকুইন, প্রোগুয়ানিল, অ্যাটোভাকুওন, সালফাডক্সিন/পাইরিমেথামিন, মেফলোকুইন এবং আর্টেমিসিনিন। সব ক্ষেত্রে, ওষুধ স্থাপনের কয়েক দশকের মধ্যেই প্রদত্ত ড্রাগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী পরজীবী উদিত হয়েছে। এটি মোকাবেলা করতে অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ড্রাগগুলো প্রায়শই সংমিশ্রণে ব্যবহৃত হয়, সাথে আর্টেমিসিনিন-নির্ভর সমন্বিত থেরাপিসমূহ বর্তমানে চিকিৎসার জন্য আদর্শ মানদণ্ড হিসেবে পরিগণিত হয়।[৩৫] সাধারণত, অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ড্রাগসমূহ মেরুদণ্ডী প্রাণীর লোহিত রক্তকণিকার মধ্যে থাকা প্লাজমোডিয়াম পরজীবীর ধাপগুলোকে লক্ষ্য করে, কারণ এসব ধাপের পরজীবীরাই রোগ সৃষ্টি করে থাকে। [৩৬] তবে, ভ্রমণকারীদের সংক্রমণ রোধ করতে এবং কীট পোষকে যৌন পর্যায়ের পরজীবীর সঞ্চালন রোধ করতে, পরজীবীর জীবনচক্রের অন্যান্য ধাপগুলোকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন ড্রাগের বিকাশ চলছে।[৩৭]
একটি মেরুদণ্ডী পোষক ছাড়াও, সমস্ত প্লাজমোডিয়াম প্রজাতি একটি রক্ত-খেকো কীট পোষককে সংক্রমিত করে, সাধারণত কোন মশাকে (যদিও কিছু সরীসৃপ-সংক্রামক পরজীবী বেলেমাছি দ্বারা বাহিত হয়)। কিউলেক্স, অ্যানোফিলিস, কিউলিসেটা, ম্যানসোনিয়া এবং এডিস গণের মশারা বিভিন্ন প্লাজমোডিয়াম প্রজাতির জন্য কীট পোষক হিসেবে কাজ করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অধ্যয়ন করা হয়েছে যাদের উপর তারা হল অ্যানোফিলিস মশা যা মানব ম্যালেরিয়ার প্লাজোডিয়াম পরজীবী এবং কিউলেক্স মশা যা পাখিদের পরজীবী বহন করে। শুধু স্ত্রী মশা অর্থাৎ মশকী প্লাজমোডিয়াম দ্বারা সংক্রমিত হয়, কারণ তারাই কেবল মেরুদন্ডী প্রাণীর রক্ত পান করে।[৩৮] বিভিন্ন প্রজাতি তাদের কীট পোষককে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। কখনো কখনো, প্লাজমোডিয়াম দ্বারা সংক্রমিত কীটের জীবনকাল এবং বাচ্চা উৎপাদনের ক্ষমতা হ্রাস পায়।[৩৯] এছাড়াও, প্লাজমোডিয়াম এর কয়েকটি প্রজাতি কীটপতঙ্গকে অ-সংক্রামিত পোষকের চেয়ে সংক্রামিত মেরুদণ্ডী পোষককে কামড়াতে উদ্দীপ্ত করে বলে মনে হয়।[৪০][৪১]
প্লাজমোডিয়াম প্রথম চিহ্নিত হয়েছিল ১৮৮০ সালে যখন শার্ল লুই আলফোঁস লাভরঁ ম্যালেরিয়া রোগীদের রক্তে অবস্থিত পরজীবীর বর্ণনা দিয়েছিলেন।[৪২] তিনি পরজীবীটির নামকরণ করেছিলেন Oscillaria malariae। ১৮৮৫ সালে ইতালির দুজন প্রাণিবিদ, এত্তরে মার্কিয়াফাভা এবং এঞ্জেলো চেল্লি পরজীবীটি পুণঃনিরীক্ষণ করেন। তাঁরা নতুন একটি গণের সদস্য হিসেবে এটিকে নামকরণ করেনপ্লাজমোডিয়াম, একই নামের এক প্রকার স্লাইম মল্ডের বহুনিউক্লিয়াসযুক্ত কোষের সাথে সাদৃশ্য থাকার কারণে।[৪৩] বিভিন্ন ধরনের ম্যালেরিয়া সৃষ্টিতে বিভিন্ন প্রজাতির ভূমিকা থাকতে পারে, এই বিষয়টি সর্বপ্রথম ক্যামিলো গলগি ১৮৮৬ সালে তুলে ধরেন। এর পরপরই জিওভান্নি বাতিস্তা গ্রাসি এবং রাইমন্ডো ফিলেত্তি, মানবদেহে ম্যালেরিয়া ঘটায় এমন দুটি ভিন্ন ধরনের পরজীবী Plasmodium vivax এবং Plasmodium malariae এর নামকরণ করেছিলেন। ১৮৯৭ সালে, উইলিয়াম ওয়েলচ Plasmodium falciparum চিহ্নিত করেন এবং নামকরণ করেন। এর পরে প্লাজমোডিয়াম এর অন্য দুটি প্রজাতি যারা মানুষকে সংক্রমিত করে, তারা স্বীকৃতি পায়: Plasmodium ovale (১৯২২) এবং Plasmodium knowlesi (১৯৩১ সালে চিহ্নিত হয় লম্বালেজি বানরে ; ১৯৬৫ সালে চিহ্নিত হয় মানুষে)। প্লাজমোডিয়াম এর জীবনচক্রে কীট পোষকের অবদানের কথা ১৮৯৭ সালে রোনাল্ড রস এবং ১৮৯৯ সালে জিওভান্নি বাতিস্তা গ্রাসি, অ্যামিকো বিগনামি ও জুসেপ্পে বাস্তিনেল্লি বর্ণনা করেছিলেন।
১৯৬৬ সালে, সিরিল গারনহাম পোষকের নির্দিষ্টতা এবং পরজীবীর অঙ্গসংস্থানের উপর ভিত্তি করে প্লাজমোডিয়াম কে নয়টি উপগণে আলাদা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।[২০]