বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে স্থাপিত হয়। এটি বাংলাদেশের সকল সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। মূলত সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এই সংস্থাটি সমন্বয়সাধন করে থাকে।
দেশভাগেরও আগে ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষার মান উন্নয়নকল্পে বিভিন্ন কমিশন ও রিপোর্ট প্রণয়ন করা হয়েছিলো। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো, হান্টার কমিশন, ১৮৮২, ভারতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কমিশন, ১৯০২, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন, ১৯১৭, স্যাডলার কমিশন, ১৯১৯ গঠিত হলেও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান আসেনি।[১] পরবর্তীতে দেশভাগের পর উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নকল্পে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে ৩রা জানুয়ারি, ১৯৫৭ সালে শিক্ষা পুনর্গঠন কমিশন গঠন করে; পাশাপাশি পুরো পাকিস্তানে পাকিস্তান জাতীয় শিক্ষা কমিশন, ১৯৫৯ বাস্তবায়ন করে; যা শরীফ শিক্ষা কমিশন, ১৯৫৯ নামে অত্যধিক পরিচিত। মূলত এই কমিশনই ব্যাচেলর ডিগ্রিকে তিন বছর এবং মাস্টার্স ডিগ্রিকে দুই বছর মেয়াদি করার প্রস্তাব দেয়।[২] বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর উচ্চ শিক্ষা, গবেষণার সর্বপরি শিক্ষা ব্যবস্থার মান্নোয়নে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সে মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে তৎকালীন ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১৯৭৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির ১০ নম্বর আদেশক্রমে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠিত হয়।[৩] মূলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়েই এ কমিশন গঠিত হয়। কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে ১৫ এপ্রিল, ১৯৭৩ সালে যোগদান করেন করেন মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী। প্রায় একই সময়ে ১৯শে এপ্রিল, ১৯৭৩ সালে এম ইন্নাস আলী এবং ২৮শে এপ্রিল, ১৯৭৩ সালে মুহম্মদ এনামুল হক কমিশনের পূর্ণকালীন সদস্য হিসেবে যোগদান করেন।[৪] পরবর্তীতে এই আদেশের ৪(১) নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধন করে একজন চেয়ারম্যান, ৫জন পূর্ণকালীন সদস্য এবং ৯ জন খণ্ডকালীন সদস্য নিয়ে কমিশন গঠিত হয়।[৫] এ কমিশনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সমন্বয়, নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা এবং বিকাশ ঘটানো। সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার মান রক্ষা এবং নিয়ন্ত্রণও এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। [৬] বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন সরকারকে উচ্চশিক্ষার সামগ্রিক বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকে।[৭] পরবর্তীতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।[৮] প্রস্তাবিত এই কমিশনের নাম দেওয়া হয়েছিল উচ্চশিক্ষা কমিশন।[৯]
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এর গঠনতন্ত্র নিম্নরূপ:[১০]
চেয়ারম্যান - ১ জন
পূর্ণকালীন সদস্য - ৫ জন
খণ্ডকালীন সদস্য - ৯ জন
খণ্ডকালীন সদস্যদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের উপাচার্যবৃন্দের মধ্য থেকে পর্যায়ক্রমে ৩ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অধ্যাপক ও ডিনদের মধ্য থেকে প্রতিনিধিত্বকারী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক মনোনীত সদস্য পর্যায়ক্রমে ৩ জন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মনোনীত সদস্য ৩ জন (শিক্ষা সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ের এক জন প্রতিনিধি ও পরিকল্পনা কমিশনের এক জন সদস্য) সমন্বয়ে কমিশন গঠিত হয়।[১১]
প্রথমদিকে আর্থিক বরাদ্দ এবং বিষয় অনুমোদনের মধ্যে কমিশনের কর্মকাণ্ড সীমিত থাকলেও বর্তমানে এর কাজ অনেক বিস্তৃত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– গবেষণা, স্কলারশিপ এবং ফেলোশিপ, ইউজিসি লাইব্রেরি এবং উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প।[১২]
শিক্ষকদের মৌলিক গবেষণার জন্য ইউজিসি অ্যাওয়ার্ড প্রবর্তন ছাড়াও বৃত্তি শাখার অধীনে ফেলোশিপ এবং স্কলারশিপ প্রক্রিয়া চালু আছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– ইউজিসি পিএইচডি ফেলোশিপ, ইউজিসি এমফিল ফেলোশিপ, ইউজিসি প্রফেসরশিপ, ইউজিসি মেধাবৃত্তি, প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফেলোশিপ, জনতা ব্যাংক মেধাবৃত্তি, কমনওয়েলথ স্কলারশিপ, কমনওয়েলথ একাডেমিক স্টাফ অ্যাওয়ার্ড, সার্ক স্কলারশিপ প্রদান করা হচ্ছে।[১৩]
ইউজিসি গঠনের প্রাক্কালেই লাইব্রেরি গঠনের কাজ শুরু হয়। প্রথমদিকে এই লাইব্রেরিকে রেফারেন্স লাইব্রেরি হিসেবে গড়ে তোলার কথা হলেও পরবর্তীকালে এই গ্রন্থাগারের মাধ্যমে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিয়ন ক্যাটালগ ও কেন্দ্রীয় জার্নাল লাইব্রেরি হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বর্তমান এ গ্রন্থাগারের সংগ্রহ ১২,৭৩৭ কপি । তন্মধ্যে বই ১০,৪৩৭টি, গবেষণা সন্দর্ভের (এম.ফিল ও পিএইচ.ডি) সংখ্যা ৬২০টি, গবেষণা প্রতিবেদনের সংখ্যা ১,২১০টি, জার্নাল ৪৭০টি। ২০১৫ সালে বই ১৪টি, গবেষণা সন্দর্ভ ২২টি, গবেষণা প্রতিবেদন ৬৫টি এবং জার্নাল ১০টি সংগৃহীত হয়েছে।[১৪]
বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় এ প্রকল্প শুরু হয়েছিলো, যেখানে মোট ব্যয় ছিলো ১ হাজার ৭২৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কারিগরি এবং প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধিতেই এই প্রকল্পের ভূমিকা ছিলো। এ প্রকল্পের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক গুণমান নিশ্চিতকরণ সেল (আইকিউএসি) গঠন করা হয়েছিলো।[১৫][১৬]
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের গবেষণাগারে ব্যবহৃত মূল্যবান বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিসমূহ যথাযথ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ল্যাবরেটরি কর্মীদের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৭৫ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক ইনস্টিটিউট অব সাইন্টিফিক ইন্সট্রুমেন্টেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়।[১৭] এছাড়াও নিচের ইনস্টিটিউটগুলোও ইউজিসির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা হয়।