বামন চিকা[১][২] | |
---|---|
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস | |
জগৎ/রাজ্য: | অ্যানিম্যালিয়া (Animalia) |
পর্ব: | কর্ডাটা (Chordata) |
শ্রেণি: | স্তন্যপায়ী (ম্যামেলিয়া) |
বর্গ: | Eulipotyphla |
পরিবার: | Soricidae |
গণ: | Suncus (সাভি, ১৮২২) |
প্রজাতি: | S. etruscus |
দ্বিপদী নাম | |
Suncus etruscus (সাভি, ১৮২২) | |
বামন চিকার আবাসস্থল (নীল — স্থানীয়, কালো — সম্ভাব্য আবাস কিন্তু অনিশ্চিত) |
বামন চিকা (বৈজ্ঞানিক নাম: Suncus etruscus) প্রাণিজগতে ওজনের দিক থেকে সবচেয়ে ছোট স্তন্যপায়ী, যার ওজন গড়ে প্রায় ১.৮ গ্রাম (০.০৬৩ আউন্স)।[৪][৫][৬][৭][৮] (কঙ্কালের আকার ও দেহের দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে সবচেয়ে ছোট স্তন্যপায়ী বাম্বলবি বাদুর।[৪][৯])
লেজ ছাড়া বামন চিকার দেহের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪ সেন্টিমিটার (১.৬ ইঞ্চি)। এটি অত্যন্ত দ্রুত চলাচল করে এবং এর বিপাকক্রিয়া অত্যন্ত দ্রুত হয়। এটি প্রতিদিন এর ওজনের ১.৫–২ গুণ খাদ্য গ্রহণ করে। বিভিন্ন মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণি, বিশেষত কীটপতঙ্গ খেয়ে বেঁচে থাকে। এমনকি এটি তার নিজের সমান আকারের প্রাণিও শিকার করতে পারে। ইঁদুরজাতীয় এই প্রাণিরা উষ্ণ ও স্যাঁতসেঁতে জায়গা পছন্দ করে। ১০° থেকে ৩০° উত্তর অক্ষাংশে ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকা থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত এরা বিস্তৃত। ভূমধ্যসাগরের মাল্টা দ্বীপপুঞ্জেও এদের পাওয়া যায়।[৩][৬] ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও নেপালে এদের দেখতে পাওয়া যায়। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সোনা মসজিদ এলাকায় বামন চিকার সন্ধান পাওয়া যায়।[১] যদিও বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এদের দেখা যায়, এবং কোনো প্রজাতিগত হুমকির সম্মুখীন নয়, তবুও কোনো কোনো দেশে এরা বিপন্ন প্রজাতি বলে চিহ্নিত।
বামন চিকার দেহ অত্যন্ত হালকা (অগ্রভাগ বিহীন নয়)। লেজ ছাড়া দেহের দৈর্ঘ্য ৩ থেকে ৫.২ সেমি (১.২ থেকে ২.০ ইঞ্চি) এর মধ্যে থাকে। এদের লেজ রুপালি রঙের[১] এবং দৈর্ঘ্যে প্রায় ২.৪ থেকে ৩.২ সেমি (০.৯৪ থেকে ১.২৬ ইঞ্চি)।[১০] দেহের ওজন ১.৩ গ্রাম (০.০৪৬ আউন্স)[৯] এবং ২.৫ গ্রাম (০.০৮৮ আউন্স) এর মধ্যে থাকে।[৫][১০] তবে সাধারণত এদের ওজন হয় ১.৮ গ্রাম (০.০৬৩ আউন্স)।[৪] তুলনায় বৃহৎ শ্বেতদন্ত চিকা (গ্রেটার হোয়াইট টুথেড শ্রিও) দৈর্ঘ্যে এদের দ্বিগুণ এবং ওজনে চার থেকে পাঁচগুণ পর্যন্ত বেশি হয়ে থাকে।[১০] বামন চিকার মাথা অপেক্ষাকৃত বড়, একটি লম্বা সঞ্চরণশীল শুঁড়যুক্ত। চোখ খুবই ছোট হওয়ায় খুব বেশি দেখতে পায় না।[১] ঘ্রাণ ও স্পর্শ দিয়ে খাদ্যের সন্ধান করে। দেহের পেছনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট।[১১] কানগুলো দেহের তুলনায় বড় ও স্ফীত।[১০] বামন চিকার হৃৎস্পন্দন গতি অত্যন্ত দ্রুত, এমনকি মিনিটে ১৫১১ বার (সেকেন্ডে ২৫ বার) পর্যন্ত হৃৎস্পন্দন হতে পারে। এদের হৃৎপিণ্ডও দেহের সাথে তুলনামূলক বড় হয়ে থাকে (দেহের ওজনের ১.২%)।[৪] পিঠ ও দুই পাশের লোম ফ্যাকাশে বাদামি, কিন্তু পেটের দিক ধূসর বর্ণের। শরত থেকে শীতকাল পর্যন্ত পুরোটা সময় লোম আরো ঘন ও মোটা হয়।[১০] বামন চিকার মোট ৩০টি দাঁত থাকে। কিন্তু উপরের চোয়ালের ৪র্থ মধ্যবর্তী দাঁত খুবই ছোট হয় (অসম্পূর্ণ থাকে), এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে থাকেই না।[৭] মুখের কাছে ছোট গোঁফের বিন্যাস দেখা যায়, যা বিশেষত রাতের বেলায় এদের শিকার খুঁজতে সাহায্য করে।[৮] পুরুষ ও স্ত্রী প্রাণির মধ্যে যৌন দ্বিরূপতা দেখা যায় না।[১১]
যৌন মিলনের সময় ব্যতীত বামন চিকারা সাধারণত একাকী থাকে। এদের জীবনকাল প্রায় দুই বছর, যদিও তা মোটামুটি অনিশ্চিত।[১০][১২] এরা তাদের আবাসস্থলকে নিরাপদ রাখার জন্য কিচিরমিচির শব্দ করে এবং আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমা প্রদর্শন করে।[১৩] খাদ্যগ্রহণ ব্যতীত এরা সর্বদাই চঞ্চল থাকে এবং জেগে থাকলে ও লুকিয়ে না থাকলে এরা সর্বদাই ইতস্তত ঘোরাফেরা করে। এরা খুবই স্বল্প সময়ের জন্য লুকায় এবং তা আধা ঘণ্টারও কম। পিঁপড়া ও ইঁদুরের গর্ত, এমনকি ঝরা পাতার নিচেও এরা লুকিয়ে থাকতে পারে।[১] এদের চলাচলের সময় ক্লিক শব্দ শোনা যায় এবং বিশ্রামের সময় এ ধরনের শব্দ পাওয়া যায় না।[১১] বামন চিকারা রাতের বেলার অধিক সক্রিয় থাকে এবং বেশ দূর পর্যন্ত যায়। দিনের বেলায় এরা বাসার আশেপাশে লুকিয়ে থাকে।[৭] ভোরের বেলায় এরা সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষম থাকে।[৩]
বামন চিকা অত্যন্ত দ্রুত চলাচল করতে পারে, প্রায় ৭৮০ প্রতি মিনিট (১৩ প্রতি সেকেন্ড)। শীতকালে এবং খাদ্যাভাব দেখা দিলে শক্তির অপচয় রোধ করার জন্য দেহের তাপমাত্রা প্রায় ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৫৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এ নামিয়ে আনে এবং অস্থায়ী শীতঘুমে কাটিয়ে দেয়। এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য মিনিটে ৩৫০০ (সেকেন্ডে ৫৮) বার জন্য কাঁপুনি দেয়।[৪] ফলে মিনিটে প্রায় ০.৮৩ °সে তাপমাত্রা পর্যন্ত হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মধ্যে সর্বোচ্চ। হৃৎস্পন্দনের হার সূচকীয়ভাবে ১০০ থেকে ৮০০–১২০০ বিট প্রতি মিনিট পর্যন্ত উঠে যায় এবং শ্বসনের হার ৫০ থেকে সরলরৈখিকভাবে ৫০ থেকে ৬০০–৮০০ বিট প্রতি মিনিটে উঠে যায়।[৫]
বামন চিকা প্রাথমিকভাবে মার্চ থেকে অক্টোবর মাসে যৌন মিলিত হয়, যদিও এরা বছরের যেকোনো সময় গর্ভধারণে সক্ষম। সাধারণত বসন্তকালে এরা জোড় বাঁধে, একে অপরকে বরদাস্ত করে এবং আবাসস্থলে দুইজন এবং তাদের বাচ্চারা একত্রে সময় কাটায়। গর্ভধারণকাল প্রায় ২৭–২৮ দিন। প্রতিবারে ২–৬টি বাচ্চার জন্ম হয়।[৩][১০] বাচ্চাগুলো নগ্ন ও অন্ধ অবস্থায় জন্মায়। জন্মের সময় এদের ওজন হয় প্রায় ০.২ গ্রাম (০.০০৭১ আউন্স)। ১৪ থেকে ১৬ দিন বয়সে এদের চোখ ফোটে, এবং এরা দ্রুত বড় হয়। মা চিকা ৯ থেকে ১০ দিন বয়সে এবং অন্য অসুবিধার ক্ষেত্রে শাবকদের অন্য স্থানে সরিয়ে নেয়। এরা ২০ দিন পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করে। তিন থেকে চার সপ্তাহ বয়সে শাবকেরা স্বাধীন হয়ে যায় এবং শীঘ্রই বয়ঃপ্রাপ্ত হয়।[৬][১০][১১]
বামন চিকা ১০° থেকে ৪০° উত্তর অক্ষাংশের মধ্যে ইউরেশিয়া অঞ্চলে পাওয়া যায়।[৪] দক্ষিণ ইউরোপের আলবেনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সাইপ্রাস, ফ্রান্স, উত্তর মেসিডোনিয়া, মাল্টা, মন্টেনেগ্রো, গ্রিস, ইতালি, পর্তুগাল, স্লোভেনিয়া, স্পেন ও তুরস্কে এদের পাওয়া যায়। এছাড়া অ্যান্ডোরা, জিব্রাল্টার ও মোনাকোয় এদের পাওয়া যেতে পারে। ইউরোপের কয়েকটি দ্বীপ যেমন ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে অন্য দেশ থেকে এদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে।[৩]
এছাড়া উত্তর আফ্রিকা (আলজেরিয়া, মিশর, লিবিয়া, মরোক্কো, তিউনিসিয়া) এবং আরব উপদ্বীপের আশেপাশের দেশে (বাহরাইন, ইসরায়েল, জর্ডান, লেবানন, ওমান, সিরিয়া ও সুকাত্রাসহ ইয়েমেন) এদের পাওয়া যায়। এশিয়ায় আফগানিস্তান, আজারবাইজান, ভুটান, চীন (শুধুমাত্র গেংমা দাই বিভাগে), মায়ানমার, জর্জিয়া, ভারত, ইরান, ইরাক, কাজাখস্তান, লাওস, মালয়েশিয়া (মালয়েশিয়ার বোর্নিও অংশে), নেপাল, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, তাজিকিস্তান, থাইল্যান্ড, তুর্কমেনিস্তান ও ভিয়েতনামে এদের দেখা যায়। পশ্চিম ও পূর্ব আফ্রিকা (গিনি, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া) এবং আর্মেনিয়া, ব্রুনাই, ইন্দোনেশিয়া, কুয়েত ও উজবেকিস্তানে এদের পাওয়া যেতে পারে বলে ধারণা করা হয়।[২][৬]
প্রজাতিটি সামগ্রিকভাবে বিস্তৃত এবং হুমকির সম্মুখীন না হলেও এই অঞ্চলে বসবাসকারী অন্যান্য প্রজাতির তুলনায় এর ঘনত্ব খুবই কম।[৩] কিছু কিছু অঞ্চলে এরা দুর্লভ, বিশেষত আজারবাইজান, জর্জিয়া (আঞ্চলিক লাল তালিকায় অন্তর্ভুক্ত), জর্ডান ও কাজাখস্তান (লাল তালিকাভুক্ত) প্রভৃতি দেশে।[৬]
২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বাংলাদেশে বামন চিকার সন্ধান পান।[১] চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সোনা মসজিদ এলাকার একটি আমবাগানে বামন চিকার সন্ধান পাওয়া যায়। এটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আবিষ্কৃত ক্ষুদ্রতম স্তন্যপায়ী।[১] ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও নেপালে এদের দেখা যাওয়ায় সিলেট অঞ্চলেও এরা থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
বামন চিকা উষ্ণ ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে লতাগুল্মের ঝোঁঁপে বসবাস করে। এভাবে এরা শিকারী শত্রুর হাত থেকে আত্মগোপন করে। পর্ণমোচী অরণ্যের পাশে খোলা ভূখণ্ড, চারণভূমি ও গুল্মের ঝোঁপে এরা বসবাস করে।[১০] সাধারণত এরা সমুদ্র সমতলে বাস করে। তবে পাহাড়ের পাদদেশ, পর্বতশ্রেণীর নিম্নদেশে বসবাসের জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের ৩,০০০ মি (৯,৮০০ ফু) উপরেও এদের পাওয়া গেছে।[১০] নদী ও হ্রদের তীরবর্তী ঝোঁপঝাড়ে ও চাষকৃত জমিতে (পরিত্যক্ত বাগান, ফলজ উদ্যান, আঙ্গুর ক্ষেত, জলপাই বাগান, ক্ষেতের আল) এরা কলোনি গঠন করে থাকে। তবে এরা অধিক চষা জমি এবং ঘন অরণ্য ও বালিয়াড়িতে বাসা বাঁধে না।[৩] এরা মাটিতে গর্ত করে বাস করে না। তাই প্রাকৃতিক গর্ত, চিড় বা ফাটলে এরা বাসা বাঁধে।[৬][৭] পাথর, নুড়ি, পাথরের দেয়াল ও ভগ্নাবশেষে এরা বহু সংখ্যায় বাস করে, এবং চারদিক দ্রুত নোংরা করে।[১০]
দেহতল ও দেহঘনত্বের উচ্চ অনুপাতের জন্য এদের বিপাক ক্রিয়া অত্যন্ত দ্রুত হয়। ফলে প্রতিদিন এদের দৈহিক ওজনের ১.৫–২.০ গুণ খাবার গ্রহণ করতে হয়। এরা ইঁদুরের মতো ফসল কাটে না। এরা বিভিন্ন অমেরুদণ্ডী প্রাণী, বিশেষত পোকা-মাকড়, লার্ভা, কেঁচো, এবং বিভিন্ন ধরনের উভচর, টিকটিকি, তীক্ষ্ণদন্তী প্রাণি ভক্ষণ করে। এরা দেহের প্রায় সমান আকারের প্রাণিও শিকার করতে পারে। নরম ও পাতলা বহিঃকঙ্কালবিশিষ্ট প্রাণি এরা বেশি পছন্দ করে। তাই এরা সাধারণত পিঁপড়া খায় না। সাধারণ অবস্থায় ঘাসফড়িং এরা প্রচুর শিকার করে।[১০] বড় শিকারকে এরা মাথার কাছে কামড়ে ধরে এবং তৎক্ষণাৎ ভক্ষণ করে। কিন্তু ছোট পোকামাকড়কে বাসায় নিয়ে যায়।[৬][৭][৮] শুঁড়ের মতো লম্বা নাক ও স্পর্শ দিয়ে এরা আশেপাশের পরিস্থিতি টের পায়।[১] অন্যদিকে, ছোট চোখের দৃষ্টিশক্তি খুবই দুর্বল হওয়ায় এরা শিকারের সময় দর্শনের চাইতে ঘ্রাণ ও স্পর্শানুভূতির ওপর অধিক নির্ভরশীল। ফলে এরা রাতে সহজে শিকার করতে পারে।[১১]
বামন চিকার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো মানুষের কর্মকাণ্ড, বিশেষত চাষবাসের জন্য এদের আশ্রয় ও আবাস ধ্বংস করায় এরা হুমকির সম্মুখীন। আবার জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষ করে অতিশীতল শীতকাল ও অত্যুষ্ণ গ্রীষ্মকালের জন্য বামন চিকা অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রজাতি।[৬] বামন চিকার প্রধান খাদক মূলত পেঁচাজাতীয় শিকারী পাখি।[৭][১১]