বালা হিসার দুর্গ | |
---|---|
قلعہ بالاحصار | |
![]() | |
প্রাক্তন নাম | সামির গড় |
সাধারণ তথ্যাবলী | |
ধরন | সাংস্কৃতিক |
অবস্থান | পেশাওয়ার, খাইবার পাখতুনখোয়া, পাকিস্তান |
দেশ | পাকিস্তান |
সম্পূর্ণ | ১৮৪৯ |
ভেঙ্গে ফেলা হয় | ১৮২৩ |
স্বত্বাধিকারী |
|
বালা হিসার (পশতু/উর্দু/হিন্দকো: قلعه بالاحصار), যা বালা হিসর নামেও পরিচিত, একটি ঐতিহাসিক দুর্গ যা পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের পেশাওয়ারে অবস্থিত। সপ্তম শতাব্দীর পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এই দুর্গের প্রথম উল্লেখ করেছিলেন। ১৭৪৭ সালে দুররানি সাম্রাজ্যের আফগান রাজা আহমদ শাহ দুররানি পেশাওয়ার দখল করার পর এটি রাজকীয় বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৭৫৮ সালে মারাঠারা পেশোয়ার দখলের সময় কিছু সময়ের জন্য দুর্গটি দখল করেছিল, কিন্তু দ্রুত আফগানদের দ্বারা পুনর্দখল করা হয়। ১৮২৩ সালের নওশেরা যুদ্ধের পর শিখরা দুর্গটি ধ্বংস করে নতুনভাবে পুনর্গঠন করে। ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দুর্গের বাইরের প্রাচীর পুনর্নির্মাণ করে।
বর্তমানে, এই দুর্গ পাকিস্তানের ফ্রন্টিয়ার কোরের সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।[১]
বালা হিসার (بالا حصار) শব্দটি দারি ফার্সি থেকে এসেছে। এর অর্থ "উঁচু বা উচ্চ দুর্গ।" ইতিহাসবিদ হুসাইন খানের মতে, আফগান সম্রাট তিমুর শাহ দুররানি এই নামটি দিয়েছিলেন।[২]
১৮৩৪ সালে, শিখরা এই দুর্গের নামকরণ করে সামির গড় বা সামিরগড়। সামির ছিল তিব্বতের কৈলাস পর্বতের আরেকটি নাম। এটি হিন্দু, বৌদ্ধ এবং শিখধর্মে পবিত্র বলে বিবেচিত। গড় শব্দের অর্থ হিন্দুস্তানিতে "দুর্গ।"[৩] তবে, এই নামটি জনপ্রিয় হয়নি এবং দ্রুত আবার "বালা হিসার" নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
মুঘল এবং সুরি সাম্রাজ্যের সময়ে এই দুর্গটি "বাগ্রাম দুর্গ" নামে পরিচিত ছিল। বাগ্রাম ছিল পেশাওয়ারের আরেকটি নাম।[২]
দুর্গটি পেশাওয়ার শহরের উত্তর-পশ্চিম দিকের একটি উঁচু টিলার উপর অবস্থিত। একসময় এটি পেশাওয়ারের প্রাচীন শহর থেকে বেশ দূরে ছিল। তবে এখন নতুন ভবন নির্মাণের কারণে পুরনো শহর ও দুর্গের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূর্ণ হয়ে গেছে। তবুও, দুর্গটির উঁচু টিলার উপর অবস্থিত হওয়ার কারণে এটি পেশাওয়ার শহর এবং পুরো পেশাওয়ার উপত্যকার একটি দৃষ্টিনন্দন এবং প্রভাবশালী দৃশ্য উপস্থাপন করে।
ইতিহাসবিদ আহমদ হাসান দানীর মতে, চীনের বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পর্যটক হিউয়েন সাঙ যখন ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে পেশাওয়ার ভ্রমণ করেন, তখন তিনি সেখানে একটি "রাজকীয় আবাস" দেখতে পান। তিনি এটিকে চীনা শব্দ কুং শিং বলে উল্লেখ করেন। এই শব্দটি তার গুরুত্ব বোঝাতে ব্যবহৃত হয় এবং এর অর্থ রাজপ্রাসাদের অবস্থান করা শহরের একটি সুরক্ষিত বা প্রাচীরঘেরা অংশ।[৪] হিউয়েন সাঙ পরে এই শহরটিকে পৃথকভাবে উল্লেখ করেন, যা তখন সুরক্ষিত ছিল না। এটি থেকে বোঝা যায় যে রাজপ্রাসাদ ছিল একটি দুর্গের কেন্দ্রস্থল। এই দুর্গটি সম্ভবত একটি পরিখা দিয়ে সুরক্ষিত ছিল। আহমদ হাসান দানী আরও বলেন, পুরনো বারা নদীর একটি শাখা উচ্চভূমি দ্বারা ঘেরা ছিল। এর মধ্যে বালা হিসার এবং ইন্দর শহর অন্তর্ভুক্ত। এই উচ্চভূমিটি সম্ভবত দুর্গ ছিল, যা বর্তমানে বালা হিসার নামে পরিচিত। মুঘল সম্রাট বাবরের সময়েও এই দুর্গ বিদ্যমান ছিল, যাকে তিনি বাগ্রাম দুর্গ বলে উল্লেখ করেছিলেন।[২]
১৭৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আহমদ শাহ দুররানি পেশাওয়ার দখল করার পর থেকে এই দুর্গ দুররানি সাম্রাজ্যের রাজকীয় আবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আফগান রাজা তিমুর শাহ দুররানি (১৭৭৩–১৭৯৩) তার সাম্রাজ্যের শীতকালীন রাজধানী হিসেবে এই দুর্গ ব্যবহার করতেন। ১৯শ শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত পেশোয়ার আফগান সাম্রাজ্যের শীতকালীন রাজধানী ছিল এবং বালা হিসার আফগান রাজাদের রাজকীয় আবাস ছিল।
পেশাওয়ারের যুদ্ধ ১৭৫৮ সালের ৮ মে হিন্দু মারাঠা সাম্রাজ্য এবং দুররানি সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে মারাঠারা বিজয় অর্জন করে এবং পেশাওয়ার দখল করে। যুদ্ধটি মরাঠাদের জন্য একটি বিশাল সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। তারা পেশাওয়ারের দুর্গের ওপর ভগওয়া ঝান্ডা (গেরুয়া পতাকা) উত্তোলন করে। এই বিজয়ের মাধ্যমে তাদের শাসন পুনে থেকে দিল্লি হয়ে পেশাওয়ার পর্যন্ত এবং দুররানি সাম্রাজ্যের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এর আগে পেশাওয়ারের দুর্গটি তিমুর শাহ দুররানি এবং জাহান খানের নেতৃত্বাধীন দুররানি বাহিনী রক্ষা করছিল। মরাঠা সেনাদের কাছে পরাজয়ের পর তিমুর শাহ দুররানি এবং জাহান খান দুর্গ ছেড়ে চলে যায়। এরপর মরাঠারা দুর্গ দখল করে এবং নিয়ন্ত্রণ নেয়।[৫] এই বিজয় মরাঠাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি তাদের শাসন পুনে থেকে প্রায় ২০০০ কিলোমিটার দূরে আফগানিস্তানের সীমান্ত পর্যন্ত প্রসারিত করে।[৬][৭][৮][৯]
১৮২৩ সালের মার্চ মাসে শিখরা পেশাওয়ারের নওশেরা যুদ্ধে আফগানদের পরাজিত করে।
এরপর শিখরা আফগান রাজকীয় দরবার ও বালা হিসার দুর্গ ধ্বংস করে।[১০] শীঘ্রই শিখদের প্রধান সেনাপতি হরি সিং নলওয়া দুর্গটির পুনর্গঠন শুরু করেন।[১১]
১৮৪৫-৪৬ সালের প্রথম আংলো-শিখ যুদ্ধ-এর পর ১৮৪৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বালা হিসারের বাইরের প্রাচীর পুনর্নির্মাণ করে।
বর্তমানে এই দুর্গ ফ্রন্টিয়ার কর্পস নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি আধা-সামরিক ইউনিটের অধীনে ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রাদেশিক সরকার বালা হিসার দুর্গকে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করার উদ্দেশ্যে এটি ফ্রন্টিয়ার কর্পসের নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেদের হাতে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।[১২] দুর্গটি পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে (শনিবার কেবল পরিবারের জন্য এবং রবিবার সবার জন্য, পরিবারসহ বা পরিবার ছাড়াই)। প্রবেশের জন্য কোনো খরচ নেই। তবে, পর্যটকদের তাদের সিএনআইসি (জাতীয় পরিচয়পত্র) নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যটকদের পাসপোর্ট সঙ্গে আনতে বলা হয়েছে। দুর্গে একটি ফ্রন্টিয়ার কর্পস জাদুঘরও রয়েছে। এখানে ফ্রন্টিয়ার কর্পসের শুরু থেকে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত ইউনিফর্ম এবং বিভিন্ন স্থানীয় ইউনিটের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শন করা হয়। তবে, বর্তমান করোনার কারণে দুর্গটি সব ধরনের দর্শনার্থীদের জন্য সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল।