বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান |
---|
নিম্নোক্ত বিষয়ের উপর একটি ধারাবাহিকের অংশ |
বিবর্তন সম্পর্কিত চিন্তাভাবনার শিকড় রয়েছে অনাদিকালেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রজাতির পরিবর্তন ঘটে – এই ধারণার সূত্র পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রিস, রোম, চীন এবং মধ্যযুগের ইসলামী বিজ্ঞানে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে জীববিজ্ঞানে ট্যাক্সোনমি বা শ্রেণীবিন্যাসবিদ্যার উদ্ভবের পরে দুটি পরস্পরবিরোধী মতবাদ পাশ্চাত্ত্য জীববিজ্ঞান চিন্তাভাবনায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। প্রথমটি হল এসেন্সিয়ালিজম বা ‘অপরিহার্য্যবাদ’, এই মতবাদ অনুযায়ী প্রতিটি প্রজাতির কিছু অপরিহার্য্য বৈশিষ্ট্য থাকে যা অপরিবর্তনীয়। এই মতবাদের উদ্ভব হয়েছিল মধ্যযুগীয় এরিস্টটল-অনুসারী অধিবিদ্যা থেকে, যা কিনা প্রাকৃতিক থিওলজি বা ধর্মবিদ্যার সঙ্গে খাপ খেয়ে যেত। দ্বিতীয় মতবাদটি ছিল আধুনিক বিজ্ঞানের, ইউরোপের আলোকিত যুগে প্রাকৃতিক ইতিহাস, পদার্থ বিজ্ঞান এবং বিশ্বতত্ত্বের প্রসারের সঙ্গে যার উৎপত্তি। এই সময়েই প্রকৃতিবিদরা প্রজাতির বিভিন্নতা সম্বন্ধে সচেতন হলেন; জীবাশ্মবিজ্ঞানের প্রসারের ফলে জানা গেল প্রজাতির বিলুপ্তি সম্ভব, যা কিনা প্রকৃতির নিত্যতার ধারণার বিপরীত। ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকে ফরাসী প্রকৃতিবিদ জঁ-বাতিস্ত লামার্ক (১৭৪৪-১৮২৯) ট্রান্সমিউটেশন অফ স্পিসিস বা ‘রূপান্তরবাদ’ তত্ত্বের অবতারণা করেন, এই তত্ত্বই ছিল বিবর্তন সম্পর্কিত প্রথম একটা সম্পূর্ণ তত্ত্ব।
১৮৫৮ সালে চার্লস ডারউইন এবং আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস এক নতুন বিবর্তনের তত্ত্বের প্রস্তাবনা করেন, বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয় ডারউইনের অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস (১৮৫৯) বইতে। লামার্কের বিপরীতে গিয়ে তারা বলেন ‘কমন ডিসেন্ট’ আর জীবনবৃক্ষের শাখাবিন্যাসের কথা, তার অর্থ হল জীবনবৃক্ষের শাখা ধরে উপরের দিকে উঠলে যেকোনও দুটি ভিন্ন প্রজাতিরই কোনো একটি সাধারণ উৎপত্তিস্থল পাওয়া সম্ভব। ডারউইন-ওয়ালেস তত্ত্বের মূল বিষয় ছিল প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া; পশুপালন, জীবভূগোল, ভূতত্ত্ব, অঙ্গসংস্থান ও ভ্রূণবিদ্যা র বিস্তৃত পরিসর থেকে পাওয়া বিভিন্ন প্রামাণিক তথ্য সংশ্লেষ করে এই তত্ত্ব নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই এই তত্ত্ব নিয়ে তুমুল বিতর্কের বাতাবরণে বিবর্তনের সাধারণ ধারণাটা সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে পড়ে, যদিও বিবর্তনের পদ্ধতি হিসেবে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বীকৃতি এসেছে অনেক দেরিতে, ১৯২০-১৯৪০ সালের মধ্যে জীববিজ্ঞানের প্রভূত অগ্রগতির পরে। এর মাঝের সময়ে, অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ (নব্য-লামার্কবাদ), আভ্যন্তরীণ চালিকাশক্তির প্রভাব (অর্থোজেনেসিস), আকস্মিক পরিব্যক্তি (স্যালটেশন), ইত্যাদি একাধিক বিকল্প মতবাদের চাপে ডারউইনের তত্ত্ব প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছিল। এই ১৮৮০-১৯২০ সালের মধ্যের সময়টাকে ডারউইনের তত্ত্বের গ্রহণকাল বলে উল্লেখ করা হয়।[২] মটরশুঁটি নিয়ে গ্রেগর জোহান মেন্ডেল এর ঊনবিংশ শতকে করা কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল পুনরাবিষ্কৃত হয় ১৯০০ সালে, আর ১৯১০ থেকে ১৯৩০ এর মধ্যে রোনাল্ড ফিশার, জে বি এস হ্যালডেন, সিউয়েল রাইট প্রমুখ বিজ্ঞানীরা এই ফলাফলকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের সঙ্গে সংযুক্ত করে একটা সম্পূর্ণ নতুন বিষয়, পপুলেশন জেনেটিক্স, এর গোড়াপত্তন করেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ এর মধ্যে এই পপুলেশন জেনেটিক্স বিদ্যা জীববিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিবর্তনের একটা সর্বব্যাপী তত্ত্ব খাড়া করে, যাকে বর্তমানে বলা হয় আধুনিক বিবর্তনিক সংশ্লেষণ।
বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান এর প্রতিষ্ঠা, প্রাকৃতিক জনগোষ্ঠীতে পরিব্যক্তি এবং জিনগত বৈচিত্র্যের জ্ঞান, তার সঙ্গে জীবভূগোল ও সিস্টেমেটিক্স এর মিলিত সমন্বয়ে বিবর্তনের উন্নত গাণিতিক মডেল তৈরী হয়। জীবাশ্মবিজ্ঞান ও তুলনামূলক শারীরসংস্থানবিদ্যার প্রয়োগে জীবনের বিবর্তনের ইতিহাস পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়। ১৯৫০ এর দশকে আণবিক জিনতত্ত্ব র উদ্ভবের সঙ্গে প্রোটিনের অনুক্রম এবং রোগপ্রতিরোধশক্তির অনুপুঙ্খ পাঠের ফলে নতুন অধ্যয়ন ক্ষেত্র ‘মলিকিউলার ইভোলিউশন’ বা আণবিক বিবর্তনের উদ্ভব হয়, পর্বতীকালে এর সঙ্গে যুক্ত হয় আরএনএ এবং ডিএনএ চর্চা। ১৯৬০ এর দশকে চর্চার কেন্দ্রে আসে বিবর্তনের জিন-কেন্দ্রিক দর্শন আর আণবিক বিবর্তনের ‘নিউট্রাল থিওরি’ বা নিরপেক্ষতা তত্ত্ব। বিতর্ক দানা বাঁধে অভিযোজন আর ‘ইউনিট অফ সিলেকশন’ বা নির্বাচনের একক নিয়ে। বিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচন আর ‘জেনেটিক ড্রিফট’ এর তুলনামূলক গুরুত্ত্ব নিয়েও বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরী হয়।[৩] বিংশ শতকের শেষের দিকে ‘ডিএনএ সিকোয়েন্সিং’, আর তা থেকে ‘মলিকিউলার ফাইলোজেনেটিক্স’ এর উদ্ভব হয়, মার্কিন বিজ্ঞানী কার্ল উইস এর ত্রি-ডোমেইন তন্ত্রে জীবনবৃক্ষের ধারণা নতুন করে স্বীকৃত হয়। এছাড়াও নতুন উপলব্ধ জ্ঞান, ‘সিমবায়োজেনেসিস’ এবং অনুভূমিক জিন স্থানান্তর, বিবর্তনের তত্ত্বে আরও জটিলতার আমদানি করে। বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের উত্থান যে শুধু জীববিজ্ঞানের চিরাচরিত শাখাগুলিকেই সমৃদ্ধ করেছিল তাই নয়, অন্যান্য অধ্যয়ন ক্ষেত্রে (যেমন: নৃতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, ইত্যাদি) এবং বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রেও এর প্রভাব অপরিসীম।[৪]
এক প্রজাতির প্রাণী, এমনকি মানুষও, যে অন্য কোনও প্রজাতির প্রাণী থেকেই উদ্ভূত, এই ধারণার ঐতিহাসিক অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় সক্রেটিস পূর্ববর্তী গ্রিক দর্শনেও। অ্যানাক্সিমান্দার অফ মিলেটাস (খ্রীষ্টপূর্ব ৬১০ - ৫৪৬) প্রস্তাব করেন যে অতীতে পৃথিবী ছিল জলমগ্ন আর স্থলবাসী মানবজাতির পূর্বপুরুষের উদ্ভব ঘটে জলেই। তিনি মনে করতেন বর্তমান মানুষ নিশ্চই অন্য কোনও প্রজাতির সন্তান, খুব সম্ভবত মাছের; কারণ মানুষের সন্তানদেরও দীর্ঘ সময় ধরে পরিচর্যা প্রয়োজন।[৫][৬][৭] ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগে এসে অ্যানাক্সিমান্দার ‘প্রথম ডারউইনবাদী’ হিসাবে সমাদৃত হন, যদিও বর্তমানে তার করা শ্রেণিবিভাগের আর গ্রহণযোগ্যতা নেই।[৮] অ্যানাক্সিমান্দারের প্রস্তাবনাকে প্রাথমিক বিবর্তনবাদ বলাই যায়, যদিও প্রকৃত অর্থে ডারউইনের মতবাদের সঙ্গে তার মিল সামান্যই।[৮]
এমপেডোকলে (খ্রীষ্টপূর্ব ৪৯০ - ৪৩০) মনে করতেন জন্ম ও মৃত্যু হল নশ্বর বস্তুর উপাদানগুলির সংমিশ্রণ ও পৃথকীকরণ।[৯] বিশেষ করে প্রথম যুগের প্রাণী ও উদ্ভিদরা তাদের বর্তমান অবস্থারই টুকরো অংশ, ভ্রূণ গঠনের সময়ে বিভিন্ন সমবায়ে যুক্ত এবং সংমিশ্রিত হয়ে তারা আজকের অবস্থায় এসেছে। তবে তিনি এটাও ভাবতেন, এই যে ঘটনাক্রমে একদম যথাযথভাবে সংযুক্ত হয়ে যাওয়া, এর পেছনে নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট অভিপ্রায় আছে।[১০] এইসময়ের অন্যান্য প্রভাবশালী দার্শনিকরা, যেমন প্লেটো (খ্রীষ্টপূর্ব ৪২৮/৪২৭ - ৩৪৮/৩৪৭), এরিস্টটল (খ্রীষ্টপূর্ব ৩৮৪ - ৩২২), এবং স্টোয়িক মতগোষ্ঠীর দার্শনিকরা, বিশ্বাস করতেন শুধু প্রাণীরাই নয়, এই বিশ্বের সমস্ত কিছুই ঈশ্বরের পরিকল্পনার ফসল!
প্লেটো বিশ্বাস করতেন অপরিহার্য্যবাদে, যার অন্য নাম ‘থিওরি অফ ফর্মস’! এই তত্ত্ব অনুযায়ী প্রাকৃতিক সমস্ত বস্তুরই একটা আদর্শ আকার বা গঠন আছে, আর দৃশ্যজগতের সবকিছু সেই আদর্শ আকারেরই একটা অসম্পূর্ণ প্রকাশ! প্লেটো নিজের ‘টাইমিয়াস’ গ্রন্থে একটি চরিত্রের মাধ্যমে বলেন যে এই বিশ্বব্রহ্মান্ড এবং তার অন্তর্গত সমস্ত কিছুই নির্মাণ থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণ করছেন ‘ডেমিয়ার্জ’, আর যেহেতু তিনি ঈর্ষার ঊর্ধ্বে, তাই তিনি চান সমস্ত কিছু যেন যথাসম্ভব তারই মতো ত্রুটিহীন হয়। সৃষ্টিকর্তা এমনভাবে জীবনের সমস্ত অনুধাবনযোগ্য আকার সৃষ্টি করেছেন যাতে তাদের অভাবে এই জগৎ অসম্পূর্ণ থেকে যায়; সৃষ্টিকে ত্রুটিমুক্ত হতে হলে তার মধ্যে যেন সমস্ত ধরনের প্রাণীকে অন্তর্ভুক্ত থাকতেই হবে! এই ‘থিওরি অফ প্লেনিচিউড’ বা প্রাচুর্য্যের তত্ত্ব - নিখুঁত সৃষ্টির জন্য জীবনের সমস্ত সাম্ভাব্য রূপ অত্যাবশ্যক - পরবর্তীকালের খ্রিস্টীয় ধ্যানধারণাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল।[১১] তাই বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী আর্নস্ট মায়র প্লেটোকে বিবর্তনবাদের দুনিয়ার ‘অ্যান্টিহিরো’ বলে উল্লেখ করেছেন।[১২] যদিও কিছু কিছু বিজ্ঞান ঐতিহাসিক ভবিষ্যতের প্রাকৃতিক দর্শনের ওপর প্লেটোর প্রভাবের গুরুত্ত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। যুক্তিস্বরূপ তারা বলেন, প্লেটো পরবর্তী অনেক দার্শনিকই বিশ্বাস করতেন প্রজাতির পরিবর্তন ঘটে, আর প্রজাতির অপরিবর্তনীয়তার ধারণা গুরুত্ত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রধানত সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে, ট্যাক্সোনমি বা শ্রেণীবিন্যাসবিদ্যার উদ্ভবের পরে।[১৩]
প্রভাবশালী গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল ছিলেন প্লেটোর ছাত্র, তিনি প্রাকৃতিক ইতিহাসবিদদের মধ্যে প্রাচীনতম ব্যক্তি যার কাজ অনেকটাই সংরক্ষিত আছে। ঈজিয়ান সাগরে অবস্থিত লেসবস দ্বীপে করা গবেষণার ভিত্তিতে লেখা তার চারটে বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়, বইগুলি প্রধানত তাদের ল্যাটিন নাম দিয়েই পরিচিত - দে অ্যানিমা (আত্মা সম্বন্ধীয়), হিস্টোরিয়া অ্যানিম্যালিয়াম (প্রাণী ইতিহাস সম্বন্ধীয়), দে জেনেরাশনে অ্যানিম্যালিয়াম (প্রাণী প্রজন্ম সম্বন্ধীয়) এবং দে পারটিবাস অ্যানিম্যালিয়াম (প্রাণী অংশ সম্বন্ধীয়)। নিখুঁত পর্যবেক্ষণের সঙ্গে শারীরবৃত্তীয় কার্যক্ষমতা সম্পর্কে নিজের তত্ত্বের মিশ্রণ ঘটিয়ে এরিস্টটল এই বইগুলি লেখেন।[১৪] ব্রিটিশ বিজ্ঞান ইতিহাসবিদ চার্লস সিঙ্গারের মতে এরিস্টটলের কাজে সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল যে অপরিসীম অধ্যবসায়ে তিনি সমস্ত প্রাণীদের স্কালা নেচারি বা ‘জীবনের সিঁড়ি’তে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন।[১৪] হিস্টোরিয়া অ্যানিম্যালিয়াম এ বর্ণিত এই স্কালা নেচারি-তে প্রাণীদের একটা স্থায়ী ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ রয়েছে বলে দাবি করা আছে। এই ‘অস্তিত্বের মহাশৃঙ্খল’-এ প্রাণীরা তাদের ক্রিয়া ও গঠনের জটিলতা অনুযায়ী ওপর থেকে নিচে সজ্জিত আছে, অর্থাৎ যে প্রাণীদের জীবনীশক্তি বেশি এবং চলনক্ষম, তাদের 'উচ্চতর' প্রাণী স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।[১১] এরিস্টটল বিশ্বাস করতেন, আলাদা আলাদা প্রাণীদের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য থেকেই ‘চূড়ান্ত উদ্দেশ্য’ অনুমান করা সম্ভব, কারণ তাদের নির্দিষ্ট গঠন তাদের কার্যকারিতার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে মানানসই।[১৫] তিনি জীবনের আকস্মিক উৎপত্তি সম্পর্কিত এমপেডোকলের মতবাদ বিশেষকরে খারিজ করে দেন।[১৬]
গ্রিক দার্শনিক জেনো অফ সাইটিয়াম (খ্রীস্টপূর্ব ৩৩৪ - ২৬২) স্টোয়িক দার্শনিক মতগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেন। তিনিও এরিস্টটল ও অন্যান্য পূর্ববর্তী দার্শনিকদের সঙ্গে একমত ছিলেন। প্রকৃতি পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয় যে এই জগতের সৃষ্টির পেছনে একটা পরিকল্পনা আছে - এই মতবাদই টেলিওলজি বা উদ্দেশ্যবাদ বলে পরিচিত।[১৭] রোমান স্টোয়িক দার্শনিক সিসারো (খ্রীষ্টপূর্ব ১০৬ - ৪৩) লিখে গেছেন যে জেনো এই মতবাদেই বিশ্বাসী ছিলেন। তার কথায় - পৃথিবীকে নিরাপদ রাখার জন্য প্রকৃতি নির্দেশিত হয়েছে, এমনভাবে গঠিত হয়েছে যা টিঁকে থাকার জন্য সর্বোত্তম।[১৮]
এপিকুরোস (খ্রীষ্টপূর্ব ৩৪১ - ২৭০) প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণা পূর্বানুমান করতে পেরেছিলেন বলে মনে করা হয়। তার অনুগামী রোমান পরমাণুবাদী দার্শনিক লুক্রেতিউস (খ্রীষ্টপূর্ব ৯৯ - ৫৫) তার লেখা দে রেরাম নেচুরা (বস্তুর প্রকৃতি সম্বন্ধীয়) কবিতায় এই ধ্যানধারণা প্রকাশ করে গেছেন। গ্রিক পুরাণে বর্ণিত দেবী গাইয়া -র থেকে সজীব বস্তুরা সৃষ্টি হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কিন্তু তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ক্রিয়াশীল প্রাণীগুলিই বংশবিস্তার করতে পেরেছে। এপিকুরিয়ান দার্শনিকদের কাছে বিবর্তনের সম্পূর্ণ তত্ত্বের ধারণা ছিলনা, তারা আলাদা আলাদা প্রাণীদের জন্য আলাদা আলাদা অ্যাবায়োজেনেসিস বা জীবনের উৎপত্তি সংক্রান্ত তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন।
প্রাচীন চীনদেশের তাও বাদী দার্শনিক ঝুয়াং ঝাউ (খ্রীস্টপূর্ব ৩৬৯ - ২৮৬) প্রজাতির পরিবর্তন নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছিলেন। চীনা বিজ্ঞানের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ জোসেফ নিধ্যামের মতে তাওবাদে প্রজাতির অপরিবর্তনশীলতার তত্ত্ব একেবারেই খারিজ করা হয়েছে এবং কল্পনা করা হয়েছে যে প্রজাতিরা পরিবেশ অনুযায়ী নিজেদের পরিবর্তন করে নেয়।[১৯] পশ্চিমি দর্শনতত্ত্বের একেবারে বিপরীতে গিয়ে তাওবাদে মানুষ, প্রকৃতি ও স্বর্গের মধ্যে নিত্য রূপান্তরের কথা বলা হয়েছে, এই পদ্ধতির নামই হল তাও।[২০]
গ্রিক এপিকুরিয়ান দার্শনিকদের ধারণায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, জীবিত বস্তুসমূহ এবং মানবসমাজ, সবকিছুই কোনরকম অতিপ্রাকৃত শক্তির সাহায্য ছাড়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত, তাদের এই মতবাদ পরবর্তীকালে রেনেসাঁস যুগের মুক্ত চিন্তাভাবনাকেও প্রভাবিত করেছিল।[২১][২২] কিন্তু রোমান স্টোইক মতগোষ্ঠীর দার্শনিকরা, যেমন সিসারো, সেনেকা (খ্রীস্টপূর্ব ৪ - ৬৫ খ্রীস্টাব্দ), প্লিনি (২৩ - ৭৯ খ্রীস্টাব্দ), এরা সকলেই টেলিওলজি বা উদ্দেশ্যবাদে প্রবল বিশ্বাসী ছিলেন এবং খ্রীস্টীয় ধর্মবিশ্বাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন।[১৭] সিসারোর বিবরণ অনুযায়ী হেলেনিস্টিক গ্রিসের অভিজাতবর্গও এই স্টোইক মতবাদকেই মেনে নিয়েছিলেন।[১৮]
প্রাচীন গ্রীক ধ্যাণধারণা অনুসরণ করেই তৃতীয় শতাব্দীর খ্রীস্টান দার্শনিক চার্চ ফাদার অরিগেন অফ আলেকজান্দ্রিয়া বলেন যে বাইবেলের সৃষ্টি সম্পর্কিত কাহিনীগুলোকে আক্ষরিক বা ঐতিহাসিক অর্থে না নিয়ে রূপক হিসাবে গ্রহণ করা উচিত।[২৩][২৪]
কোনও বোধসম্পন্ন মানুষ কীভাবে ভাবতে পারেন যে প্রথম, দ্বিতীয়, এমনকি তৃতীয় দিনেও, সকাল থেকে সন্ধ্যে, কোনও চন্দ্র, সূর্য, বা তারা ছিলই না? আর প্রথম দিনে নাকি আকাশই ছিলনা? মানুষ কি এতই নির্বোধ যে ভাববে ভগবান যেন এক কৃষক, স্বর্গোদ্যানটা বপন করে দিলেন পূর্বদিকে, তার মধ্যে জীবনবৃক্ষটা এমন ভাবে রেখে দিলেন যাতে কেউ সহজেই সেটা হাতের কাছে পেয়ে যায় আর ফলটা পেড়ে নিয়ে কামড়েও ফেলতে পারে? আবার সেই ফলটা চিবিয়ে ফেলে যাবতীয় ভালমন্দের ভাগীদারও হয়ে যায়? আর যদি ভগবান সন্ধ্যেবেলা স্বর্গে বেড়াতে বেরোন আর আদমকে তাই গাছের তলায় লুকিয়ে পড়তে হয়, তাহলে এ নিয়ে কোনো সন্দেহই থাকা উচিত নয় যে এ সবই আসলে আলঙ্কারিক অর্থে, একটু ধাঁধার মত করে বলা, একে ইতিহাস হিসাবে আক্ষরিক অর্থে নেওয়া অনুচিত।
— অরিগেন, অন দ্য ফার্স্ট প্রিন্সিপলস IV.16
অরিগেনকে অনুসরণ করেই, চতুর্থ শতকের বিশপ ও ধর্মবিদ অগাস্টিন অফ হিপো যুক্তি দিলেন যে বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বকে একেবারে আক্ষরিক অর্থে দেখা ঠিক নয়। দে জেনেসি অ্যাড লিটেরাম (সৃষ্টিতত্ত্বের আক্ষরিক অর্থ প্রসঙ্গে) বইতে তিনি বললেন যে হয়ত কিছু ক্ষেত্রে পুরোনো জীবের ‘অবশেষ’ থেকেই নতুন জীবের সৃষ্টি হয়।[২৫] অগাস্টিনের মতে দেবদূত, মহাকাশ, বা মানবাত্মার প্রকাশ নিখুঁত হলেও “উদ্ভিদ, পক্ষী, ও জীবজন্তুর গড়ন ত্রুটিহীন নয়... অনেক সম্ভাবনা নিয়ে তৈরী।”[২৬] অগাস্টিনের ধারণায় জীবনের রূপ ধীরে হলেও সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়, তাই রোমের পন্টিফিকাল সান্তা ক্রসে ইউনিভার্সিটির ধর্মবিদ্যার প্রফেসর গিসেপ তানজেলা-নিত্তি অগাস্টিনকে একধরনের বিবর্তনবাদের প্রস্তাবক হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।[২৭][২৮]
ফ্রম দা গ্রিকস টু ডারউইন (১৮৯৪) গ্রন্থে হেনরি ফেয়ারফিল্ড অসবর্ন লিখেছেনঃ
বিবর্তনবাদের প্রকাশ্যে আসার জন্য ঊনবিংশ শতক অপেক্ষা করতে হতই না যদি চার্চের শিক্ষাদান পদ্ধতির মধ্যে যদি অগাস্টিনের চিন্তাভাবনা কোনভাবে থেকে যেত, অন্ততপক্ষে অষ্টাদশ শতকে এটা এসেই যেত আর প্রকৃতির সত্য নিয়ে এত বিতর্ক উঠতই না.... বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বে লেখা প্রাণী ও উদ্ভিদের সরাসরি সৃষ্টির কাহিনীকে অগাস্টিন প্রাথমিক কার্যকারণ এবং এরিস্টটলের অসম্পূর্ণ থেকে সম্পূর্ণে ধারাবাহিক ক্রমবিকাশের ধারণার আলোকে দেখেছিলেন। এই বহুল প্রভাবশালী শিক্ষকের অভিমত খুব ভালো খাপ খেয়ে যায় বর্তমানের প্রগতিশীল ধর্মবিদদের সঙ্গে যারা বিবর্তনকে স্বীকার করেন।[২৯]
বিবর্তন সম্পর্কিত প্রাচীন এই ধ্যানধারণার সংরক্ষণের জন্য অগাস্টিনের প্রচেষ্টা নিয়ে খ্রিস্টান সমাজে বিজ্ঞান ও ধর্মবিদ্যার মধ্যে সংগ্রামের ইতিহাস (১৮৯৬) গ্রন্থে এন্ড্রু ডিকেন্স হোয়াইট লিখে গিয়েছেনঃ
প্রাচীনকাল থেকেই সর্বজনগ্রাহ্য একটা মতবাদ ছিল যে কীট-পতঙ্গাদি ছোট ছোট প্রাণীদের সৃষ্টি করার ক্ষমতা স্বয়ং ঈশ্বরই জল, আবর্জনা, আর গলিত মাংসের হাতে দিয়ে রেখেছেন। সেন্ট অগাস্টিন সহ বেশ কিছু ফাদার এই মতবাদকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন একটাই কারণে যে এই মতবাদ মানলে সৃষ্টিকর্তার ভূমিকা থেকে ঈশ্বরকে রেহাই দেওয়া যায়, আদমকে রেহাই দেওয়া যায় নামকারকের ভূমিকা থেকে আর নোয়াকেও তার আর্কে এইসব অগণিত ঘৃণ্য প্রাণীদের সঙ্গে বাস করতে হয়না![৩০]
অগাস্টিন তার দে জেনেসি কন্ট্রা মেনিকীওস গ্রন্থে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে বলেছেন - “ঈশ্বর মানুষকে নিজের হাতে ধুলো থেকে তৈরী করেছেন, এটা একটা খুবই শিশুসুলভ ধারণা... ঈশ্বর না তো এইভাবে মানুষ বানিয়েছেন, না তিনি মানুষের মুখের মধ্যে শ্বাস ভরে দিয়েছেন।” অন্য জায়গায় অগাস্টিন বলেছেন - “নির্দিষ্ট কিছু ছোট প্রাণী অবশ্যই পঞ্চম বা ষষ্ঠ দিনে সৃষ্টি হয়নি, তারা তৈরী হয়েছে বিকৃত পদার্থ থেকে।” অগাস্টিনের দে ট্রিনিটেট (ট্রিনিটি সম্পর্কিত) সম্বন্ধে বলতে গিয়ে হোয়াইট এক জায়গায় বলছেন যে অগাস্টিন “... এই দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছিলেন যে সৃষ্টির মধ্যে ক্রমবিকাশের একটা ব্যাপার আছে - ঈশ্বরই চূড়ান্ত স্রষ্টা, কিন্তু সৃষ্টি হয় অধীনস্থের মাধ্যমে; আর এইভাবে বলতে গিয়ে শেষমেশ অন্ততপক্ষে কিছু শ্রেণীর উদ্ভিদ ও প্রাণীর সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কারণের পক্ষে সওয়াল করে বসেছিলেন।”[৩১]