বীর (প্রাচীন গ্রিক: ἥρως, hḗrōs; ইংরেজি: Hero) একজন ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি যিনি অসাধারণ কিংবা অতি মানবীয় গুণাবলীর অধিকারী। তার অসাধারণ কর্মকাণ্ডের ফলে দেশ, জাতি কিংবা অন্যান্যদের জন্য কল্যাণকর বার্তা বা সুবিধা বয়ে নিয়ে আসে। তিনি বিপুল শক্তিমত্তা, দুঃসাহসিক কার্যাবলী সম্পাদন, বুদ্ধি-কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে যুদ্ধ জয় করে স্বীয় সুনাম বৃদ্ধিসহ জাতীয় বীর তথা সুগভীর শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হন। গ্রীক পৌরাণিকীতে তিনি একজন অর্ধ-দেবতা ও অর্ধ-মানব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়া ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত। দেবরাজ জিউস ও সাধারণ মানবী আল্কমেনের পুত্র হেরাক্লেস বীর হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে আছেন। প্রাচীন গ্রীসের ধর্মীয় বেড়াজালে আবদ্ধ গ্রিক পৌরাণিকী ও কল্পকাহিনীতে একজন বীর অর্ধ-দেবতারূপে চিত্রিত হয়ে আছেন।[১] পরবর্তীতে পুরুষ ও নারী - উভয়কেই প্রধান চরিত্র হিসেবে সর্বসমক্ষে পরিচিতি ঘটানো হয় যারা বিভিন্ন ধরনের বিপদ-আপদকে পাশ কাটিয়ে, ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে সাহসিকতা প্রদর্শনসহ প্রয়োজনে আত্মোৎসর্গ ও নীতি-নৈতিকতাবোধের মাধ্যমে মানবজাতির বৃহৎ মঙ্গলাকাঙ্খায় অংশগ্রহণ করে সফলকাম হন।
নারীদের ক্ষেত্রে যিনি এ ধরনের বীরত্বপূর্ণ কর্মের অধিকারী হন, তিনি জনসমক্ষে বীরাঙ্গনা নামে পরিচিত হন। বীরদেরকে ঘিরে অনেক নীতিকথামূলক উদাহরণ গল্পাকারে আজো লিখিত হয়ে থাকে। হেরাক্লেস, পার্সেসাস, আচিলেসের ন্যায় প্রমূখ বীর প্রাচীন গ্রীসের ধর্মীয় বিষয়াদির উল্লেখযোগ্য বিষয় হিসেবে অঙ্কিত হয়ে রয়েছেন। প্রাচীন এবং বর্তমান - উভয় পর্যায়েরই বিভিন্ন রাজনীতিবিদ স্ব-মহিমায় ও ব্যক্তিত্বগুণে বীরের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়ে আছেন। উল্লেখ্য যে বীরদের বীরত্বের পশ্চাতে তাদের নিজ নিজ ধর্মের সৃষ্টকর্তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তা অবশ্যই থাকে যদিও রামায়ণের ইন্দ্রজিৎ, মহাভারতের ভীস্ম বা দ্রোণাচার্য, গ্রীকদের হেরাক্লেস কিংবা শাহানামার রুস্তম বা ইসফানদিয়ার নিজ বাহুবলে বলিষ্ঠ। এক্ষেত্রে আব্রাহামিক তিন ধর্ম বিশেষ করে মহান ইসলাম ধর্মে বীরত্বের ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। ইসলামের বীরত্ব অস্ত্র নির্ভর নয় বরং যিনি ক্ষমা, দয়া, দান, রিপু নিয়ন্ত্রণ ও তাকওয়া অবলম্বনকারী তিনিই বীর। ইসলামে এমন একজন বীরও নেই যিনি যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে স্বাভাবিক জীবনেও দানশীল নন, ক্ষমাশীল নন বা তাকওয়া অবলম্বনকারী নন। সর্বোপরি ইসলামে যুদ্ধের মাঠে জয় বা বীরত্বের ধারণা পুরোটা আল্লাহ নির্ভর। অর্থাৎ মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে বিজয় আল্লাহর দান এখানে বীরত্ব বা অস্ত্র গৌণ। যেমন বদর বা ওহুদের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী সংখ্যা ও অস্ত্রে দুর্বল ছিল অথচ বিজয় তাদের করতলে ছিল। আবার ইসলামের ইতিহাসে হামজা , আলী , খালিদ বা সালাউদ্দিন আয়্যুবি বিখ্যাত বীর কিন্তু কেও-ই বীর হিসেবে পরিচিত হন নি কারণ তাদের ও সব মুসলিমদের বিশ্বাস অভিন্ন; শক্তি আল্লাহর উপহার, এটা বীরদের নিজস্ব নয়। ত্রোইয়ার যুদ্ধ আখিলেসের বীরত্ব ও ওডিসিয়াসের চাতুর্যে এসেছে বলে গ্রীক পুরাণের ধারণা। ফেরাউনের বিরুদ্ধে মুসা -এর জয় মুসা -এর চাতুর্যে ছিল না, ইব্রাহিম নমরুদকে পরাজিত করেন নি বা রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে খালিদ পরাজিত করতে পারতেন না, বরং এটা জয় পরাজয়ের নির্ধারক মহান আল্লাহর হস্তক্ষেপ ছিল।
পূর্বে শুধুমাত্র যুদ্ধ জয়, কিংবা বিদ্রোহ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ ব্যক্তিই বীরের মর্যাদা পেতেন। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে বীরের প্রাচীন অর্থ পরিবর্তিত হয়েছে। এখন বীর বলতে যিনি অসম্ভব সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন তাকে বুঝানো হয়ে থাকে। অগ্নিনির্বাপক কর্মী কর্তৃক কোন শিশু বা বৃদ্ধের জীবন বাঁচানোও বীরের পর্যায়ে ফেলা হয়। একজন বীর বীরোচিত কর্ম সম্পাদন করেন। তিনি সাধারণ ও অসহায় লোকদেরকে সহায়তা করে সমূহ বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেন। ব্যক্তি কিংবা সমাজকে মন্দ ব্যক্তি, খলচরিত্রের লোকদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। এমনকি প্রাকৃতিক দূর্যোগেও নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন।
ক্রীড়াক্ষেত্রেও এর সবিশেষ প্রয়োগ হতে দেখা যায়। একটি দেশের প্রতিনিধি হিসেবে যিনি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে স্বর্ণপদক, রৌপ্যপদক কিংবা ব্রোঞ্জপদকের ন্যায় কোন পদক জয় করেন তখন তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশ ও জাতির মর্যাদা বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় বীরে পরিণত হন ও অসম্ভব খ্যাতি অর্জনসহ ব্যক্তিগত সুবিধাদি ভোগ করে থাকেন। অলিম্পিক ক্রীড়ায় পদক জয় এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
বিখ্যাত দার্শনিক হেজেল কর্তৃক নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ব্যক্তিত্ব, মূল ভূমিকাকে বিবেচনায় এনে বীর হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ১৮৪১ সালে থমাস কার্লাইলের অন হিরোজ, হিরো ওরশীপ এন্ড দ্য হিরোইক ইন হিস্ট্রি শিরোনামের গ্রন্থে বীর ও মহৎ ব্যক্তিদের প্রধান বৈশিষ্ট্যকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে। তিনি অলিভার ক্রোমওয়েল বা ফ্রেডরিখ দ্য গ্রেটের ন্যায় কিছু প্রধান ব্যক্তিত্বকে ইতিহাসের পর্দা থেকে জীবনী আকারে উপস্থাপন করেছেন। মূলতঃ তার বীরদের প্রায় সবাই রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিত্ব, যারা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বা রাষ্ট্রপ্রধান। মহৎ ব্যক্তিরা ভাল এবং মন্দ উভয় দোষেই দুষ্ট যারা সাংগঠনিক পরিবর্তন করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে সুইডিশ কূটনীতিবিদ রাউল ওয়ালেনবার্গ দশ সহস্রাধিক ইহুদির জীবন বাঁচিয়ে ইতিহাসের পর্দায় নিজেকে বীর হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন।[২]
বিখ্যাত রুশ কল্পকাহিনীকার ভ্লাদিমির প্রোপ বীর বিষয়ে ব্যাপক বিশ্লেষণ ও গবেষণা কর্ম চালিয়েছেন। তিনি ড্রামাটিস পার্সোনায় আটটি চরিত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি ছিল বীর।[৩]:p. ৮০ তার এই বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাধারাটি পরবর্তীকালে রুশ উপকথায় ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তার ভাষ্য মোতাবেক একজন প্রকৃত বীর নিম্নলিখিত কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবেন:-