খোরাসান (ফার্সি: خراسان , অনেকসময় খুরাসান হিসেবেও পরিচিত) হল মধ্য এশিয়ার একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল।[১] প্রাচীন গ্রিক ভৌগোলিক এরাতোস্থেনেস (২৭৬ খ্রি.পূ. - ১৯৫/১৯৪ খ্রি.পূ.)তার ভূগোলে পরবর্তীকালে খোরাসান বলে পরিচিত এই সমগ্র ভূখণ্ডটিকে 'এরিয়ানা' বলে অভিহিত করেন। মধ্যযুগে বর্তমান ইরানের উত্তরপূর্ব অঞ্চল, প্রায় সমগ্র আফগানিস্তান, দক্ষিণ তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল এই খোরাসানের অন্তর্ভুক্ত বলে পরিগণিত হত। এই অঞ্চলের উত্তরসীমায় ছিল আমু দরিয়া নদী, পশ্চিমে কাস্পিয়ান সাগর, দক্ষিণে মধ্য ইরানের মরু অঞ্চল ও পূর্বে মধ্য আফগানিস্তানের পার্বত্য উচ্চভূমি। মধ্যযুগের কোনও কোনও আরব ঐতিহাসিকের মতে এই অঞ্চলের সীমানা পূর্বদিকে এমনকী ভারতের পশ্চিম সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।[১]
এই অঞ্চলের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ ও ৫ম শতাব্দীতে এই অঞ্চল হাখমানেশি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তীকালে ৩৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ আলেকজান্ডারের অভিযানের সময় তা গ্রিক সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। এই সময় থেকে এই অঞ্চল পার্থিয়া নামে পরিচিত হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ১ম শতাব্দী পর্যন্ত এখানে পার্থিয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল।[১] ১০ম শতাব্দীতে এই অঞ্চল সেলজুক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তীকালে এই অঞ্চলে ইসলামি সভ্যতার বিকাশলাভের সাথে সাথে খোরাসান নামটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে খোরাসান ইরানের উত্তরপূর্বের একটি প্রদেশ মাত্র হলেও, সপ্তম শতাব্দী থেকে শুরু করে প্রায় সমগ্র মধ্যযুগ জুড়ে এর বিস্তৃতি ছিল বহুগুণ বেশি। আজকের ইরানের খোরাসান প্রদেশটি এই ঐতিহাসিক অঞ্চলের পশ্চিম অংশের একটি অঞ্চল মাত্র।
খোরাসান নামটির উৎপত্তি পুরনো পারসিক শব্দ খোর (সূর্য) ও আসান (মধ্য পারসিক ভাষায় ক্রিয়াপদ হিসেবে এর অর্থ 'আসা'[২][৩], আবার নামপদ ও বিশেষণ হিসেবে অর্থ 'আলো' বা 'আলোকিত'[৪]) শব্দ থেকে। অর্থাৎ, শব্দটির আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় সূর্যের উদয়ভূমি বা সূর্যালোক। এই অর্থেই শব্দটি পূর্ব দিকের দেশ বোঝাতে প্রযুক্ত হতে থাকে এবং এই অঞ্চলে ইসলামের বিস্তারের সময়কালে পারস্য বা আজকের ইরানের পশ্চিমাঞ্চলের পূর্ব দিকে অবস্থিত সমগ্র অঞ্চলকে বোঝাতেই এই শব্দটি ব্যবহৃত হতে শুরু হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, পূর্বে আলেকজান্ডারের অভিযানের পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত ব্যাকট্রিয় সাম্রাজ্যের নামের উৎপত্তি হিসেবে ধরা হয় যে পারসিক শব্দ বখতার (Bāchtar باختر), তারও অর্থ একই, পূর্ব দিকের দেশ।
৩য় শতকে সাসানিদদের হাত ধরে খোরাসান প্রথম একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অঞ্চল হিসেবে উঠে আসে।[৫] সেই সময় ত্থেকে শুরু করে পরবর্তী ১৬০০ বছরের ইতিহাসে দেখা গেছে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক সীমার বারে বারে রদবদল ঘটেছে। সাসানিদ সাম্রাজ্যভুক্ত একটি প্রদেশ হিসেবে এর অন্তর্ভুক্ত ছিল নিশাপুর, হিরাট, মার্ভ, বাল্খ, বুখারা, তালোকান, সুসিয়া, ফরিয়াব, সারাখস, গুরগান, প্রভৃতি শহর।
এই অঞ্চলে ইসলামের বিস্তারের পরবর্তী সময়ে খলিফাদের শাসনকালে খোরাসানের বিস্তৃতি সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছয়। খলিফাদের সাম্রাজ্যর তিনটি প্রধান ভাগের মধ্যে একটি ছিল খোরাসান। বাকি দু'টি ভাগ ছিল ইরাক-ই-আরব বা আরবি ইরাক ও ইরাক-ই-আজম বা পারসিক ইরাক।[৬] উমাইয়া খিলাফত (৬৬১-৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ) ও আব্বাসীয় খিলাফত'এর (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) শাসনকালে খোরাসানকে এই অঞ্চলের চারটি বড় শহর, নিশাপুর, মার্ভ, হিরাট ও বালখকে কেন্দ্র করে চারটি বড় প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়।
মধ্যযুগের পারস্যে খোরাসান বলতে দস্ত-ই-কবীর বা মধ্য ইরানের মরুপ্রায় ভূমির পূর্বে অবস্থিত সে দেশের সমস্ত অঞ্চলকেই বোঝানো হত। স্বাভাবিকভাবেই দেশের আয়তন বাড়াকমার সাথে সাথে এই অঞ্চলের ব্যাপ্তিরও বারে বারে পরিবর্তন ঘটে। তবে বর্তমান আফগানিস্তানের এক বিরাট অংশই যে খোরাসানের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তা বোঝা যায়, যখন আমরা দেখি, খোরাসানের ইতিহাসপ্রসিদ্ধ চারটি প্রশাসনিক অঞ্চলের প্রধান নগর হিরাট, মার্ভ, বালখ ও নিশাপুরের মধ্যে চারটিই বর্তমানে আফগানিস্তানে অবস্থিত। বাবরনামাতেও আমরা এই অঞ্চলের উল্লেখ পাইঃ
"ভারতের মানুষ তাদের দেশের বাইরে সব দেশকেই সাধারণভাবে খোরাসান নামে অভিহিত করে থাকে, ঠিক যেমন আরবরা তাদের দেশের বাইরে আর সব দেশকে আজম বলে। খোরাসান থেকে ভারতে যাওয়ার প্রধান পথ দুটো - একটা কাবুলের মধ্য দিয়ে ও অন্যটি কান্দাহারের মধ্য দিয়ে। সাধারণভাবে ফরগানা, তুর্কিস্তান, সমরখন্দ, বালখ, বুখারা, হিসার, বদখশান, প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ভারতে যাওয়ার জন্য কাবুলের পথটি বেশি ব্যবহার করা হলেও খোরাসানের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ভারতে যেতে কান্দাহারের পথটিই বেশি ব্যবহার করে থাকে।"[৭]
খোরাসানের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। প্রত্নতাত্ত্বিক ও অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক উপাদান থেকে যা জানা যায়, এই অঞ্চলে সভ্যতার ইতিহাস আড়াই হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। সংক্ষেপে এই ইতিহাস নিচে আলোচনা করা হল।
৩৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের অভিযানের পূর্বে এই অঞ্চল হাখমানেশি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পারস্যের হাখমানেশি সম্রাট দ্বিতীয় কুরুশ, যিনি সাইরাস দ্য গ্রেট নামেও ইতিহাসে পরিচিত, খ্রিস্টপূর্ব ৬ শতকে এই অঞ্চলটি মিডিয়দের হাত থেকে দখল করে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। যেহেতু মিডিয়রা তেমন কোনও লিখিত প্রমাণ রেখে যায়নি, বা সমসাময়িক যুগের কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ব্যতীত তেমন কোনও নিশ্চিত প্রমাণ এই অঞ্চলে পাওয়া যায়নি, তাই এই সময়ের খোরাসানের ইতিহাস সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা মুশকিল। শুধু এটুকু জানা যায়, ৫৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্বিতীয় কুরুশের হাতে তাদের পতন ঘটলে হাখমানেশি সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটে।[৮] এরপর থেকে প্রায় আড়াইশ' বছর এই অঞ্চল প্রাচীন বিশ্বের এই অন্যতম বৃহৎ সাম্রাজ্যেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের আক্রমণের মুখে সমগ্র হাখমানেশি সাম্রাজ্যই ভেঙে পড়লে এই অঞ্চলও তাদের কেন্দ্রীয় শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে একটি ম্যাসিদোনীয় উপনিবেশে পরিণত হয়।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর সল্প সময়ের জন্য (৩২৭ খ্রিঃ পূঃ - ৩০৫ খ্রিঃ পূঃ)এই অঞ্চল সামগ্রিকভাবে তার সেনাপতি সেলুকাস প্রতিষ্ঠিত ব্যাকট্রিয় গ্রিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকে। এরপর মগধের মৌর্য সম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সাথে সেলুকাসের কন্যার বিবাহের যৌতুক হিসেবে হিন্দুকুশ পর্বতের দক্ষিণ অংশ মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে। গ্রিক ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক স্ত্রাবোর (৬৪ খ্রিঃ পূঃ - ২৪ খ্রিষ্টাব্দ) ভাষায় -
“ | আলেকজাণ্ডার এই অঞ্চল আর্যদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সেখানে নিজস্ব উপনিবেশ গড়ে তোলেন, কিন্তু সেলুকাস নিকাটর তা ৫০০ হাতির বিনিময়ে বিবাহের যৌতুক হিসেবে স্যান্ড্রোকোটাসকে (চন্দ্রগুপ্তকে) দান করে দেন।[৯] | ” |
এই অঞ্চলের বাকি অংশ এরপরও সেলুকাসের ব্যাকট্রিয় গ্রিক শাসনেরই অধীনে ছিল। কিন্তু উত্তরাধিকার সংক্রান্ত এক বিবাদের সুযোগে এই অঞ্চলের ব্যাকট্রিয় গ্রিক প্রশাসক (সত্রপ) অ্যান্ড্রাগোরাস.২৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই অঞ্চলের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে[১০] তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে উত্তরপূর্ব ইরানের পার্নি উপজাতীয় নেতা আরশখস এই অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করেন। ক্যাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণপূর্ব কোণে অবস্থিত দাহেস্তান থেকে এই উপজাতি আরশখস'এর নেতৃত্বে প্রথম পার্থিয়ায় এসে তারপর সেখান থেকেই তাদের রাজ্য বিস্তার করেছিল বলে এদের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যকে ইতিহাসে পার্থিয় সাম্রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়।[১১] বেশ ক'বছর এই অঞ্চলের অধিকার নিয়ে তাদের সাথে ব্যাকট্রিয় গ্রিকদের টানাপোড়েন চলার পর ২৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অ্যান্ড্রাগোরাসের মৃত্যু হলে এই অঞ্চলে পার্থিয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য ২০৯ খ্রিঃ পূঃ - ২০৬ খ্রিঃ পূঃ শেষ শক্তিশালী ব্যাকট্রিয় গ্রিক সম্রাট তৃতীয় অ্যান্টিওখাসের কাছে তাদের নতি স্বীকার করতে হয়, কিন্তু এরপর ব্যাকট্রিয় গ্রিক সাম্রাজ্য ভেঙে পড়লে পার্থিয়রাই এই অঞ্চলে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী নাগাদ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহে[১২] এবং উত্তরের স্তেপ থেকে আগত শক, কুষাণ, প্রভৃতি জাতির আক্রমণে পার্থিয় সাম্রাজ্য প্রবল অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। শেষপর্যন্ত খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীতে এই অঞ্চলের দক্ষিণপূর্ব অংশ পার্থিয়দের হস্তচ্যূত হয়ে কুষাণ সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে পড়ে। কুষানরা বর্তমান আফগানিস্তানের বাগরামে তাদের রাজধানী স্থাপন করেন। বিখ্যাত বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি তাদেরই কীর্তি বলে মনে করা হয়।[১৩] অপরদিকে ২০৮ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ পারস্যের ফর্সের শাহানশাহ বা 'রাজাদের রাজা' হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেন আর্দাশির নামক এক ব্যক্তি। এঁর বাবা বাবক বা পাপক ছিলেন পার্থিয়দের অধীনে ঐ অঞ্চলেরই এক প্রশাসক।[১৪][১৫] কিন্তু ২২৪ খ্রিষ্টাব্দে আরদাশির পার্থিয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তার হাতেই পার্থিয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে ও পরবর্তী ৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে সাসানিদদের (২২৪ খ্রিঃ - ৬৫১ খ্রিঃ) উত্থান ঘটে।[১৫][১৬] পার্থিয়দের উত্তরাধিকার হিসেবে খোরাসানের মূল অধিকারও এই সময় এদের হাতেই এসে পড়ে।
খ্রিস্টিয় ৩য় শতাব্দীর প্রথম অর্ধে শেষপর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলটিই সাসানিদদের অধীনে চলে যায়। সাসানিদদের হাত ধরেই এই অঞ্চল তার খোরাসান নাম লাভ করে এবং প্রশাসনিক দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়। সাসানিদরা তাদের সমগ্র সাম্রাজ্যকে চারটি প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করে - পশ্চিম অংশের নাম ছিল খারভারান (Khvarvaran), উত্তর অংশের নাম বখতার, দক্ষিণে আরাখোসিয়া ও পূর্বে খোরাসান। এই সময় খোরাসানের পূর্ব সীমান্ত তৎকালীন ভারতের পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তারলাভ করে। পারস্যের পূর্বতম প্রদেশ হিসেবেই এই সময় থেকে এর নাম হয় 'খোর-আসান', অর্থাৎ সূর্য উদয়ের দেশ। খুব দ্রুত তাদের সীমানা আরও পূর্বে প্রসারিত হতে শুরু করে। ২৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই বালখ, গুরগান, সিস্তানসহ পশ্চিম খোরাসান তাদের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। সাসানিদদের পরবর্তী লিপিতে এই কৃতিত্ব আরদাশিরের বলে দাবি করা হলেও, ঐতিহাসিকদের মতে ব্যাকট্রিয়া দখলের কৃতিত্ব সম্ভবত আরদাশিরের পুত্র প্রথম শাপুরের। এরপর কুষাণরাও বর্তমান আফগানিস্তান অঞ্চলে অন্তত তাদের অধীনতা স্বীকার করে নেয়। যদিও বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রর সাক্ষ্য থেকে মনে করা হয়, অন্তত খ্রিস্টিয় ২৪০'এর দশক পর্যন্ত তারা তাদের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল।[১৫] যাইহোক, পূর্বদিকে কুষাণরা তখনও তাদের সাম্রাজ্য বেশকিছু দিন ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সাসানিদদের পূর্ব সীমানা এতটাই বিস্তার লাভ করে যে তা পূর্ব দিকে সিন্ধু অববাহিকা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। অপরদিকে কুষাণদের পরাস্ত করে পূর্ব থেকে মগধের গুপ্ত সাম্রাজ্যও (৩২০খ্রিঃ - ৫৫০ খ্রিঃ) চতুর্থ শতাব্দীতে ঐ অববাহিকা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। ফলে খোরাসানকে ভিত্তি করে ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে সাসানিদদের যোগাযোগ উল্লেখযোগ্যরকম বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম ভারতে বাণিজ্য ও অন্যান্য সূত্রে সাসানিদদের সংস্কৃতির ভালোই প্রভাব পড়ে। কুষাণরা এই প্রভাবে যে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, কুষাণ অঞ্চলে প্রাপ্ত বিভিন্ন বিচারসভা, শিকার ও রাজকীয় আমোদের চিত্রাঙ্কিত নানা বয়ন ও সাসানিদ রৌপ্যফলক থেকে তা ভালোভাবেই বুঝতে পারা যায়। অপরদিকে 'চতুরঙ্গ' খেলাটিও এইসময়েই ভারতীয় অঞ্চল থেকে খোরাসান হয়ে পারস্যে ছড়িয়ে পড়ে বলে মনে করা হয়। এছাড়া দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজত্বকালে দক্ষিণ ভারতের চালুক্যদের সাথেও সাসানিদদের দূত বিনিময় হত বলে জানা যায়।
শ্বেতহূণ বা গ্রিকভাষায় হেপথ্যালাইটদের প্রকৃত পরিচয় নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা আছে। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে এরা এক তিব্বতীয় বা তুর্কি যাযাবর উপজাতি।[১৭] চীনা উৎস (ষষ্ঠ শতাব্দীর চীনা পরিব্রাজক সং ইউন'এর ভ্রমণ বৃত্তান্ত। মূল বইটি পাওয়া না গেলেও লইয়াং জিলান জি বা লইয়াং বৌদ্ধ মঠের রিপোর্ট থেকে ঐ বই থেকে প্রাপ্ত বহু মূল্যবান তথ্য আমরা জানতে পারি।) থেকে জানা যায় এরা ১২৫ খ্রিষ্টাব্দে চীনের প্রাচীরের উত্তরে জুঙ্গারিয়া অঞ্চলে বসবাস করত। আবার অন্যদের মতে এরা এক ইরানি উপজাতিই, যাদের উদ্ভব ঐ খোরাসান অঞ্চলেরই ব্যাকট্রিয়া থেকেই।[১৮] যাই হোক, খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের শুরুর দিকেই ৪২৫ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ এরা সির দরিয়া নদী পেরিয়ে আসে ও সাসানিদদের সাম্রাজ্যের উত্তরপূর্ব দিকে তীব্র আক্রমণ শাণায়।[১৭] সাসানিদ সম্রাট পঞ্চম বাহরাম (৪২১ খ্রিঃ - ৪৩৮ খ্রিঃ) ও তারপর দ্বিতীয় ইয়াযদগেরদ প্রথমে তাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করেন ও তাদের পূর্ব দিকে তাড়িয়ে দেন। কিন্তু কিছু বছর পর তারা আবার ফিরে আসে ও ৪৮৩ খ্রিষ্টাব্দে হিরাটের কাছে মরুভূমিতে ফাঁদে ফেলে সাসানিদ সম্রাট প্রথম পেরোজকে তার বিশাল বাহিনীসহ সম্পূর্ণ পরাস্ত করে। প্রথম পেরোজ মারা যান, তার বাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর তারা হিরাটের দিকে অগ্রসর হয় এবং পরবর্তী দু' বছর সমগ্র অঞ্চলে এক ধরনের তীব্র অরাজকতার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালেও প্রায় একশ' বছর ধরে শ্বেতহূণরা পারস্যের ঠিক উত্তরপূর্বে তথা খোরাসানের উত্তর অংশে এক স্থায়ী হুমকি হিসেবে অবস্থান করতে থাকে ও তাদের সাথে সাসানিদদের তীব্র টানাপোড়েন চলতে থাকে।
সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে সাসানিদদের সাম্রাজ্য যেমন একদিকে সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে, ঠিক সেই একই সময়ে তাদের শাসন নানাকারণে দুর্বল হয়ে পড়তেও শুরু করে। একদিকে পূর্বে শ্বেত হূণ ও পশ্চিমে পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের তাদের সাথে শতাব্দীব্যাপী কখনও টানা কখনও ক্ষেপে ক্ষেপে সংঘর্ষে অনিবার্যভাবেই তাদের শক্তিক্ষয় হয়। বিশেষ করে শেষ শক্তিশালী সাসানিদ সম্রাট দ্বিতীয় খসরুর (৫৯০ খ্রিঃ - ৬২৮ খ্রিঃ)[১৯] রাজত্বকালে রোমানদের সাথে ক্রমাগত লড়াই'এ পার্শি সেনাবাহিনী খুবই ক্লান্ত ও শেষপর্যন্ত একরকম বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। চাষীদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ দেখা দেয়। ক্রমাগত যুদ্ধর ফলে জিনিসপত্রের অবাধ যাতায়াতে বাধা সৃষ্টি হওয়ায়, সেখানেও ঘাটতি বাড়ে। স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের বিরুদ্ধে ফলে দেশের মধ্যেই অসন্তোষ চরমে ওঠে। অন্যদিকে যুদ্ধের খরচ জোগাতে সাধারণ মানুষের উপর অতিরিক্ত করের বোঝাও চাপে।[১৯] ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহ ও তদজনিত ধ্বংসে সাম্রাজ্যর অভ্যন্তরীণ স্থিতিও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারউপর রোমানবাহিনীর হাতে একরকম পর্যুদস্ত অবস্থায় নিজ পুত্র দ্বিতীয় কাভাদ'এর বিদ্রোহে দ্বিতীয় খসরুর মৃত্যু হলে অরাজকতা চরমে ওঠে। মাত্র ৫ বছরের মধ্যে প্রায় এক ডজন শাসকের পরিবর্তন ঘটে। দেশে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কেন্দ্রীয় শাসনক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রশাসক, জমিদার ও সেনাপতিদের হাতেই মূল ক্ষমতা এসে জড়ো হয়।[২০] শেষপর্যন্ত ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে শেষ সাসানিদ সম্রাট তৃতীয় ইয়াজদেগেরদ সিংহাসনে বসার এক বছরের মধ্যেই তাকে ইসলামে উদ্বুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ আরবী আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়।
মুসলিম আক্রমণের মুখে সাসানিদরা প্রায় কোনও বাধাই তৈরি করতে পারেনি। নতুন সম্রাট তৃতীয় ইয়াজদেগেরদ ছিলেন তখন নেহাতই এক নাবালক। গোটা সাম্রাজ্যরও তখন এক খাপছাড়া অবস্থা। ফলে মুসলিমরা খুব সহজেই একের পর এক যুদ্ধে জয়লাভ করতে থাকে। এই অবস্থায় খলিফা আবু বকরের নির্দেশে বিখ্যাত মুসলমান সেনাপতি খালিদ ইবন ওয়ালিদের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী মেসোপটেমিয়া বা আজকের দক্ষিণ ইরাকের শহরগুলির উপর একের পর এক আক্রমণ চালাতে শুরু করে। ৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল-জুলাই মাসের মধ্যে পরপর ওয়ালাজা, হিরা ও আল আনবারের যুদ্ধে তারা সাসানিদ বাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করে। আরব আক্রমণের মুখে এর ফলে ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই একে একে প্রায় সমগ্র দক্ষিণ ইরাক ও সিরিয়ার অংশবিশেষ হারাতে হয় সাসানিদদের।[২১] ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে আল কোয়াদেসিয়ার যুদ্ধেও সাসানিদ বাহিনীর পরাজয়ের পর আরব বাহিনীর অবরোধের মুখে তাদের দীর্ঘদিনের রাজধানী টাইগ্রিস নদী তীরের তেসিফুন'এরও পতন ঘটে।[২২][২৩] তৃতীয় ইয়েজদেগেরদ কোনওরকমে পূবের দিকে পালাতে সক্ষম হন। কিন্তু সাসানিদরা এই যুদ্ধে তাদের রাজধানীর সাথে সাথে প্রায় সমগ্র রাজকোষই আরবদের হাতে খুইয়ে বসে। ফলে যুদ্ধ চালাতে তাদের অর্থভাণ্ডারে এবার রীতিমতো টান পড়ে। তারউপর সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসন ও বাহিনী ভেঙে পড়ার পর আরবদের ক্রমাগত চাপের মুখে সমগ্র সাম্রাজ্যের পতন ছিল তখন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। সম্রাট ইয়েজদেগেরদ নিরাপত্তার খোঁজে সাম্রাজ্যের পূর্বতম প্রদেশ খোরাসানেই আশ্রয় নেন। সাসানিদ সেনাপতি ও আঞ্চলিক শাসকদের শত্রুদের রোখার শেষ মিলিত চেষ্টাও ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে নাহাবাঁধের যুদ্ধে ব্যর্থ হয়।[২৩][২৪] মুসলিমদের চাপের মুখে তাদের গোটা সাম্রাজ্যই তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়ে। তবে খোরাসান যেহেতু ছিল অনেকটাই পূর্বদিকে, তাই সেখানে তখনও কিছুদিন সাসানিদ শাসন বজায় থাকে। কিন্তু দীর্ঘদিনের শোষণ ও অপশাসনের কারণে সাসানিদরা এই অঞ্চলে আদৌ জনপ্রিয় ছিল না। ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে (মতান্তরে ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে)[২৩] সেখানেও মুসলিম বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। এই অবস্থায় ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট তৃতীয় ইয়াজদেগেরদ মার্ভ শহরে আততায়ীর হস্তে নিহত হলে[২৩] সাসানিদ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। পারস্যের আর বাকি সব অঞ্চলের মতো খোরাসানও এই সময় থেকে উমাইয়া খিলাফতের অধীন হয়ে পড়ে।
ইতিহাসের নানা পর্যায়ে খোরাসানের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এতবার হাতবদল হওয়ায় এই অঞ্চলে বহু জাতির মানুষের বাস। এখানে পারসিক, আরবী, তুর্কি, কু্র্দি, মঙ্গোল, বালুচ এবং স্বল্প পরিমাণে হলেও কিছু ইহুদী ও জিপসিরাও বাস করে।[২৫] এই অঞ্চলের প্রাচীন অধিবাসী ছিল পারসিকরাই। তবে বর্তমানে পারস্যর অধীন প্রদেশগুলি ব্যতীত তাদের সংখ্যা যথেষ্ট কমে গেছে। ১৯২৯ সালের সামরিক রিপোর্ট থেকেই জানা যায়, মাশাদ সমভূমি, নিশাপুর জেলা ও কোয়েন জেলাতেই কেবল তখন তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ।[২৫] এখন উত্তর খোরসান, দক্ষিণ খোরসান ও রাজাভি খোরসান প্রদেশ তিনটির মধ্যে প্রথম দুটি প্রদেশে লোকসংখ্যাও যথেষ্ট কম। অন্যদিকে মুসলিম আরবদের এই অঞ্চলে আগমণ ঘটে সপ্তম শতকের মধ্যভাগে। এই অঞ্চলের নিশাপুর, মার্ভ এবং সম্ভবত হিরাট ও বালখেও তারা সৈন্যশিবির স্থাপন করে। এগুলিকে কেন্দ্র করেই.৬৫১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই অঞ্চলে আরবদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের পুরো সময় ধরেই এই অঞ্চলে আরব বসতি গড়ে ওঠে।[২৫][২৬] বিভিন্ন তুর্কি উপজাতি এই অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ঢুকতে শুরু করে মূলত একাদশ শতাব্দীতে সলজুক আক্রমণের সময় থেকে। এরপর থেকে ক্ষেপে ক্ষেপে প্রায় ৮ শ' বছর ধরে নানা তুর্কি উপজাতির লোক এই অঞ্চলে বাসা বাঁধে। বর্তমানেও এই অঞ্চলের উত্তরের প্রদেশগুলিতে বিভিন্ন তুর্কি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরই সংখ্যাধিক্য।[২৫] বিশেষজ্ঞদের মতে যদিও কুর্দ জাতির লোকেরা ১৬ শতাব্দীর আগেও এই অঞ্চলে বাস করতো, বর্তমানে এই অঞ্চলের উত্তর অংশে যে কুর্দরা বাস করে তারা মূলত পশ্চিম পারস্য থেকে আসা। ১৬ শতাব্দীতে উজবেক, তুর্কমেন, প্রভৃতি তুর্কি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হ্রাসের উদ্দেশ্যেই এদের সাফাভিদ সুলতানেরা এদের এই অঞ্চলে নিয়ে আসে। আবার খোরাসানের উত্তর, উত্তরপূর্ব ও পূর্ব অংশে বহু মোঙ্গোল জাতির মানুষও বাস করে। বর্তমানে এদের মূল দুটি উপজাতি তিমুরি ও হাজারা। বর্তমান আফগানিস্তানের বিভিন্ন অংশেই এদের যথেষ্ট পরিমাণে বাস।[২৫] এছাড়া এই অঞ্চলের দক্ষিণ সীমানায় যেহেতু বালুচিস্তান, সেখানকার বহু অধিবাসীও বর্তমানে এই খোরাসান অঞ্চলেরও নানা স্থানের বাসিন্দা। একসময় যদিও এখানে বিশাল ইহুদী জনসংখ্যা ছিল, আজ তার খুব কমই অবশিষ্ট আছে। এমনকী ১৯২০ সাল নাগাদও তাদের যে সামান্য অংশ মাশাদ অঞ্চলে বাস করতো, তাদেরও একটা অংশ ছিল 'জাদিদ' যারা ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়।[২৫] এছাড়াও নিশাপুর, সাবজাভার ও বিরজন্দ শহরের দক্ষিণে কিছু জিপসিও বাস করে। এরা এখনও যাযাবর প্রজাতির, ও বংশপরম্পরায় নানারকম কারিগরি জাতীয় কাজ করে থাকে।[২৭]