ভেলাকালি হল ভারতের কেরালার নায়ার সম্প্রদায়ের একটি ঐতিহ্যবাহী সমরকলা নৃত্য যা মন্দির উৎসবের সময় পরিবেশিত হয়। তলোয়ার ও ঢাল নিয়ে উজ্জ্বল পোশাক পরা নর্তকরা নৃত্য চলাকালীন পাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যে লড়াইয়ের পর্যায় বর্ণন করে।[১]
ভেলাকালির উৎপত্তি ও ইতিহাসের সাথে জড়িত বেশ কিছু কিংবদন্তি রয়েছে। এরকমই একটি কিংবদন্তীতে বলা হয়েছে যে কালিন্দীর তীরে ভগবান কৃষ্ণ এবং তাঁর বন্ধুদের মধ্যে চলা একটি নকল যুদ্ধের সাক্ষী হয়েছিলেন ঋষি নারদ। শাপলার ডাঁটি এবং পাতাগুলিকে তলোয়ার ও ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে যুদ্ধ চলছিল। নারদ ঋষি ভিল্লুমঙ্গলমকে অনুরোধ করেন নকল যুদ্ধের সমর শক্তিকে কৃষ্ণের জন্য একটি আচারানুষ্ঠানিক প্রদর্শনে ধারণ করার জন্য। তখন ভিল্লুমঙ্গলম অম্বলপ্পির শাসককে যুবকদের নাচ শেখানোর জন্য অনুরোধ করেন, শাসক আবার তাঁর সেনাপ্রধান মাথুর পানিক্কর এবং ভেলুর কুরুপকে ভেলাকালি শিল্পীদের একটি দল প্রস্তুত করতে বলেন। যেহেতু নৃত্যশিল্পীরা মূলত যোদ্ধা ছিলেন, তাই নৃত্যটি কালারিপায়াত্তুর মার্শাল আর্ট রূপের সাথে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য বহন করে।[২] এইভাবে ভেলাকালির উৎপত্তি হয়েছিল চেম্পাকাসেরি (আধুনিক আম্বালাপুঝা) রাজ্যে। আজ অবধি এটি আম্বালাপুঝা শ্রী কৃষ্ণস্বামী মন্দিরে পুরমের একটি নিয়মিত প্রদর্শন। আম্বালাপুঝাকে ত্রাভাঙ্কোরে সংযুক্ত করার পর থেকে, ভেলাকালি নৃত্য পরিবেশন দিয়ে, ত্রিবান্দ্রমের শ্রী পদ্মনাভ স্বামী মন্দিরের বার্ষিক পেইনকুনি উৎসবের সূচনা হয়।[৩][৪]
উৎসবের সময় ভেলাকালি পরিবেশনের আগে পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের পূর্ব প্রবেশদ্বারে পাণ্ডবদের প্রতিনিধিত্বকারী বিশাল মূর্তি স্থাপন করা হয়। আম্বালাপুঝাতে রাজপরিবারের মন্ত্রী মাথুর পানিক্করের নির্দেশনায় নৃত্যটি পরিচালিত হয় এবং পানিক্কর বংশগতভাবে একজন আসান।[৫] ভেলাকালি নর্তকরা কৌরবদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং নৃত্যটি ভাইয়েদের মধ্যে যুদ্ধের রূপক স্বরূপ। যুধিষ্ঠিরের মূর্তির কাছে পৌঁছানোর পর নর্তকরা থামে এবং পিছিয়ে আসতে থাকে। প্রদর্শনটি অধর্মের উপর ধর্মের বিজয় এবং কৌরবদের বনে নির্বাসনের সময় ভীমের বিজয় বর্ণন করে।[৬] কনিষ্ঠ অভিনয়শিল্পীরা সামনে পরপর দাঁড়ায় এবং প্রবীণরা দলের পিছনের অংশে পতাকাধারীদের একটি দল নিয়ে পিছনের লাইন তৈরি করে। প্রদর্শনকারীদের সাথে কখনও কখনও ষাঁড়ের মতো প্রাণীর প্রতিলিপিও থাকে যাদের পুরানো দিনে যুদ্ধে ব্যবহার করা হত।[৫] আলফ হিল্টেবেইটেলের মতে, মধ্য ত্রাভাঙ্কোরে ভেলাকালির প্রদর্শনগুলি মহাভারতের যুদ্ধের পরিবর্তে কথিত ঐতিহাসিক যুদ্ধের পুনরাভিনয় এবং পদায়নীর আচারের সাথে জড়িত। শুধুপদ্মনাভস্বামী মন্দিরেই যে প্রদর্শনগুলি হয়, সেগুলি মহাভারতের ভাইদের মধ্যে যুদ্ধের সাথে যুক্ত।[৭]
ভেলাকালি একটি পুরুষ-সর্বস্ব প্রদর্শন। প্রদর্শনকারীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং মধ্যযুগীয় নায়ার সৈন্যদের রঙিন লাল পাগড়ি পরে এবং তাদের নগ্ন বক্ষ ঢেকে পুঁতির মালা পরে। তারা রঙিন ঢাল এবং লম্বা বেত বা খোলা তলোয়ার নিয়ে থাকে। তারা বাদ্যযন্ত্রীদের পঞ্চবাদ্যমের তালে তালে নাচে। নর্তকদের তলোয়ার খেলার নিপুন প্রদর্শনী দেখা যায়।[২][৪][৮]
ভেলাকালি পঞ্চবাদ্যমের সাথে সম্পাদিত হয় যেখানে মদ্দলাম, থাভিল, ইলতালম, কম্বু এবং কুড়ল ব্যবহৃত হয়। সঙ্গীতে কোন কথা থাকেনা এবং শিল্পীরা ঘাতযন্ত্রের তালে তালে চলতে থাকে। এছাড়াও, ভেলাকালি প্রদর্শনে ভাবের কোন স্থান নেই এখানে মনোযোগ থাকে শুধুমাত্র তালে। ভেলাকালিতে পিডিচাকলি, পদকলি এবং ভেলা অট্টমের মতো বিভিন্ন স্বতন্ত্র নৃত্যভঙ্গী জড়িত।[২][৪]
ভেলাকালির জন্য এর প্রদর্শনকারীদের যথেষ্ট শারীরিক প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র ব্যবহারের জ্ঞান প্রয়োজন।[৯] শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের ফলে তরুণদের ভেলাকালিতে অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে কমে আসছে। মোহনকুঞ্জু পানিক্করের প্রচেষ্টার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এর খানিকটি পুনরুত্থান ঘটেছে। প্রায় ৪০ বছর পর ২০১১ সালে ত্রিভান্দ্রমের শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরে এই নৃত্যটি আবার মঞ্চস্থ হয়।[২]