মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্ব অথবা মধ্যযুগীয় উৎকৃষ্ট জলবায়ু বা মধ্যযুগীয় জলবায়ুগত অনিয়ম বলতে বোঝায় উত্তর আটলান্টিক এলাকার একটি উষ্ণ জলবায়ুগত সময়কাল, যার সঙ্গে উক্ত এলাকার কিছু উষ্ণ ঘটনাবলীর সম্ভাব্য যোগসাজশ রয়েছে; যেমন প্রায় ৯৫০ থেকে ১২৫০ [১] খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চীন সহ [২] অন্যান্য এলাকায়[৩][৪] সংঘটিত উষ্ণ জলবায়ুগত ঘটনা। বাকী এলাকাগুলো ঐ সময়ে ছিল শীতলতর, যেমন ক্রান্তীয় প্রশান্ত মহাসাগর এলাকা। এই সময়ের মোট গড় তাপমাত্রা ছিল মধ্য-বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের উষ্ণতার সমান। মধ্যযুগীয় উষ্ণায়নের সম্ভাব্য কারণ ছিল বর্ধিত সৌর প্রক্রিয়া, আগ্নেয়গিরির সক্রিয়তা কমে আসা এবং সমুদ্রের গতিপ্রবাহের পরিবর্তন। [৫]
এই উষ্ণ যুগটির আগে উত্তর আটলান্টিক সহ আরও কিছু এলাকায় একটি শীতল যুগ এসেছিল, যা ক্ষুদ্র বরফ যুগ নামে পরিচিত। কেউ কেউ এই যুগটিকে মধ্যযুগীয় জলবায়ুগত অনিয়ম হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন কারণ এই সময়ে সংঘটিত জলবায়ুগত ঘটনাগুলোর প্রভাব তাপমাত্রাজনিত ঘটনার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। [৬][৭]
ধারণা করা হয় যে উষ্ণ রোমান যুগের পরে ৯৫০ থেকে ১১০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল ছিল উত্তর গোলার্ধের উষ্ণতম সময়। এরপর শুধু বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীতেই উত্তর গোলার্ধে উষ্ণতর উষ্ণতর তাপমাত্রা অনুভূত হয়েছে। জলবায়ুর প্রক্সি রেকর্ড থেকে দেখা যায় যে বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় সর্বোচ্চ উষ্ণতা দেখা গিয়েছে এবং এই নথির প্রেক্ষিতে মধ্যযুগীয় উষ্ণ সময়কে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নিয়মিত ঘটনা বলা যায় না। [৮]
মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্ব বলতে অনুমান করা হয় মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সময়কে, যার সংঘটন সময়কাল ছিল প্রায় ৯৫০-১২৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। [৪] ১৯৬৫ সালে হুবার্ট ল্যাম্ব নামের একজন প্রথমদিকের প্রাচীন-জলবায়ুবিজ্ঞানী উদ্ভিদবিজ্ঞান, ঐতিহাসিক নথি গবেষণা এবং আবহবিদ্যার সঙ্গে ১২০০-১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের নিয়ত তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের রেকর্ডের সঙ্গে সমন্বয়ন ঘটিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “বিভিন্ন অনুসন্ধানক্ষেত্র হতে সংগৃহীত প্রমাণাদি বলছে, ১০০০ থেকে ১২০০ খৃস্টাব্দে পৃথিবীর অনেক অংশেই উষ্ণ তাপমত্রা বিরাজমান ছিল এবং পরবর্তী ১৫০০-১৭০০ খৃস্টাব্দে তা বেশ কমেও এসেছিল। বরফ যুগের পর এই কমে আসা তাপমাত্রাই ছিল পৃথিবীর শীতলতম অবস্থা।”[৯]
উষ্ণ সময়কালটুকুকে বলা হয়ে থাকে মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্ব এবং শীতল অংশকে বলা হয় ক্ষুদ্র বরফযুগ। যাই হোক, এই দৃষ্টিকোণটিকে অন্যান্য গবেষকরা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত আইপিসিসির প্রথম মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্বটি ঘটেছিল ১০০০ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশের সময়ে (যেটি সম্ভবত সারা পৃথিবীব্যাপী হয়নি) এবং ক্ষুদ্র বরফযুগটি সংঘটিত হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে শেষভাগ পর্যন্ত সময়ে।” [১০] এরপর ২০০১ সালে প্রকাশিত আইপিসিসির তৃতীয় মূল্যায়ন রিপোর্টে সারমর্মকৃত গবেষণা তুলে ধরা হয়েছে; যেখানে বলা হচ্ছে-“বিশ্বব্যাপী সমানভাবে অস্বাভাবিক রকম উষ্ণ এবং শীতল যুগ এসেছিল এই উল্লিখিত সময়ে, এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এছাড়া প্রচলিত “ক্ষুদ্র বরফ যুগ” এবং “মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্ব” পরিভাষা দিয়ে বৈশ্বিক ভাবে বা পুরো (উত্তর) গোলার্ধে বিগত শতকগুলোর গড় তাপমাত্রা পরিবর্তন বর্ণনা করা সম্ভব নয়।”[১১] বরফ-মজ্জা, গাছের প্রস্থচ্ছেদ এবং হৃদে সঞ্চীভূত উপাদান বিশ্লেষণ করে বিগত শতাব্দীর তাপমাত্রা নথিভূত করে দেখা গিয়েছে, বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়ের তাপমাত্রার চেয়ে পৃথিবীর বর্তমান তাপমাত্রা খানিকটা (০.০৩°সেলসিয়াস) কম। [১২][১৩]
আদি-জলবায়ুবিশারদরগণ এখন স্থানভেদে বিভিন্ন এলাকার বিগত শতাব্দীর জলবায়ু পুনর্গঠনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন , প্রচলিতভাবে যা “ক্ষুদ্র বরফ যুগ” এবং “মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্ব” ধারণাগুলোর সাথে খাপ খায়। [১২][১৪] অন্যান্য গবেষকরা প্রচলিত ধারণাগুলোই অনুসরণ করছেন এবং এই দুই পর্বে যখনই কোন উল্লেখযোগ্য জলবায়ুগত ঘটনা খুঁজে পাচ্ছেন তারা, সেটাকে জুড়ে দিচ্ছেন পর্ব দু’টোর ঘটনাক্রমের সঙ্গে। তবে মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্বের কিছু ঘটনা পুরোপুরি উষ্ণ ঘটনা হবার পরিবর্তে বরং আর্দ্র বা শীতল ঘটনা হয়েছিল; বিশেষ করে মধ্য-আমেরিকাতে, যেখানকার জলবায়ুর ধরন উত্তর আটলান্টিকের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মী।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ুর অবস্থার পরিবর্তনের প্রমাণ সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। “উষ্ণ পর্বের” কিছু কিছু ঘটনাকে নথিভুক্ত করা হয়েছে আর্দ্র এবং অনাদ্র পর্ব হিসেবে। [১৫]
২০০৯ সালে মাইকেল মান সহ আরও কিছু গবেষক হারানো জলবায়ুগত তথ্য পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের তাপমাত্রার তারতম্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, “মধ্যযুগীয় উষ্ণ সময়ে একটি নির্দিষ্ট উষ্ণতা দেখা গিয়েছিল বিশ্বব্যাপী, যা উল্লিখিত সময়ে পৃথিবীর অনেক স্থানের তাপমাত্রার সমান ছিল এবং কোন কোন জায়গায় ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা এই উষ্ণতাকেও অতিক্রম করেছিল; এই উষ্ণতা বর্তমান সময়ের বৈশ্বিক মাত্রায় বেশ কম।”[৪] তাদের এই তাপমাত্রা পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ছিল মূলত উত্তর আটলান্টিক, দক্ষিণ গ্রিনল্যান্ড, ইউরোপীয় আর্কটিক এবং উত্তর আমেরিকার কিছু অংশের উষ্ণতার ধরনের উপর ভিত্তি করে এবং এই পুনর্গঠিত উষ্ণতা বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে (১৯৬১-১৯৯০) ক্রমাগত বেড়েছে। বিগত দুই যুগে কিছু এলাকায় এই তাপমাত্রা বজায় থেকেছে কিংবা বেড়েছে আরও। তবে কিছু এলাকায়, যেমন- মধ্য ইউরোপ, উত্তরপশ্চিমীয় উত্তর আমেরিকা এবং (দুর্বল ভাবে বলা যায়) দক্ষিণ আটলান্টিকে বিচ্ছিন্নভাবে শীতলতা দেখা গিয়েছে।
আদি-জলবায়ুবিদ্যায় বিভিন্ন ধরনের স্থানিক বিশ্লেষনে দেখে গিয়েছে যে বর্তমান সময়ের বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেশ উষ্ণপ্রবণ, বিশেষ করে উত্তর এবং দক্ষিণাঞ্চলে। তবে নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে এই প্রবণতা কম। [১৬] খুব সম্প্রতি “পেইজেস টু থাউজ্যান্ড কনসোর্টিয়াম” এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে মধ্যযুগীয় উষ্ণতা বিশ্বব্যাপী সমভাবে সংঘটিত হয়নি। তারা আরও বলেছে, “আমাদের তাপমাত্রা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় খুব সামান্য প্রমাণাদিই পাওয়া গিয়েছে যার ভিত্তিতে বলা যায় যে মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্ব বা ক্ষুদ্র বরফ যুগ সর্বব্যাপী সমানভাবে বিস্তার করেছিল। বরং বলতে হয়, উচ্চ উষ্ণতা ও নিম্ন শীতলতা এবং তাদের অন্তর্বর্তী সময়কাল এলাকাভেদে বদলেছে। এছাড়া যুগ যুগ ধরে এই স্থানিক জলবায়ু বৈচিত্র্য দেখা যাওয়ায় শীতলপ্রবণ হয়েছে কিছু কিছু এলাকার তাপমাত্রা।” [১৭]
লয়েড কেগাইন ১৯৯৬ সালে শৈবাল সাগরের সামুদ্রিক পললের রেডিওকার্বন-ডেটিং করে দেখিয়েছেন যে আনুমানিক ৪০০ বছর আগে (ক্ষুদ্র বরফ যুগে) সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১ ডিগি সেলসিয়াস (১.৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট) কম ছিল এবং ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল ১০০০ বছর আগে (মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্বে)। [১৮]
২০০৯ সালে মাইকেল মান পুয়ের্তো রিকো, গালফ উপকূল এবং ফ্লোরিডা থেকে নিউ ইংল্যান্ড পর্যন্ত আটলান্টিক উপকূল হতে সংগৃহীত পললের সাহায্যে কিছু প্রমাণাদি পেয়েছেন যার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে মধ্যযুগীয় উষ্ণ সময়ে নর্থ আটলান্টিকে কিছু ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়েছিল তবে এর পূর্ববর্তী সময়ে ঘূর্ণিবায়ু ছিল নিস্ক্রিয়। [১৯]
ডব্লিউ প্যাটারসন এবং তার সহযোগী গবেষকরা সমুদ্র-মজ্জার আইসোটোপ বিশ্লেষণ করে এবং আইসল্যান্ডের মলাস্কা পর্বের প্রাণিদের বর্ধন পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে রোমান উষ্ণ পর্ব হতে মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্ব এবং ক্ষুদ্র বরফ যুগ পর্যন্ত সময়ে মলাস্কাদের ক্রমবিকাশ তথ্য পুননির্মান করতে সক্ষম হয়েছেন। [২০]
মাইকেল মানের ২০০৯ সালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে যে ১৯৬১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সময়ে দক্ষিণ গ্রিনল্যান্ড এবং উত্তর আমেরিকার কিছু এলাকার তাপমাত্রা মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্বের (গবেষণা অনুযায়ী যা ৯৫০-১২৫০ খ্রিষ্টাব্দ) তাপমাত্রা অতিক্রম করেছে এবং কিছু কিছু অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছে ১৯৯০-২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ে। উত্তর গোলার্ধের বেশিরভাগ এলাকার তাপমাত্রাই ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছিল ক্ষুদ্র বরফ যুগে (সংজ্ঞানুযায়ী যা ১৪০০-১৭০০ সাল)। তবে ল্যাব্রাডর এবং যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকার জলবায়ু ঐ সময়ে ১৯৬১-১৯৯০ সালের মতোই উষ্ণ ছিল। [৪]
আমেরিকায় নরওয়েজিয়ান উপনিবেশন ঘটেছিল জলবায়ুর উষ্ণতর পর্বে। ধারণা করা হয়, নরওয়েজিয়ানরা উষ্ণ জলবায়ুতে বরফ চাদর মুক্ত সমুদ্রকে কাজে লাগিয়ে গ্রিনল্যান্ডসহ সুদূর উত্তরের ভূমিতে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল।[২১] তবে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গ্রিনল্যান্ড উষ্ণ জলবায়ুতে উপনিবেশিত হয়নি বরঞ্চ উপনিবেশনে উষ্ণ জলবায়ুর প্রভাব ছিল স্বল্পমেয়াদী। [২২] ১০০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জলবায়ু পর্যাপ্ত পরিমাণে উষ্ণ ছিল, তখন ভাইকিংরা নিউফাউন্ডল্যান্ডের দিকে যাত্রা করে ক্ষণস্থায়ী ঘাঁটি গড়েছিল সেখানে। [২৩]
৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ভাইকিংরা গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণ প্রান্তে পশ্চিম এবং পূর্ব-বসতি গড়ে তুলেছিল। উপনিবেশনের প্রথম দিকে তারা গবাদি পশু, ভেড়া এবং ছাগল সঙ্গে রাখত এবং তাদের আহারের এক-চতুর্থাংশ ছিল সামুদ্রিক খাদ্য। তবে ১২৫০ সালের দিকে ঠান্ডা এবং ঝড়ো জলবায়ুতে তারা খাবারের জন্য সমুদ্র নির্ভর হতে লাগল আস্তে আস্তে এবং ১৩০০ সালের দিকে তারা খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশই সংগ্রহ করত সীল মাছ শিকার করে।
১৩৫০ সালের দিকে ইউরোপীয়দের কাছে তাদের রপ্তানী এবং বাণিজ্য চাহিদা কমে এসেছিল। সর্বশেষ বসতি স্থাপনের নথি রয়েছে ১৪১২ সালে, এরপরের যুগে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কারণে (যেমন-স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশে খামারের পর্যাপ্ততা বৃদ্ধি) অবশিষ্ট ইউরোপীয়রাও চলে এসেছিল ওখান থেকে।[২৪]
গবেষকরা দেখেছেন যে চেসপাইক সমুদ্রে (বর্তমানে যা যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড এবং ভার্জিনিয়ায় অবস্থিত) মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্বে (৯৫০-১২৫০ খ্রিঃ) এবং ক্ষুদ্র বরফ যুগে (১৪০০-১৭০০ খ্রিঃ) তাপমাত্রা বিচ্যুতি (ঐ সময়ের গড় তাপমাত্রা হতে তাপমাত্রার বিচ্যুতি) ঘটার কারণ ছিল উত্তর আটলান্টিক সাগরের থার্মোহ্যালাইন স্রোত। [২৫] এছাড়া মধ্যযুগীয় সময়ে (৮০০-১৩০০ খ্রিঃ) হাডসন উপত্যকার নিচের অংশের পিয়ারমন্ট জলাশয়ে প্রাপ্ত পলি ছিল বেশ আর্দ্র। [২৬]
যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাংশে এবং বিশেষ করে পূর্ব ক্যালিফোর্নিয়ায় ও মহা-অববাহিকার দীর্ঘস্থায়ী খরার প্রভাব পড়েছিল।[১২][২৭] আলাস্কায় তিন দফা উষ্ণ বিরামকাল এসেছিল বিভিন্ন সময়ে যথা ১-৩০০ খ্রিঃ, ৮৫০-১২০০ খ্রিঃ এবং ১৮০০ খ্রিঃ পরবর্তী সময়কাল।[২৮] আমেরিকায়, বিশেষ করে পশ্চিম আমেরিকার শুষ্ক অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অধিবাসীর উপনিবেশনের সময়কাল নির্ধারণ করতে মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্বের জ্ঞান বেশ কাজে দেয়। [২৯][৩০] সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে সাংস্কৃতিক অস্বাভাবিকতার (যেমন শুরুর দিকের স্বাস্থ্য এবং সহিংসতাজনিত সমস্যা) পরিমাণ যতটা অনুমান করা হয়েছিল, অঞ্চলভেদে তা হয়েছিল অনেক বেশি। এছাড়া বসতি বিনাশ, দূরপাল্লার ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা এবং জনসংখ্যা বিচলন ইত্যাদি সমস্যাগুলো আরও সুনিশ্চিতভাবে জানা গিয়েছে। [৩১]
নিরক্ষীয় পূর্ব আফ্রিকার জলবায়ু পরিবর্তিত হয়েছিল অতীতে এবং বর্তমানের তুলনায় আর্দ্রতর এবং শুষ্কতর। মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্বে মূলত সেখানকার জলবায়ু ছিল শুষ্ক। [৩২]
এন্টার্কটিক উপদ্বীপের পূর্ব ব্র্যান্সফিল্ড অববাহিকায় প্রাপ্ত পলল মজ্জায় মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্ব এবং ক্ষুদ্র বরফ যুগের প্রমাণ পাওয়া যায়। গবেষকরা বলেছেন, “হলোসিন যুগের শেষভাগে মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্ব পরবর্তী ক্ষুদ্র বরফ যুগে পৃথিবীর শীতলীকরণ প্রক্রিয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।”[৩৩]
ক্রান্তীয় প্রশান্ত মহাসাগরে প্রাপ্ত কোরাল থেকে ধারণা করা হয় যে বিগত সহস্রকের শুরুতে সেখানকার জলবায়ু ছিল ঠান্ডা এবং শুষ্ক যা দক্ষিণীয় এল নিনোর ছন্দপাতনের প্রেক্ষিতে লা নিনার রূপরেখার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। [৩৪]
১৫০০ বছরে সঞ্চিত হৃদ-পলল থেকে[৩৫] চিলিতে এবং ইকুয়েডরের পূর্ব করডিলেরায় মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্বের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। [৩৪]
প্রাপ্ত বরফ মজ্জার উপর ভিত্তি করে জলবায়ুর পুনর্গঠন করে দেখা যায় যে ১০৫০-১৩০০ সালের দিকে মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্ব এসেছিল এবং এর পরপরই পঞ্চদশ শতাব্দীতে এসেছিল ক্ষুদ্র বরফ যুগ। তবে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিংশ শতাব্দীর মতো এত বেশি ছিল না তখনও। বিংশ শতাব্দীর এই উচ্চ তাপমাত্রা বিগত ১৬০০ বছরে দেখা যায়নি। [৩৬]
মধ্য জাপানের নাকাৎসুনা হৃদে ২০০১ সালে অধিকারী এবং কুমন অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছেন যে, ৯০০ থেকে ১২০০ সালের দিকে একটি উষ্ণ সময় এসেছিল ঐ এলাকায়, যা মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্বের সাথে খাপ খায়। এই উষ্ণ সময়ের পর এসেছিল তিনটি শীতল দশা, যার মধ্যে দু’টি ক্ষুদ্র বরফ যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। [৩৭] উত্তর পূর্ব জাপানের অন্য একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, উক্ত এলাকায় ৭৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে একটি উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুগত বিরাম এসেছিল এবং শীতল ও শুষ্ক বিরাম এসেছুল দু’বার; প্রথমটির ব্যাপ্তি ১-৭৫০ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয়টি ১২০০ সালের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত চলছে।[৩৮] জি এবং তার সহকর্মী গবেষকরা চীনের বিগত ২০০০ বছরের তাপমাত্রা নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন যে, ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত চীনে তাপমাত্রার অসামঞ্জস্য বিদ্যমান ছিল, তবে পরবর্তী ৫০০ বছরে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ তাপমাত্রা দেখা গিয়েছে। এই ৫০০ বছরে দু’টো উল্লেখযোগ্য শীতল পর্ব এসেছিল; প্রথমটি ১৬২০ এর দশক থেকে ১৭১০ এর দশক পর্যন্ত, দ্বিতীয়টি ১৮০০ এর দশক থেকে ১৮৬০ এর দশক পর্যন্ত। তারা আরও বলেছে, ১০-১৪শ শতাব্দীতে কিছু কিছু এলাকায় যে উষ্ণ জলবায়ু দেখা গিয়েছে, তা বিংশ শতাব্দীর শেষ কিছু দশকের জলবায়ুর সাথে সংগতিপূর্ণ। গত ৫০০ বছরের তুলনায় বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঘটনা অভূতপূর্ব। [৩৯]
মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্ব এবং ক্ষুদ্র বরফ যুগ উভয়ের ক্ষেত্রেই অস্ট্রেলিয়ার উপাত্তের বেশ ঘাটতি রয়েছে। তবে পূর্ণ স্থায়ী আইয়র হৃদের তরঙ্গ নির্মিত নুড়ি সোপান থেকে [৪০] অস্ট্রেলিয়ার ৯-১০ম শতাব্দীর যে জলবায়ুর প্রমাণ পাওয়া যায়, তা লা নিনার রূপরেখার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কি করে হৃদটির স্তরবিন্যাসে পরিবর্তন এসেছে কিংবা ঐ সময়ে অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য এলাকায় জলবায়ু কেমন ছিল, তা স্বল্প উপাত্তের প্রেক্ষিতে বলা কঠিন। ১৯৭৯ সালে ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, “নিউজিল্যান্ডের এক গুহায় প্রাপ্ত (৪০.৬৭ ডিগ্রি দক্ষিণ এবং ১৭২.৪৩ ডিগ্রি পূর্ব অক্ষাংশে অবস্থিত) স্টেলেগমাইটে অক্সিজেন-১৮ এবং অক্সিজেন-১৬ এর অনুপাত হতে মধ্যযুগীয় তাপমাত্রা বের করা হয়েছে এবং এই হিসেব অনুযায়ী মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্ব এসেছিল ১০৫০-১৪০০ খ্রিষ্টাব্দে। তখনকার তাপমাত্রা এ গবেষণা অনুযায়ী বর্তমান তাপমাত্রার চেয়ে ০.৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।” [৪১] নিউজিল্যান্ডের একটি ১১০০ বছরের গাছের প্রস্থচ্ছেদের নথি থেকে এ সংক্রান্ত আরও কিছু প্রমাণাদি পাওয়া যায়। [৪২]
6.2 Evidence for a Medieval Warm Epoch
|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)