মাই ভাগো | |
---|---|
জন্ম | ১৬৭০ ঝাবাল, পাঞ্জাব |
মৃত্যু | ১৭২০ নান্দেড়, মহারাষ্ট্র |
দাম্পত্য সঙ্গী | পট্টির ভাই নিধান সিং |
পিতা | ভাই মালো শাহ |
ধর্ম | শিখ ধর্ম |
মাই ভাগো নামেও পরিচিত মাতা ভাগ কৌর জি ছিলেন একজন শিখ মহিলা, যিনি ১৭০৫ সালে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শিখ সৈন্যদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে একজন ব্যতিক্রমী দক্ষ যোদ্ধা ছিলেন এবং শিখ ধর্মে একজন যোদ্ধা সাধু হিসাবে সম্মানিত। আনন্দপুর সাহিব অবরোধের সময় গুরু গোবিন্দ সিংকে ত্যাগ করে যাওয়া ৪০ জন শিখকে (চালি মুক্তে) নিয়ে সমাবেশ করার জন্য তিনি পরিচিত ছিলেন এবং তিনি তাদের আবার যুদ্ধে ফিরিয়ে এনেছিলেন। কিছু পণ্ডিত তাঁকে দেবী চণ্ডীর অবতার হিসাবে বিবেচনা করেন।
মাই ভাগো একটি ধিল্লোঁ জাট শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।[১][২] তাঁর পরিবারের পৈতৃক গ্রাম ছিল চাবাল কালান (অথবা ঝাবাল কালান), যেটি বর্তমানে পাঞ্জাবের তরন তারান জেলায় অবস্থিত।[৩] তিনি জন্মগতভাবে একজন কট্টর শিখ ছিলেন এবং একটি ধর্মপ্রাণ শিখ পরিবারে তাঁর লালন-পালন হয়েছিল। তাঁর বাবা মালো শাহ গুরু হরগোবিন্দের সেনাবাহিনীতে নাম লেখান।[৪] বাবার মতোই মাই ভাগোও শস্ত্র বিদ্যা (অস্ত্রের প্রশিক্ষণ) শিখেছিলেন। ভাই লাঙ্গার ছোট ভাই, ভাই পেরো শাহের নাতনি ছিলেন মাই ভাগো। ভাই লাঙ্গা ৮৪টি গ্রামের প্রধান ছিলেন এবং পঞ্চম শিখ গুরু অর্জন দেবের (১৫৬৩ - ১৬০৬) সময়ে শিখ ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।[৫][৬] মাই ভাগোর দুই ভাই ছিলেন দিলবাগ সিং এবং ভাগ সিং।[৭] বাল্যকালে তাঁর বাবা-মা তাঁকে গুরু গোবিন্দ সিং- এর দর্শন (ঝলক) করতে আনন্দপুর সাহিবে নিয়ে যান। তিনি পাত্তির ভাই নিধান সিংকে বিয়ে করেছিলেন।[৮]
গুরুকে বন্দী করার প্রয়াসে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে উজির খানের (সিরহিন্দ অঞ্চলের) নেতৃত্বে বিশাল মুঘল সেনাবাহিনী লাহোর ও কাশ্মীরের মুঘল সেনাবাহিনীর সাথে আনন্দপুর সাহিবের দিকে অগ্রসর হয়।[৯]
১৭০৪ সালের দিকে[১০] মুঘল পার্বত্য সর্দাররা আনন্দপুর সাহিবকে ঘেরাও করে। কয়েক মাস ধরে অবরোধ করে রেখে খাদ্য বন্টনের ব্যবস্থা আটকে দিয়ে তারা এটিকে খালি করার দাবি জানায়।[১১] তারা ঘোষণা করেছিল যে, যে শিখ বলবে "সে আর গুরু গোবিন্দের শিখ (শিষ্য) নয়" তাকে আঘাত করা হবেনা এবং অন্যদের "হত্যা করা হবে"। মহান সিং রাতাউলের নেতৃত্বে ৪০ জন শিখের একটি দল (চালি মুক্তে),[১২] গুরু গোবিন্দ সিংয়ের শিষ্যত্ব অস্বীকার করেছিল। গুরু তাদের বলেছিলেন যে তাদের লিখিত ভাবে দিতে হবে "আমরা আর তোমার শিখ নই" এবং তাতে স্বাক্ষর করতে হবে। সমস্ত চল্লিশ শিখ ('বেদাভা' বাদে সকলে) এই নথিতে স্বাক্ষর করেছিল এবং গুরু গোবিন্দ সিংকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
গুরু গোবিন্দ সিং-এর পক্ষে লড়াই করার জন্য আনন্দপুরে যাওয়া কিছু শিখ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে গুরুকে ত্যাগ করেছে শুনে মাই ভাগো দুঃখ পেয়েছিলেন। তিনি তাদের প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছিলেন; তাঁর কটূক্তি শুনে এই শিখরা তাদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য লজ্জিত হয়েছিল।[১৩] মাই ভাগো তাদের নিয়ে সমাবেশ করেন এবং তাদের গুরুর সাথে দেখা করে ক্ষমা চাইতে রাজি করান। তিনি তাদের (এবং অন্য কিছু শিখদের) সাথে রওনা হন মালওয়া জুড়ে ভ্রমণ করা গুরুর খোঁজ করতে।
একজন বার্তাবাহক কুরআনের অনুলিপিতে আওরঙ্গজেবের স্বাক্ষরিত একটি শপথ নিয়ে এসেছিলেন, তাতে গুরুকে আশ্বাস দিয়ে লেখা হয়েছিল যে তিনি যদি দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসেন তবে সম্মানজনক শর্তে স্থায়ী শান্তি আলোচনা করা হবে। মুঘল সেনাবাহিনীর সমস্ত জেনারেল এবং পার্বত্য প্রধানদের স্বাক্ষরিত একটি শপথ দ্বারা সম্রাটের শপথকে সমর্থন করা হয়েছিল।[১৪] গুরু গোবিন্দ সিং এই আশ্বাসগুলিতে বিশ্বাস করেননি,[১৫] কিন্তু মুঘলদের আসল চেহারা দেখানোর জন্য, গুরু দুর্গ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
গুরু গোবিন্দ সিং আনন্দপুরের দুর্গ খালি করেন। বিশ্বাসঘাতক মুঘল সেনাবাহিনী এবং পার্বত্য প্রধানদের দ্বারা পশ্চাদপসরণের সময় তাঁর সন্তানদের বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। ছোট দুইজন, সাহেবজাদা জোরাওয়ার সিং এবং সাহেবজাদা ফতেহ সিং, তাদের ঠাকুমা মাতা গুজরি কৌরের (গুরু গোবিন্দ সিংয়ের মা) সাথে গিয়েছিলেন এবং বড় দুইজন, সাহেবজাদা অজিত সিং এবং সাহেবজাদা জুজহার সিং তাঁদের বাবার সাথে গিয়েছিলেন। চমকৌরের যুদ্ধে গুরুর বড় ছেলেরা শহীদ হন। পঞ্চ প্রিয়ের নির্দেশে গুরু চমকৌর ত্যাগ করেন।[১৬] মালব অঞ্চলের জঙ্গলে আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যবাদী মুঘল বাহিনী দিনরাত গুরু গোবিন্দ সিং-এর বাহিনীকে তাড়া করে বেড়াত।[১৭]
গুরু এবং সেইসঙ্গে মাই ভাগো ও অন্যান্য পুরুষেরা খিদরানা গ্রামে পৌঁছেছিলেন। এলাকার একমাত্র জলের উৎস খিদরানার ধাব বা জলাশয়টি মুঘল রাজকীয় বাহিনী দখল করে নিয়েছিল, মাই ভাগো সেখানে আসেন।[১৮]
মাই ভাগো এবং তাঁর লোকেরা ১০,০০০ পশ্চাদ্ধাবনকারী মুঘল বাহিনীর উপর আক্রমণ করে। মাই ভাগো এবং ৪০ জন মুক্তিপ্রাপ্ত শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী মুঘল সেনাবাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। সেইসময় গুরুর বাহিনী কাছাকাছি উঁচু ভূমি থেকে মুঘলদের উপর তীর বর্ষণ করছিল। গুরু গোবিন্দ সিং যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করার সময় মাই ভাগো এবং দলের পূর্ববর্তী নেতা গুরুতর আহত মহান সিং ব্যতীত সকলকে মৃত দেখতে পান। গুরু মহান সিংকে কোলে নেওয়ার সাথে সাথে তিনি মারা যান।[১৯] শিখদের মধ্যে চল্লিশ জন এবং সেইসাথে মাই ভাগোর ভাই ও স্বামী [২০] এই কঠিন যুদ্ধে শহীদ হন। কোন কোন সূত্র বলে, সেখানে মাই ভাগোর সন্তানরাও শহীদ হয়েছিলেন।[২১]
গুরু গোবিন্দ সিং সেই চল্লিশজন মৃতকে চালি মুক্তে বা চল্লিশ মুক্ত বলে আশীর্বাদ করেছিলেন। তিনি গুরুতর আহত মাই ভাগোকে নিজের তত্ত্বাবধানে নেন।[২২]
মাই ভাগো তালওয়ান্দি সাবোতে গুরু গোবিন্দ সিং-এর সাথে থাকতেন।[২৩] তিনি হয়তো নিহঙ্গের পোশাক ধারণ করেছিলেন।[২৪] গুরুর হুজুর সাহিবে যাবার সময় তিনি গুরুর দশজন দেহরক্ষীর একজন হয়ে বল্লম (প্রায় ১০২ পাউণ্ড ওজনের)[২৫] ও মাস্কেট (বন্দুক)[২৬] নিয়েছিলেন এবং পুরুষ পোশাক পরিধান করেছিলেন।[২৭]
১৭০৮ সালে নান্দেড়ে গুরু গোবিন্দ সিংয়ের মৃত্যুর পর, মাই ভাগ কৌর আরও দক্ষিণে চলে যান। তিনি কর্ণাটকের বিদার থেকে ১১ কিমি দূরে জানওয়াদায় তাঁর ডেরা স্থাপন করেন। সেখানে তিনি ধ্যানে নিমগ্ন হন এবং দীর্ঘ জীবন যাপন করে গুরুমত (গুরুর পথ) শেখান।[২৮] জনওয়াড়ায় তাঁর কুঁড়েঘরটি এখন উপাসনা ও শিক্ষার স্থান, গুরুদ্বার তপ আস্থান মাই ভাগোতে রূপান্তরিত হয়েছে। নান্দেড়েও, তখত সচখন্দ শ্রী হুজুর সাহেবের প্রাঙ্গণের মধ্যে তাঁর প্রাক্তন বাসভবনের স্থানটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেটি বুঙ্গা মাই ভাগো নামে পরিচিত।
হুজুর সাহিবের জাঠেদার মোহন সিং, ১৭৮৮ সালে মাই ভাগ কৌরের স্মৃতিতে একটি বুঙ্গা (যুদ্ধ টাওয়ার) তৈরি করেছিলেন।[২৯] মাই ভাগোর অস্ত্র ভারতের নান্দেড়ের আবচালনগর হুজুর সাহিব গুরুদ্বার কমপ্লেক্সে রাখা আছে।
|শিরোনাম=
অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
|শিরোনাম=
অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)