মায়া সূর্য, আবহাওয়াবিজ্ঞানের ভাষায় পারহেলিয়ন[১] (বহুবচনে পারহেলিয়া), হলো বায়বীয় আলোকীয় ঘটনা। সূর্যের এক বা উভয় পাশে একটি করে উজ্জ্বল বিন্দু প্রত্যক্ষ করা যায়। মায়া সূর্যদ্বয় সাধারণত সূর্যের পাশের ২২° বর্ণবলয় বরাবর আবির্ভূত হয়।
মায়া সূর্য হলো বর্ণবলয় গোত্রের প্রাকৃতিক ঘটনা। বরফ স্ফটিক দ্বারা বায়ুমণ্ডলে আলোর প্রতিসরণ হলে মায়া সূর্য অবলোকন করা যায়। মায়া সূর্য সাধারণত আসল সূর্যের দুই পাশে এবং উপরে ২২° দূরত্বের আশেপাশে রঙের একটি রেখা বা প্যাচ হিসেবে আবির্ভূত হয়। পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে যেকোনো ঋতুতে এই ঘটনা অবলোকন করা যায়। তবে সবক্ষেত্রে মায়া সূর্য তেমন উজ্জ্বল হয় না। দিগন্তের নিকটবর্তী সূর্যের মায়া সূর্য সবচেয়ে ভালোভাবে এবং সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়।
উচ্চ সাসপেনশনীভূত এবং শীতল অলক মেঘ বা স্তরীভূত অলক মেঘ অথবা হীরক বালুর নিম্ন তাপমাত্রায় তাড়িত জলীয় বায়ুর হিমায়নের ফলে মেঘে থাকা পাত-সদৃশ ষড়ভুজাকার বরফ স্ফটিকে আলোর প্রতিসরণ বা বিক্ষেপন দ্বারা সাধারণত মায়া সূর্য উৎপন্ন হয়।[২] স্ফটিকগুলো প্রিজমের মতো কাজ করে এর মধ্যে দিয়ে গমনশীল আলোকরশ্মিকে অন্তত ২২° বিচ্যুতি পর্যন্ত বাঁকিয়ে দেয়। ষড়ভুজাকার স্ফটিকগুলো ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে আনুভূমিক বরাবর হলে সূর্যালোকও আনুভূমিকভাবে প্রতিসরিত হয়। এক্ষেত্রে সূর্যের ডান ও বাম পাশে মায়া সূর্যের আবির্ভাব ঘটে। বৃহৎ পাতগুলো সূর্যালোককে অধিক বিচ্যুত করে। ফলে অধিক লম্বা মায়া সূর্য সৃষ্টি হয়।[৩]
সূর্যের নিকটবর্তী মায়া সূর্যের অংশ লাল বর্ণের হয়। এটি ধীরে ধীরে বাইরের দিকে কমলা হয়ে নীল বর্ণের হয়। এই বর্ণগুলো উপরিস্থাপিত ও পরিবর্তিত হয় এবং কখনো বিশুদ্ধ বা সম্পৃক্ত হয় না।[৪] মায়া সূর্যের বর্ণ শেষ পর্যন্ত সাদা অপসুর বৃত্তের সাথে মিলিত হয় (যদি তা বিদ্যমান থাকে)।[৫]
একই পাতসদৃশ বরফ স্ফটিক মায়া সূর্যের পাশাপাশি বর্ণীল সার্কামজেনিথাল রংধনুও তৈরির জন্য দায়ী। অর্থাৎ এই দুই ধরনের বর্ণ বলয়ের একই সাথে উৎপন্ন হওয়ার প্রবণতা থাকে।[৬] এক্ষেত্রে রংধনুটি কমবেশ মাথার উপরে তৈরি হওয়ায় অধিকাংশ মানুষ অবলোকন করতে পারেন না। এছাড়াও ২২° বর্ণবলয়ে আরেকটি বলয় দেখা যায়, যা আসল সূর্য থেকে প্রায় একই কৌণিক দূরত্বে সৃষ্টি হয়ে মায়া সূর্যগুলোকে একটি আংটি বা বলয়ে পরস্পর সংযুক্ত করে বলে মনে হয়। সূর্য যত উপরে উঠতে থাকে, পাত স্ফটিকের মধ্য দিয়ে গমনকারী রশ্মিগুলো ততোই তির্যকভাবে সরে যেতে থাকে। ফলে বিচ্যুতি কোণ বেড়ে যার এবং মায়া সূর্য একই উচ্চতায় ২২° বলয় থেকে দূরে সরে যেতে থাকে।[৭]
পৃথিবীর বাইরে অন্যান্য গ্রহ ও চাঁদে মায়া সূর্যের আবির্ভাব হবে কিনা তা পূর্বানুমান করা সম্ভব। মঙ্গল গ্রহে খুব সম্ভবত পানি ও কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2) উভয়ের বরফ থেকে মায়া সূর্য সৃষ্টি হয়। অন্যান্য গ্যাসীয় দানব গ্রহ, যেমন বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুনে অ্যামোনিয়া, মিথেন ও অন্যান্য পদার্থের স্ফটিকাকার মেঘের মাধ্যমে বর্ণবলয় এবং চার বা ততোধিক মায়া সূর্য সৃষ্টি হতে পারে।[৮]
সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত একটি ভুল ধারণা হলো যেকোনো বরফঘটিত বর্ণবলয়কে (বিশেষ করে ২২° বর্ণবলয়, যেটা সবচেয়ে সাধারণ প্রকার) "মায়া সূর্য" ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু মায়া সূর্য হলো অনেক প্রকারের বর্ণবলয়ের একটি প্রকারভেদ মাত্র। এই আবহাওয়াগত ঘটনার সাধারণ সংজ্ঞার্থে (বরফ স্ফটিকঘটিত) বর্ণবলয়(সমূহ) অধিক উপযোগী।
"মায়া সূর্য" এর ইংরেজি পরিভাষা sun dog ("সান ডগ" বা সূর্যের কুকুর) এর উৎপত্তি এখনও রহস্যময়। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান এই শব্দটির "উৎপত্তি অজ্ঞাত" বলে মন্তব্য প্রদান করে।[৯]
১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত আব্রাম পামারের বই ফোক-ইটিমোলজি: অ্যা ডিকশনারি অব ভার্বাল করাপশনস অর ওয়ার্ডস পারভার্টেড ইন ফর্ম অর মিনিং, বাই ফলস ডিরাইভেশন অর মিসটেকেন অ্যানালজি অনুসারে মায়া সূর্য (sun dog) এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে:
The phenomena [sic] of false suns which sometimes attend or dog the true when seen through the mist (parhelions). In Norfolk a sun-dog is a light spot near the sun, and water-dogs are the light watery clouds; dog here is no doubt the same word as dag, dew or mist as "a little dag of rain" (Philolog. Soc. Trans. ১৮৫৫, পৃষ্ঠা. ৮০). Cf. Icel. dogg, Dan. and Swed. dug = Eng. "dew."[১০]
(ইংরেজি ভাষায় Dog শব্দটি একটি ক্রিয়া হিসেবে "(শিকার) খোঁজা, অনুসরণ করে খোঁজা, অনুসরণ করা" অর্থ দিতে পারে।[১১] তা ১৫১০ এর দশক থেকে Dog the true [sun] বাক্যাংশ "প্রকৃত (আসল) [সূর্য]কে অনুসরণ করা" অর্থ দিয়ে থাকতে পারে।[১২])
আবার জোনাস পার্সন স্ক্যান্ডিনেভীয় ভাষায় কিছু নর্স পুরাণ এবং আর্কীয় নাম উল্লেখ করেন — ডেনীয়: solhunde (সূর্যের কুকুর), নরওয়েজীয়: solhund (সূর্যের কুকুর), সুইডীয়: solvarg (সূর্যের নেকড়ে) — এগুলো দুইটি তারাকে নির্দেশ করে। পুরাণ অনুসারে এই নেকড়েরা একের পর আরেকজন যথাক্রমে সূর্য ও চন্দ্রকে অনুসরণ করে। এই পৌরাণিক কাহিনী থেকে ইংরেজি শব্দটির উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে।[১৩]
Parhelion ("পারহেলিয়ন"; উপসুর) (বহুবচনে parhelia) প্রাচীন গ্রিক: παρήλιον (parēlion শব্দ থেকে আগত, যার অর্থ 'সূর্যের পার্শ্ববর্তী'; παρά অর্থ হলো para বা 'পার্শ্ববর্তী' এবং ἥλιος শব্দের অর্থ হলো helios বা 'সূর্য'।[১৪]
যুক্তরাজ্যের কর্নওয়ালের ইঙ্গ-কর্নীয় উপভাষায় "sun dog" শব্দটি weather dog হিসেবে পরিচিত ("খারাপ আবহাওয়ার পূর্বাভাস হিসেবে দিগন্তে প্রস্ফূটিত এক খণ্ড রংধনু" হিসেবে বর্ণিত)। এটি a lagas in the sky হিসেবেও পরিচিত। এটি কর্নীয় ভাষায় মায়া সূর্যের প্রতিশব্দ lagas awel থেকে আগত, যার অর্থ 'আবহাওয়া বা হাওয়ার চোখ' (lagas, 'চোখ' এবং awel, 'আবহাওয়া/বায়ু')। এটি আবার ইঙ্গ-কর্নীয় cock's eye শব্দের সাথে সম্পর্কিত, যা সূর্য ও চন্দ্রের আশেপাশের গোলাকার বর্ণবলয়কে নির্দেশ করে। এটি খারাপ আবহাওয়ার পূর্ব লক্ষণ হিসেবেও বিবেচিত।[১৫]
অ্যারিস্টটল (মিটিওরলজি তৃতীয় খণ্ড.২, ৩৭২এ১৪) উল্লেখ করেন যে "সূর্যের সাথে দুইটি মায়া সূর্য উদিত হয় এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত সারা দিন সূর্যকে অনুসরণ করে।" তিনি বলেন "মায়া সূর্য" সর্বদাই সূর্যের পাশে থাকে, কখনো উপরে বা নিচে থাকে না। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় খুব সাধারণভাবে দেখা যায় কিন্তু দিনের মাঝামাঝি সময়ে কিঞ্চিৎ দৃশ্যমান।[১৬]
কবি অ্যারেটুস (ফিনোমেনা, লাইন ৮৮০–৮৯১) তার আবহাওয়া সংকেতের তালিকায় পারহেলিয়ার কথা উল্লেখ করেন। তার অনুসারে এটি বৃষ্টি, দমকা বাতাস বা কোনো আগমনশীল ঝড়ের পূর্বাভাস দেয়।[১৭]
আর্টেমিদোরুস তার ওনেইরোক্রিটিকায় ('স্বপ্নের ব্যাখ্যা') মায়া সূর্যকে মহাজাগতিক দেবতার জীবনের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।[১৮]
মায়া সূর্যের উল্লেখকারী বহু গ্রিক ও রোমান লেখার মধ্যে অন্যতম হলো সিসারোর দা রি পাবলিকা (৫৪–৫১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। এতে মায়া সূর্য এবং সমতুল্য প্রাকৃতিক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়:
টুবেরো বললো, তাই হোক; তুমি যখন আমায় আমন্ত্রণ জানিয়েইছো, অন্যরা আসার আগে চলো আমরা পারহেলিয়ন বা দ্বৈত সূর্যের, যার উল্লেখ সিনেটে করা হয়েছিল, তার প্রাকৃতিক কারণ কী হতে পারে তা অনুসন্ধান করি। যারা এই বিস্ময়কর বস্তু অবলোকন করেছিল, তারা সংখ্যায়ও কম নয়, অনুল্লেখযোগ্যও কেউ নয়, তাই ঘটনা অবিশ্বাস করার চেয়ে অনুসন্ধান করার অনেক কারণ আছে।[১৯]
সেনেকা তার প্রথম বই ন্যাচারালিস কোয়েশ্চেনিস-এ মায়া সূর্যের আবির্ভাব ঘটার বর্ণনা করেন।[২০]
দ্বিতীয় শতাব্দীর রোমান লেখক ও দার্শনিক লুসিয়াস এপুলিয়াস তার অ্যাপোলজিয়ার পঞ্চদশ খণ্ডে উল্লেখ করেন, "রংধনুর প্রিজমের মতো রং ধারণের কারণ কী, কিংবা স্বর্গে সূর্যের দ্বৈত চেহারার, সাথে কতিপয় অন্যান্য প্রাকৃতিক ঘটনার, যা সিরাকুজের আর্কিমিডিসের বিরাট খণ্ডে উল্লেখ করা হয়েছে।"
শার্ত্রেসের ফুশার দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তার হিস্টোরিয়া হায়ারোসোলিমিটানায় (১১২৭) জেরুজালেমের ওপর একটি টীকা লেখেন। ১১০৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি লেখেন:
... তৃতীয় প্রহর (সকাল নয়টা) থেকে মধ্যদিন পর্যন্ত আমরা সূর্যের ডানে ও বামে আরও দুইটি সূর্যের মতো কিছু দেখলাম: এরা বড়টির মতো তেমন আলো দিচ্ছিল না, বরং আকারে ও উজ্জ্বলতায় ছোট এবং কিছুটা লালাভ ছিল। তাদের বলয়ের ওপর একটি বর্ণচক্র আবির্ভূত হয়, এটি খুব উজ্জ্বল ছিল, আকারে বাড়ছিল, যেন কোনো একটি প্রকাণ্ড শহর। চক্রের ভেতর রংধনুর মতো আরেকটি অর্ধচক্র আবির্ভূত হলো, এটি চার বর্ণের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, এর মাথা পূর্বোক্ত দুইটি সূর্যের দিকে বাঁকানো ছিল, যেন সূর্যের বন্ধনের মতো পরস্পরকে স্পর্শ করেছিল।[২১]
[1551] And also abowte Ester was sene in Sussex three sonnes shenynge at one tyme in the eyer, that thei cowde not dysserne wych shulde be the very sonne.
ক্রনিকল অব দ্য গ্রে ফ্রায়ার্স অব লন্ডন, [লন্ডন] ক্যামডেন সোসাইটির জন্য মুদ্রিত, ১৮৫২
১৪৬১ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের হ্যারিফোর্ডশায়ারে অনুষ্ঠিত মর্টিমার্স ক্রসের যুদ্ধের প্রারম্ভে তিনটি সূর্য সমন্বয়ে একটি বর্ণবলয়ের আবির্ভাব হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। হাউজ অব ইয়র্ক কমান্ডার ও পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের চতুর্থ অ্যাডওয়ার্ড তার প্রাথমিকভাবে ভীত সৈন্যদলকে এটা বোঝান যে, এই ত্রিমূর্তি ডিউক অব ইয়র্কের তিন পুত্রের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং অ্যাডওয়ার্ডের বাহিনী সে যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হয়। এই ঘটনার অবলম্বনে উইলিয়াম শেকসপিয়র হেনরি ফোর, পার্ট ৩,[২২] এবং শ্যারন কায় পেনম্যান দ্য সানি ইন স্প্লেন্ডোর শিরোনামে নাটকায়িত করেন।
মায়া সূর্যের আরেকটি পরিষ্কার বর্ণনা পাওয়া যায় জ্যাকব হাটারের লেখনীতে। তিনি তার ব্রাদার্লি ফেইথফুলনেস: এপিসলস ফ্রম অ্যা টাইম অব পার্সিকিউশন এ লেখেন:
আমার প্রিয় সন্তানেরা, আমি তোমাদের বলতে চাই যে, আমাদের ভাই কান্টজ ও মিশেলের চলে যাওয়ার পরে, এক শুক্রবার দিনে, আমরা বেশ অনেকক্ষণ আকাশে তিনটি সূর্য দেখলাম, প্রায় এক ঘণ্টা যাবৎ, আর সেই সাথে দুইটি রংধনু। এদের পিঠ একে অপরের দিকে মুখ করে ছিল, প্রায় মাঝ বরাবরে লাগোয়া, আর তাদের প্রান্ত ছিল একে অপরের থেকে বিপরীতে। এবং আমি, জ্যাকব, নিজের চোখে তা দেখেছি, এবং অনেল ভাই ও বোন আমার সাথেই এটি দেখেছে। কিছু সময় পর দুইটি সূর্য এবং রংধনু অদৃশ্য হয়ে যায় এবং কেবল একটি সূর্য বাকি থাকে। বাকি দুইটি সূর্য অন্যটির মতো তেমন উজ্জ্বল না হলেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আমি অনুভব করি, এটি কোনো সামান্য অলৌকিক ঘটনা ছিল না।…[২৩]
খুব সম্ভবত ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ অক্টোবর মোরাভিয়ার অস্পিজে (হুস্টোপেচে) জ্যাকব হাটার এই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এটি মূলত জার্মান ভাষায় একটি চিঠিতে লেখা হয়েছিল, যা প্রধানত মোরাবিয়ার অস্পিজ থেকে ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে টিরোলের আদিজ উপত্যকায় পাঠানো হয়। চিঠিতে উল্লিখিত কান্টজ মুরার এবং মিশেল শুস্টার সাইমন ও জুডের ভোজের পর মঙ্গলবার হাটারের থেকে বিদায় নেয়। সেদিন ছিল ২৮ অক্টোবর। ৩০ অক্টোবর ছিল বৃহস্পতিবার।[২৪] উল্লিখিত আরও দুইটি রংধনু ৪৬° বর্ণবলয় বা সুপ্রাল্যাটারাল রংধনুর সাথে সার্কামজেনিথাল রংধনু (যা মায়া সূর্যের সাথে আবির্ভূত হয়ে থাকে) হয়ে থাকতে পারে।[২৫]
স্টকহোম শহরের সবচেয়ে পরিচিত এবং সবচেয়ে পুরনো রঙিন চিত্র হিসেবে উক্ত ভাদেরসোলস্তাভ্লান (সুয়েডীয়; "দ্য সানডগ পেইন্টিং", আক্ষরিকভাবে "আবহাওয়া সূর্যের চিত্র") নামক দুইটি মায়া সূর্যসম্বলিত চিত্রটিকে কখনো কখনো বর্ণবলয়ের সবচেয়ে পুরনো চিত্র বলে আখ্যা দেওয়া হয়। ১৫৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল শহরের আকাশে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী সূর্যের চারদিকে আকাশ সাদা বলয়ে পূর্ণ হয়ে যায় এবং অতিরিক্ত সূর্যের (মায়া সূর্য) আবির্ভাব ঘটে। এই ঘটনার পর খুব দ্রুত জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়ে যে ১৫২০ এর দশকে প্রোটেস্ট্যান্টবাদ প্রচারের জন্য এবং ডেনীয় রাজার সাথে মৈত্রী স্থাপনকারী শত্রুদের বিরুদ্ধে অত্যাচার করার জন্য দেবতারা ১ম গুস্তাভের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের পূর্ব সংকেত প্রদান করেছেন।
মায়া সূর্য নিয়ে জল্পনার অবসান ঘটানোর জন্য চ্যান্সেলর ও লুথারবাদী পণ্ডিত ওলাউস পেত্রি (১৪৯৩–১৫৫২) এই ঘটনার নথি হিসেবে একটি চিত্রাঙ্কনের নির্দেশ দেন। কিন্তু রাজার সামনে চিত্রটি আনা হলে তিনি তা ষড়যন্ত্রমূলক হিসেবে ব্যাখ্যা দেন। তিনি নিজেকে আসল সূর্যের সাথে তুলনা করে অপর দুই সূর্যকে তার সাথে প্রতিযোগিতাকারী ওলাউস পাত্রি এবং পাদ্রি ও পণ্ডিত লরেনটিউস অ্যান্ড্রিকে (১৪৭০–১৫৫২) দুই নকল সূর্যের তুলনা দেন। এভাবে তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও কৌশলে সর্বোচ্চ শাস্তি এড়ানোর অভিযোগ আনেন। অঙ্কিত চিত্রটির মূল কপিটি হারিয়ে যায়, কিন্তু এটির ১৬৩০ এর দশকে তৈরি একটি প্রতিলিপি মধ্য স্টকহোমের স্টোরকাইরান এলাকার একটি গির্জায় সংরক্ষিত আছে।
ক্রিস্টোফ শাইনার তার রচিত পারহেলিয়া বইয়ে রোমে ১৬২৯ খ্রিষ্টাব্দ এবং ১৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে আবার সংঘটিত এক সারি জটিল মায়া সূর্য আবির্ভাবের ঘটনা লিপিবদ্ধ করে রাখেন। এ জাতীয় প্রাকৃতিক ঘটনা ব্যাখ্যার জন্য এটিই সর্বপ্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। এই কর্মের অন্তর্নিহিত প্রভাবের কারণে রেনে দেকার্তে তার আধ্যাত্মিকতার চর্চায় হস্তক্ষেপ করেন এবং প্রাকৃতিক দর্শনের ওপর দ্য ওয়ার্ল্ড গ্রন্থ রচনায় প্রভাবিত হন।[২৬]
১৬৬১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি ডানজিগের অধিবাসীরা একটি জটিল মায়া সূর্য আবির্ভাবের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন, যাতে একসাথে সাতটি সূর্য দেখা যায়। জর্জ ফেলাউ একটি প্যামফ্লেটে একে অলৌকিক সাত সূর্য ("Sevenfold Sun Miracle") হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পরের বছর জোহান্স হেভেলিয়াস তার মার্কিউরিয়াস ইন সোল ভাইসাস গেদানি গ্রন্থে এই ঘটনার পুনরুল্লেখ করেন।
১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জুন জোহাম টোবিয়াস লোইটজ সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি জটিল বর্ণবলয় ও মায়া সূর্য পর্যবেক্ষণ করেন, যেটিকে তার নামে লোইটজ আর্ক বলা হয়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নিউফাউন্ডল্যান্ডে ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের শীতকালকে "তিন সূর্যের শীত" বলে আখ্যায়িত করা হয়। সেই বছর অস্বাভাবিকভাবে ১৫ দিন পর্যন্ত তাপমাত্রা শুন্যের নিচে ৩-১০ ডিগ্রির মধ্যে ছিল।[২৭]
"সেই সময়ের কিছু অংশে আমরা প্রচন্ড তুষার ঝড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাই। দিনের প্রতি ঘণ্টায় হালকা ধূসর কুয়াশার পেছনে দুইজন প্রতিদ্বন্দ্বীসহ সূর্যকে দেখতে পাচ্ছিলাম, যাকে সাধারণ ভাষায় "সান-ডগ" বলা হয়। এর বর্ণবলয়ের ছটা অভিযাত্রিকদের সর্বদা অতিক্রমণকৃত বরফকেও ছাড়িয়ে যেতে সতর্ক করছিল।"[২৮]
২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি চীনের ইনার মঙ্গোলিয়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের অধিবাসীরা একত্রে পাঁচটি সূর্য অবলোকন করেন। পাঁচটি সূর্যের বলয় একটি চক্র গঠন করে একে অপরের সাথে সংযুক্ত ছিল।