মারজ-ই-দাবিকের যুদ্ধ (আরবি: مرج دابق; তুর্কি: Mercidabık Muharebesi) ছিল প্রথম সেলিমের নেতৃত্বে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী এবং আল-আশরাফ কানসু আল-ঘুরির নেতৃত্বে মামলুক সালতানাতের সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘটিত একটি যুদ্ধ। এ যুদ্ধটি ১৫১৬ সালের ২৪ আগস্ট আলেপ্পোর (বর্তমানে সিরিয়া) থেকে ৪৪ কিলোমিটার উত্তরে দাবিক শহরে সংঘটিত হয়েছিল।[৭] এ যুদ্ধের ফলে উসমানীয়রা বিজয় লাভ করেছিল এবং মামলুক সালতানাতের ধ্বংস নিয়ে এসেছিল।
আল-আশরাফ কানসু আল-ঘুরি আনাতোলিয়ায় অশান্ত সীমানার দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য ১৫১৫ সালের শীতকালে ও ১৫১৬ সালের বসন্তে সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেছিল।[৮] অগ্রসর হওয়ার আগে, সুলতান সেলিম বন্ধুত্বপূর্ণ শর্তে মামলুকের কাছে একজন দূতাবাস পাঠিয়ে বলেন যে, মামলুক সালতানাত এবং উসমানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে দীর্ঘকালীন বাফার রাষ্ট্রে দুলকাদিরের বেয়লিকে একজন মিশরীয় ভাসাল নিয়োগ করতে এবং পণ্য পরিবহন ও দাসদের জন্য সীমান্ত পুনরায় উন্মুক্ত করতে।[৯] ১৮ মে আল-আশরাফ কানসু আল-ঘুরি তার বিশাল বাহিনী নিয়ে কায়রো থেকে যাত্রা শুরু করেন। তার বাহিনীতে গোলন্দাজ বাহিনী ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে ভালো বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছিল।[১০]
দ্বিতীয় তুমান বেকে কায়রোর নিয়ন্ত্রণে রেখে সুলতান ও তার সেনাবাহিনী মহা ধুমধামের সাথে উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করেন।[১১] যুদ্ধে তিনি এক হাজার পনেরো জন উচ্চপদস্থ আমীর, রাজকীয় মামলুকের পাঁচ হাজার সৈন্য ও মিলিশিয়া সৈন্য, সহায়ক বাহিনী এবং বেদুঈন সৈন্যদল নিয়েছিলেন।[১২] রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আব্বাসীয় খলিফা তৃতীয় মুতাওয়াক্কিল, শেখ এবং সভাসদ, মুয়াজ্জিন, চিকিৎসক এবং সঙ্গীতজ্ঞরাও তার সাথে ছিলেন।[১৩]
কায়রো থেকে আসার পথে আল-ঘুরি সুলতান প্রথম সেলিমের ভাগ্নে আহমেদকে পেয়েছিলেন এবং উসমানীয় বাহিনী থেকে তার সহানুভূতিশীলদের আকৃষ্ট করার আশায় তাকে দরবারী সম্মানের সাথে নিয়ে গিয়েছিল।[১৪] ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে আল-আশরাফ কানসু আল-ঘুরি ৯ জুন দামেস্কে প্রবেশ করেন,[১৫] তার হাঁটার পথে কার্পেট বিছিয়ে দেন এবং ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা জনতার মধ্যে সোনা ছড়িয়ে দেয়। কয়েকদিন অবস্থানের পর ধীর গতিতে অগ্রসর হয়ে হিমস ও হামায় তাকে উৎসবের সাথে অভ্যর্থনা জানানো হয় এবং আলেপ্পোর দিকে অগ্রসর হয়।[১৬]
অন্যদিকে উসমানীয় শিবির থেকে প্রথম সেলিম দূতাবাস পাঠিয়েছিল। তারা শান্তির ভান করে সুলতান তৃতীয় মুতাওয়াক্কিল এবং তার উজিরের জন্য প্রচুর উপহার পাঠিয়েছিল। উপহারগুলির সাথে প্রথম সেলিম মিশরীয় চিনি এবং মিষ্টান্ন দিয়েছিল।[১৭] দূত জানিয়েছিলেন যে, পারস্যের শাহ ইসমাইলের সাথে সমস্যার কারণে প্রথম উসমানকে আবার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে এবং ময়দানে নামতে বাধ্য করেছে।[১৮] চ্যান্সেলর মুঘলা বেকে পাল্টা উপহার দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি যখন উসমানীয় শিবিরে পৌঁছেছিলেন, ততক্ষণে প্রথম সেলিম তার শান্তির কৌশলটি ফেলে দিয়েছিলেন। উসমানীয়রা দূতাবাসকে অবজ্ঞা করে এবং চ্যান্সেলরকে তার মাথা ও দাড়ি কামিয়ে এবং একটি খোঁড়া পাহাড়ে চড়ে ফেরত পাঠায়।
যুদ্ধের পূর্বে আলেপ্পোর মামলুক গভর্নর খায়ের বেগ উসমানীয় সুলতান সেলিমের সাথে গোপন সহযোগিতামূলক চুক্তি সম্পন্ন করেছিলেন। যদিও দামেস্কের গভর্নর সুলতানের কাছে এটি প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু তিনি তথ্যটি অস্বীকার করেছিলেন। তার বিশ্বাসঘাতকতা ঢাকতে, খায়ের বেগ আল-ঘুরিকে একটি চমৎকার অভ্যর্থনা দিয়েছিলেন। কিন্তু জনগণরা শহরে তাদের আচরণে মামলুকদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়েছিল।[১৯]
সেলিম ও তার বাহিনী মামলুকদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার খবর দিয়ে মুঘলা বে তার দুঃখজনক প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। এই তাৎক্ষণিক হুমকির সাথে সাথে আমির, কাজী এবং রাজকীয় মামলুকরা সুলতানের প্রতি তাদের আনুগত্যের শপথ পুনর্ব্যক্ত করে। আল-ঘুরি তার ব্যক্তিগত বাহিনীকেও উপহার বিতরণ করেছিলেন, যা অন্যান্য মামলুকদের অসন্তুষ্ট করেছিল।[২০] সুলতান আল-ঘুরি আমীর জানবের্দি আল-গাজালি দ্বারা নিরস্ত হয়ে মাঠে নামার আগে খায়ের বেগের আনুগত্যহীনতা সম্পর্কে চূড়ান্ত সতর্কতা উপেক্ষা করেছিলেন।[২১]
মামলুক সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে আলেপ্পোর উত্তরে দাবিকের সমভূমিতে অগ্রসর হয় এবং ১৫১৬ সালের ২০ আগস্ট সেখানে শিবির স্থাপন করে। সেখানে আল-ঘুরি এবং তার বাহিনীরা শত্রুর আগমনের অপেক্ষায় ছিল।[২২]
১৫১৬ সালের ২৪ আগস্ট মামলুক ও উসমানীয় সৈন্যদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে মামলুকদের তুলনায় উসমানীয়দের সৈন্যসংখ্যাও বেশি ছিল। পাশাপাশি উসমানীয় বাহিনী এই যুদ্ধে নতুন কৌশল হিসেবে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলন্দাজ বাহিনী ব্যবহার করেছিল।[২৩]
খায়ের বেগের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য কানসু আল-ঘুরি মরণপণ লড়াই করেও ব্যর্থ হন। যুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে বৃদ্ধ সুলতান মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করলে তাঁর খণ্ডিত মাথা সুলতান সেলিমের দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়। এই যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ১২৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া মামলুক বংশের চির সমাপ্তি ঘটে এবং মিশর উসমানীয় সাম্রাজ্যের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়।[২৪][২৫]
ঘুরির মৃত্যুর পর তাঁর কোনো উত্তরাধিকারী না থাকায় তাঁর ক্রীতদাস ও পোষ্যপুত্র তুমান বে মামলুক সিংহাসনে আরোহণ করেন। তুমান বে ছিলেন ঘুরির মতো সাহসী ও স্বাধীনচেতা।[২৬] ফলে ১৫১৭ সালের ২২ জানুয়ারি কায়রোর মাত্তাবিয়া প্রান্তরে উসমানীয় ও মামলুকদের মধ্যে আবারও যুদ্ধ সংঘটিত হয়।[২৭] তুমান বে প্রাণপণে যুদ্ধ করেও পরাজিত হয় এবং কিছু সংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিয়া শহরে পালিয়ে যায়। পরে তিনি শক্তি সঞ্চয় করে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে কায়রো শহর দখল করে কিছুদিন স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন।[২৮] ফলে উসমানীয় ও মামলুকদের মধ্যে পিরামিডের পাদদেশে আবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তুমান বে জীবনপণ যুদ্ধ করেও পরাজিত হন এবং উসমানীয় বাহিনীর হাতে বন্দি হলে তাকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। এই ফাঁসির মধ্য দিয়ে মিশর উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।[২৯]