মাশহাদ ফার্সি: مشهد | |
---|---|
নীতিবাক্য: স্বর্গের শহর (শহর-ই-বেহেশত) | |
Location of Mashhad in Iran | |
স্থানাঙ্ক: ৩৬°১৮′ উত্তর ৫৯°৩৬′ পূর্ব / ৩৬.৩০০° উত্তর ৫৯.৬০০° পূর্ব | |
রাষ্ট্র | ইরান |
প্রদেশ | রাজাভি খোরসন |
কাউন্টি | মাশহাদ |
বাখশ | কেন্দ্রীয় জেলা (মাশহাদ কাউন্টি) |
মাশহাদ-সানাবাদ-তোস | ৮১৮ খ্রিস্টাব্দ |
সরকার | |
• মেয়র (শহরদার) | শওলত মোর্তাজাভি |
আয়তন | |
• শহর | ৮৫০ বর্গকিমি (৩৩০ বর্গমাইল) |
• মহানগর | ৩,৯৪৬ বর্গকিমি (১,৫২৪ বর্গমাইল) |
উচ্চতা | ৯৯৫ মিটার (৩,২৬৪ ফুট) |
জনসংখ্যা (২০১১) | |
• শহর | ২৭,৪৯,৩৭৪ (Metropolitan)[১] |
প্রতি বছর দুই কোটিরও বেশি মানুষ এই শহরে তীর্থ করতে আসেন।[২][৩] | |
বিশেষণ | মাশহাদি, মাশাদি, মাশদি (ইনফর্মাল) |
সময় অঞ্চল | আইআরএসটি (ইউটিসিইউটিসি+০৩:৩০) |
ওয়েবসাইট | www.mashhad.ir |
মাশহাদ (ফার্সি: مشهد /mæʃˈhæd/) হল উত্তরপূর্ব ইরানের একটি বড় শহর। বর্তমানে প্রায় ২০০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলের উপর বিস্তৃত এই শহর রাজাভি খোরসন প্রদেশের রাজধানী ও ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর।[৫] রাজধানী তেহরান থেকে ৮৫০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে কাশাফ নদীর তীরে শহরটি অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা মোটামুটি ৯৮৫ মিটার। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এই শহরের জনসংখ্যা ২৭,৪৯,৩৭৪ জন।[১] শহরটি শিয়া মুসলমানদের তীর্থস্থান হিসেবেও বিখ্যাত। শিয়াদের অষ্টম ইমাম ইমাম রেজার কবরস্থান এই শহরেই অবস্থিত। তাই প্রতি বছর অসংখ্য শিয়া পূণ্যার্থী এই শহরে তীর্থ করতে আসেন। এছাড়া বিখ্যাত খলিফা হারুনুর রশিদের কবরস্থানও এখানে অবস্থিত।[৬]
মাশহাদ বিখ্যাত পার্শি কবি ও শাহনামা কাব্যগ্রন্থের লেখক ফেরদৌসীর শহর হিসেবেও পরিচিত। রেলপথ, সড়কপথ ও বিমানপথে এ' শহর রাজধানী তেহরানের সাথে খুব ভালোভাবে যুক্ত। অর্থনৈতিকভাবেও এই শহর ইরানের অন্যতম বিকাশশীল অঞ্চল। বিশেষ করে উল ও কার্পেট শিল্পের জন্য এ' শহরের খ্যাতি যথেষ্ট। শহরটিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও বিদ্যমান।
এই শহরের ইতিহাস প্রায় ১২শ' বছরের প্রাচীন। ৮১৮ খ্রিস্টাব্দে[২] (মতান্তরে ৮২৩ খ্রিস্টাব্দে) শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। শহরের নাম মাশহাদ শব্দটি আরবী, অর্থ শহীদদের স্থান[৭] । শিয়া সম্প্রদায়ের বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের অষ্টম ইমাম ইমাম রেজার এখানে বিষপানে মৃত্যু ও তাঁর কবরস্থানের অবস্থিতির[৮] কারণেই এই শহরের এই নাম। সেই সময় এই শহর একটি ছোট্ট গ্রাম ছিল। নাম ছিল সানাবাদ। কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে বিশ্বের শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানদের কাছে এই স্থান একটি তীর্থস্থান হিসেবে গণ্য হতে শুরু করে। সানাবাদের নাম পালটে গিয়ে হয়ে ওঠে মাশহাদ আর-রিজাওই, অর্থাৎ 'রেজার শহীদত্ব বরণের স্থান'।[২] এরই সংক্ষিপ্ত রূপ মাশহাদ আজ গোটা শহরটারই নামে পরিণত হয়েছে। মৃত ইমাম রেজার কবরস্থানে ঐ ঘটনার পরই আব্বাসীয় খলিফা মামুন'এর নির্দেশে একটি পবিত্র দরগা বা স্মরণগৃহ স্থাপিত হয়[২] ও তাকে কেন্দ্র করে সাথে সাথে জনবসতিও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। নবম শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই ইমামের কবরস্থানের উপর একটি দর্শনীয় গম্বুজ গড়ে ওঠে ও তার চারিপাশে রীতিমতো বাজার ও বসতি প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। এইভাবেই মাশহাদ শহর গড়ে ওঠে। বর্তমানে এই দরগা ইরানের অন্যতম বৃহৎ শিল্প ও সাংস্কৃতিক সংগ্রহশালা হিসেবেও স্বীকৃত। শিয়াদের নানা ধর্মীয় আন্দোলনের সূতিকাগৃহ হিসেবেও এর যথেষ্ট পরিচিতি রয়েছে।
যাইহোক, ৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে গজনির সুলতান সবুক্তগিনের আক্রমণে গোটা শহরটির সাথে সাথে খলিফা মানুনের তৈরি মূল দরগাটিও সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হয়। কিন্তু তাঁর ছেলে সুলতান মামুদ ১০০৯ খ্রিস্টাব্দে সেটি আরও বড় করে পুনর্নির্মাণ করেন। ১২২০ খ্রিস্টাব্দে খোরাসান চেঙ্গিজ খানের নেতৃত্বে মোঙ্গল আক্রমণের মুখে পড়ে বাস্তবে ছাড়খার হয়ে যায়। এই অঞ্চলের বহু শহর সেই সময় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু মাশহাদ সেইসময় মোটামুটি অক্ষতই ছিল। ফলে এইসময় থেকে এই শহরের গুরুত্ব প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। আশেপাশের মোঙ্গল আক্রমণের মুখে পড়া বা ধ্বংস হওয়া বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অসংখ্য মানুষ এই শহরে এসে তখন আশ্রয় নেওয়ায় শহরের পরিধি অনেকটাই বেড়ে যায়। প্রায় ১০০ বছর পরে ইরানের তৎকালীন মোঙ্গল শাসক সুলতান মুহম্মদ খোদাবন্দ (রাজত্বকাল ১৩০৪ - ১৩১৬ খ্রিঃ) শিয়া ধর্ম গ্রহণ করলে, তাঁর সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় দরগাটিতে বড় রকমের পুনর্নির্মাণ চালানো হয়। বিখ্যাত পর্যটক ইবন বতুতাও ১৩৩৩ সালে এ'খানে এসেছিলেন। তাঁর বিবরণ থেকে আমরা সেইসময়ের মাশহাদ শহরের কথা বিশদভাবে জানতে পারি। তিনি এই শহরকে একটি সুন্দর, সাজানো ও বড় শহর বলে উল্লেখ করেছেন। প্রচূর ফলের গাছ, ঝরনা ও হর্ম্যরাজি দিয়ে সে'সময় শহরটি সজ্জিত ছিল। ইমাম রেজার কবরস্থানের উপর গড়ে ওঠা মুসোলিয়মটির জায়গায় রঙীন টালি আচ্ছাদিত দেওয়াল সংবলিত একটি বিশাল গম্বুজের বর্ণনাও আমরা তাঁর লেখায় পেয়ে থাকি।[২]
পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুতে তৈমুর লঙ'এর ছেলে মির্জা শাহরুখের রাজত্বকালে (১৪০৫ - ১৪৪৭ খ্রিঃ) সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান শহর হিসেবে মাশহাদের গুরুত্ব অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর স্ত্রী গহরশাদ বেগম এখানে ইমামের দরগার ঠিক পাশেই একটি বিশাল মসজিদ নির্মাণ করান। গহরশাদ মসজিদ নামে পরিচিত এই মসজিদটি এখনও মূলত অক্ষতই রয়েছে। এর বিশালতা সত্যিই বিস্ময়কর। এইসময় ইমামের দরগাকে কেন্দ্র করে আরও নানা ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্মারকও নির্মাণ করা হয়। দরগার সংস্কার, বৈভব বৃদ্ধি ও তাকে ঘিরে ঐ চত্বরে আরও নানা গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণের কাজ এরপর ইরানের সাফাভিদ সম্রাটদের রাজত্বকালেও (১৫০১ - ১৭৮৬ খ্রিঃ) চলতে থাকে। দরগার মূল গম্বুজটিকে এ'সময় সোনালি টালি দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়, তার চারপাশে অনেকগুলি মিনার, পোর্চ, বাঁধানো চত্বর ও মাদ্রাসা তৈরি করা হয়।[৯] এসবের সঙ্গে সঙ্গে মাশহাদ শহরের গুরুত্বও স্বাভাবিকভাবেই আরও বৃদ্ধি পায়।
পারস্য সম্রাট নাদির শাহ (রাজত্বকাল ১৭৩৬ - ১৭৪৭ খ্রিঃ) এই শহরকে তাঁর সাম্রাজ্যের রাজধানী বানালে মাশহাদের ধর্মীয় গুরুত্বর পাশাপাশি রাজনৈতিক গুরুত্বও প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী আফসার বংশ ও জান্দ বংশের শাসনকালেও মাশহাদ সমগ্র খোরাসান অঞ্চলের এক বৃহৎ অংশের রাজধানী ছিল। এরপর পারস্যের কাজার বংশের শাসনেও (১৭৭৯ - ১৯১০) মাশহাদের গুরুত্ব বজায় থাকে। এইসময় ইমামের দরগাটিরও আরও সংস্কার ও সৌন্দর্যায়ন ঘটানো হয়। কিন্তু ১৯১১-১২ সালে তৎকালীন জারের রাশিয়ার সেনাবাহিনী এই অঞ্চলে আক্রমণ চালালে ১৯১১ সালের ২৯ মার্চ রুশ আর্টিলারির গোলায় শিয়াদের এই পবিত্র দরগাটি যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানে উপস্থিত বেশ কিছু মানুষের এই গোলাবর্ষণে মৃত্যুও ঘটে।[৯]
১৯৩৫ সালে ইরানের শাহ শাহ রেজার দেশজুড়ে আধুনিকীকরণের উদ্যোগের বিরুদ্ধে মাশহাদ শহরের এই ইমামের দরগা থেকেই বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। এখানকার ধর্মীয় নেতারা শাহের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত প্রশ্নের পাশাপাশি শাহ রেজার দুর্নীতি ও সাধারণ মানুষের উপর উচ্চহারে করের বোঝা চাপানো নিয়েও প্রশ্ন তুললে আশেপাশের বহু সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীও তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসে ও ইমামের দরগাকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। দরগা থেকে স্লোগান ওঠে "শাহ হলেন একজন ইয়াজিদ (শয়তান)"। চার দিন ধরে বিদ্রোহ চলতে থাকে। এলাকার পুলিশ ও সেনাবাহিনীও দরগায় ঢুজতে অস্বীকার করে। শেষপর্যন্ত ইরানের পশ্চিমাঞ্চলের আজারবাইজান থেকে সৈন্য নিয়ে এসে চারদিন পর বিদ্রোহ দমন করা হয়। বাহিনী জোর করে দরগায় প্রবেশ করলে সংঘর্ষে বেশ কিছু মৃত্যু ঘটে ও আরও কয়েকশ' মানুষ আহত হয়।[১০] এই ঘটনার ফলে ইরানের শিয়া ধর্মীয় নেতাদের সাথে শাহের এমন এক বিরাট দূরত্বের সৃষ্টি হয়, যা আর কখনোই মেটানো সম্ভব হয়নি।
১৯৯০ সালের ২০ জুন ইমামের দরগা এক ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী হামলার শিকার হয়। ঐ দিনটি ছিল মুহররম পরবর্তী দশম দিন বা পবিত্র আশুরা। দরগার অভ্যন্তরে একটি প্রার্থনা হলে বোমা বিস্ফোরণের ফলে ঐদিন অন্তত ২৫ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে।[১১] এই বিস্ফোরণের দায় সরকারিভাবে প্রথমে পিপলস মুজাহিদিন অফ ইরান গোষ্ঠীর বলে জানানো হলেও এর পিছনে বালুচ উগ্রপন্থীদেরও হাত আছে বলে সন্দেহ করা হয়।[১২]
মাশহাদ শহরের অবস্থান ৩৬ ডিগ্রি ১৮ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ ও ৫৯ ডিগ্রি ৩৬ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমা রেখায়, কাশাফ নদীর উপত্যকায়। তুর্কমেনিস্তান সীমান্ত এই শহরের কাছেই অবস্থিত। সেদেশের রাজধানী আশখাবাদ থেকে এ' শহরের দূরত্ব মোটে ২৫০ কিলোমিটার বা ১৫৫ মাইল। এছাড়া শহরটি অদূরেই দুটি পর্বতমালা দ্বারাও বেষ্টিত। ফলে এ' শহরের জলবায়ু ইরানের অন্যত্র অনেক অঞ্চলের তুলনায়ই অপেক্ষাকৃত আরামপ্রদ। শীতকালে এখানে যথেষ্ট ঠাণ্ডা পড়ে, বসন্তকালে আবহাওয়া মৃদু থাকে, গরমকালও অপেক্ষাকৃত কম উষ্ণ।
শহরটি বর্তমানে মাশহাদ কাউন্টি (মাশহাদ শহরেস্তান) ও বাখশ কেন্দ্রীয় জেলার প্রশাসনিক সদর দফতর। শহরটি নিজেও ১৩টি ছোট ছোট প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত। শহরের মোট জনসংখ্যা ২৭ লক্ষের কিছু বেশি।[১]
শহরের অধিবাসীদের মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশই পারসিক। কিন্তু বাকিদের মধ্যে একটা বড় অংশ কুর্দ ও তুর্কমেন। এদের অনেকেই খোরাসান প্রদেশ ভাগ হওয়ার পর উত্তর খোরসন প্রদেশ থেকে এসে এখানে বসবাস শুরু করেছে। এছাড়া এই শহরে অ-পারসিক জনসংখ্যাও যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। এদের অধিকাংশই আফগান ও পাকিস্তানি। আফগান উদ্বাস্তুরা শহরের উপকন্ঠে এমনকী কতগুলি পাড়াও তৈরি করে ফেলেছে। এরকমই একটি পাড়া হল গোলশহর ।