মৃত্যু-পরবর্তী চেতনা হল সমাজ ও সংস্কৃতিরপরকাল সম্পর্কিত একটি সাধারণ ধারণা। বৈজ্ঞানিকগবেষণার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, মন ও চেতনামস্তিষ্কের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ দ্বারা একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকে। মস্তিষ্কের কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে গেলে একে ব্রেইন ডেথ বলা হয়। যাইহোক, অনেক ব্যক্তি পরকালে বিশ্বাস করে যা অনেক ধর্মেরই একটি বৈশিষ্ট্য।
নিউরোসায়েন্স বা স্নায়ুবিজ্ঞান একটি বিশাল আন্তঃবিষয়ক ক্ষেত্র যার প্রিমিস বা প্রতিজ্ঞা হল, সমস্ত আচরণ এবং জ্ঞান সম্পর্কিত ক্রিয়া নিয়ে মন গঠিত হয় এবং এগুলোর উৎস্য হচ্ছে স্নায়ুতন্ত্র, বিশেষ করে মস্তিষ্ক। এই মতামত অনুসারে মনকে মস্তিষ্ক দ্বারা পরিচালিত কার্যসমূহের একটি সমষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা যায়।.[১][২][৩][৪][৫]
বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে যেগুলো মনের উপর মস্তিষ্কের ভূমিকা নির্দেশ করে। সংক্ষেপে কিছু উদাহরণ দেয়া হল।
নিউরোএনাটমিকাল কোরিলেটস: নিউরোইমেজিং শাখায় স্নায়ুবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন ধরনের ফাংশনাল নিউরোইমেজিং পদ্ধতির প্রয়োগ করে কোন বিশেষ মানষিক অবস্থা বা মানষিক ক্রিয়ার জন্য মস্তিষ্কের কোন বিশেষ ক্রিয়া জড়িত তা নির্ণয় ও পরিমাপ করেন। এই পদ্ধতিটি এক ধরনের কোরিলেশন বা সম্পর্ক স্থাপন যা দুটো ভিন্ন বিষয়ের মাঝে (এক্ষেত্রে মানষিক অবস্থা ও মস্তিষ্কের ক্রিয়া) সম্পর্ক স্থাপন করে।
এক্সপেরিমেন্টাল মেনিপুলেশনস: নিউরোইমেজিং স্টাডির দ্বারা কোন মানষিক অবস্থা বা প্রক্রিয়ার সাথে নিউরাল এক্টিভিটি বা স্নায়বিক কার্যের (যেমন মস্তিষ্কের ক্রিয়া) মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা গেলেও উক্ত স্নায়বিক কার্যই যে সম্পর্কযুক্ত মানষিক প্রক্রিয়ার কারণ সে বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ সম্পর্ক স্থাপনই কারণ হওয়া নির্দেশ করে না। এছাড়া এর মাধ্যমে এও নির্ধারণ করা যায় না যে স্নায়বিক কার্যটি মানষিক প্রক্রিয়াটি ঘটার জন্য প্রয়োজনীয় এবং পর্যাপ্ত কিনা। কারণ এবং যথেষ্টতা নির্ধারণ করার জন্য আরও সেই কার্যের উপর সুস্পষ্ট এক্সপেরিমেন্টাল মেনিপুলেশন বা পরীক্ষা নিরীক্ষাগত হস্তচালনের প্রয়োজন পড়ে। যদি মস্তিষ্কের কার্যকলাপের উপর মেনিপুলেশন বা হস্তচালন চেতনার পরিবর্তন ঘটায়, তাহলে মস্তিষ্কের কার্যের এক্ষেত্রে আকষ্মিক ভূমিকা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত টানা যায়।[৬][৭] এক্সপেরিমেন্টাল মেনিপুলেশন এর মধ্যে সবচাইতে পরিচিত দুটো এক্সপেরিমেন্ট হল লস-অফ-ফাংশন এবং গেইন-অফ-ফাংশন এক্সপেরিমেন্ট। লস-অফ-ফাংশন এক্সপেরিমেন্টে ("নেসেসিটি" এক্সপেরিমেন্টও বলা হয়) স্নায়ুতন্ত্রের একটি অংশকে বাদ দেয়া হয়, এর কাজ বন্ধ করা হয় বা কমানো হয় এবং দেখা হয় যে এই অংশটি কোন বিশেষ কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয়। গেইন-অফ-ফাংশন এক্সপেরিমেন্টে ("সাফিশিয়েন্সি" এক্সপেরিমেন্টও বলা হয়) স্নায়ুতন্ত্রের একটি অংশের কার্যক্রমকে সাধারণ অবস্থার তুলনায় বৃদ্ধি করা হয় এবং দেখা হয় কোন বিশেষ কার্যক্রমের জন্য এই অংশটি যথেষ্ট কিনা।[৮] মস্তিষ্কের কার্যপ্রক্রিয়ায় মেনিপুলেশন বিভিন্ন উপায়ে করা যায়:
ফার্মাকোলজিকাল মেনিপুলেশন: বিভিন্ন ধরনের ঔষধ বা ড্রাগ আছে যা নিউরোট্রান্সমিশন প্রক্রিয়ার সাথে মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে নিউরাল এক্টিভিটি বা স্নায়বিক কার্যক্রমের পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। এই ড্রাগসমূহকে ব্যবহার করে উপলব্ধি, মেজাজ, চেতনা ও আচরণে পরিবর্তন ঘটানো যায়। এই সাইকোএক্টিভ ড্রাগগুলোকে তাদের ফার্মাকোলজিকাল এফেক্ট বা ক্রিয়া অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যেমন ইউফোরিয়েন্টস ব্যবহার করে ইউফোরিয়া বা সুখের অনুভূতি তৈরি করা যায়, স্টিমুলেন্টস ব্যবহার করে মানষিক বা শারীরিক ক্রিয়ার সাময়িক উন্নতি করা যায়, ডিপ্রেসেন্টস যা হতাশ করে অথবা এরাউজাল ও স্টিমুলেশন কমায় এবং হেলুসিনোজেনস যা হেলুসিনেশন বা বিভ্রম, পারসেপশন এনোমালি বা জ্ঞানীয় বিশৃঙ্খলা এবং চিন্তা, আবেগ ও চেতনার যথেষ্ট পরিবর্তন সাধন করে।
ইলেক্ট্রিকাল এবং ম্যাগনেটিক স্টিমুলেশন: বিভিন্ন ধরনের ইলেক্ট্রিকাল মেথড টেকনিক যেমন ট্রান্সক্রেনিয়াল ম্যাগনেটিক স্টিমুলেশন ব্যবহার করে মস্তিষ্কের কার্যকলাপের পরিবর্তন ঘটিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করা যায়। বিগত ১০০ বছরে স্নায়ুবিজ্ঞানী এসলিহান সেলিমবেয়োগলু এবং নিউরোলজিস্ট জোসেফ পারভিজি জাগ্রত ও চেতনায় থাকা মানুষেকের মস্তিষ্কের সেরেব্রাল কর্টেক্স বা সাবকর্টিকাল নিউক্লেই অঞ্চলে বৈদ্যুতিক স্টিমুলেশন প্রয়োগের মাধ্যমে মাধ্যমে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টাল ফেনোমেনা এবং আচরণগত পরিবর্তন এর লিস্ট তৈরি করেছেন।[৯]
অপ্টোজেনেটিক মেনিপুলেশন: এক্ষেত্রে নিউরোনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আলোকে ব্যবহার করা হয় কারণ নিউরোনরা জিনগতভাবে আলোর প্রতি সংবেদনশীল।
ব্রেইন ড্যামেজের লক্ষণ: বিভিন্ন কেস স্টাডি (দুর্ঘটনায় মস্তিষ্কে আঘাতের কেস) এবং লেসিয়ন (টিস্যুর এবনরমাল ড্যামেজ) স্টাডি পরীক্ষা করা হল একমাত্র উপায় যার মাধ্যমে বোঝা যায় মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হলে মনের কী পরিবর্তন ঘটে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম লক্ষণ সম্পর্কিত তথ্য সংরক্ষণ করা হয়েছে।[১০][১১]
মেন্টাল ডেভেলপমেন্ট বা ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট কোরিলেশন: মস্তিষ্কের বৃদ্দি এবং পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং সূচারুভাবে সম্পন্ন হয়। আর মস্তিষ্কের এই উন্নয়ন প্রক্রিয়া বিভিন্ন ধরনের মানষিক ক্ষমতার উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত।[১২][১৩][১৪] দেহের বৃদ্ধি এবং মস্তিষ্কের উন্নয়নের মধ্যে অসামঞ্জস্য দেখা দিলে বিভিন্ন ধরনের নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিজর্ডার স্নায়বিক উন্নয়নগত মানষিক সমস্যা দেখা যায়।
একসময় মৃত্যুকে শ্বাস প্রশ্বাস এবং হার্টবিট বা হৃৎস্পন্দন বন্ধ হওয়া (কারডিয়াক এরেস্ট) হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হত। কিন্তু সিপিআর (কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন) এবং ডিফাইব্রিলেশন প্রক্রিয়ার আবিষ্কার ও উন্নয়নের ফলে সেই সংজ্ঞা বর্তমানে অপর্যাপ্ত কারণ এই প্রক্রিয়াগুলোর মাধ্যমে কখনও কখনও শ্বাস প্রশ্বাস ও হৃৎস্পন্দন পুনরায় চালু করা যায়। অতীতে যে সকল ঘটনা আকষ্মিকভাবে মৃত্যু ঘটাতো এখন আর সেগুলো সকল ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ হয় না। কখনও কখনও কার্যকরী হৃৎপিণ্ড বা ফুসফুস ছাড়াও লাইফ সাপোর্ট ডিভাইস, অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট এবং কৃত্রিম পেসমেকারের সাহায্যে জীবন বাঁচানো যাচ্ছে।
এটাও বলা যায় যে, কোন ব্যক্তির পক্ষে নিজেকে কখনও মৃত বলে সংজ্ঞায়িত করতে বা উপসংহার টানা সম্ভব নয়, বিশেষ করে যেখানে ব্যক্তির ইচ্ছা, উপলব্ধিকে তার কথা এবং কাজের মত জ্ঞান ও চিন্তার জন্য আবশ্যিক ও পূর্বশর্ত হিসেবে ধরা হয়। আর তাই কারও মৃত্যু কোন দ্বিতীয় ব্যক্তির দ্বারাই নিশ্চিন্ত করতে হয়। আর এখানেই মৃত্যুর বা মৃত্যুর সময়ের একটি যথার্থ সংজ্ঞার প্রয়োজন। বর্তমানে চিকিৎসক এবং মৃত্যু পরীক্ষক বা করোনারগণ ব্যক্তির মৃত্যুকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য "ব্রেইন ডেথ" বা "বায়োলজিকাল ডেথ" শব্দকে ব্যবহার করেন। ব্রেইন ডেথকে বর্তমানে মস্তিষ্কের কার্যাবলির (এবং জীবনক্রিয়া সম্পাদনের জন্য সকল ইনভলান্টারি বা অনৈচ্ছিক ক্রিয়ার) সম্পূর্ণ সমাপ্তি এবং অপরিবর্তনীয় ক্ষতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।[১৫][১৬][১৭][১৮]
বর্তমান স্নায়ুবিজ্ঞানগত দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে ব্রেইন ডেথ এর পর চেতনা টিকে থাকতে ব্যর্থ হয় এবং অন্য সকল প্রকার মানষিক প্রক্রিয়ার সাথে এটাও চিরতরে হারিয়ে যায়।[১৯]
নিয়ার-ডেথ এক্সপেরিয়েন্স বা মৃত্যু-পূর্ব অভিজ্ঞতা হল একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যা আশু মৃত্যু এবং অনেকগুলো সম্ভাব্য অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত। স্নায়ুবিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণা এই অভিজ্ঞতাকে একটি হেলুসিনারি স্টেট বা বিভ্রম অবস্থা বলে মনে করে থাকে যা বিভিন্ন ধরনের নিউরোলজিকার ফ্যাক্টর যেমন সেরেব্রাল এনক্সিয়া, হাইপারকারবিয়া, মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোবের এবনরমাল আচরণ এবং ব্রেইন ড্যামেজ এর কারণে ঘটে।[২০]
↑Machado, C. (২০১০)। "Diagnosis of brain death"। Neurology International। 2: 2। ডিওআই:10.4081/ni.2010.e2।
↑Laureys, Steven; Tononi, Giulio. (2009). The Neurology of Consciousness: Cognitive Neuroscience and Neuropathology. Academic Press. p. 20. আইএসবিএন৯৭৮-০-১২-৩৭৪১৬৮-৪