মোল্লা দাদুল্লাহ আখুন্দ ملا دادالله آخوند | |
---|---|
জন্ম | ১৯৬৭ এর আশেপাশে[১] ওরুজগন প্রদেশ, আফগানিস্তান[১] |
মৃত্যু | ১১ মে, ২০০৭ (বয়স, ৪০) আসাদুল্লাহ খান আকা ড্রপ, গ্রামশির, হেলমান্দ, আফগানিস্তান[২] |
আনুগত্য | তালেবান |
কার্যকাল | ১৯৯৪–২০০৭ |
পদমর্যাদা | কমান্ডার |
ইউনিট | দাদুল্লাহ ফ্রন্ট |
যুদ্ধ/সংগ্রাম | সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ আফগান গৃহযুদ্ধ মার্কিন-আফগান যুদ্ধ |
সম্পর্ক | মনসুর দাদুল্লাহ (ভাই) |
দাদুল্লাহ (১৯৬৬ –১ মে, ২০০৭) ছিলেন একজন শীর্ষ আফগান সামরিক কমান্ডার ও তালেবান নেতা, যিনি ২০০৭ সালে নিজের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আফগানিস্তানে তালেবানের সবচেয়ে দক্ষ সিনিয়র সামরিক কমান্ডার ছিলেন।[৩] তিনি সাধারণত মৌলভী বা মোল্লা দাদুল্লাহ আখুন্দ ( পশতু: ملا دادالله آخوند , প্রতিবর্ণী. : মোল্লা দাদুল্লাহ আখুন্দ) নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ল্যাং ডাকনামও অর্জন করেছিলেন, যার অর্থ "খোঁড়া" ( তৈমুর ল্যাংয়ের মতো); কারণ আফগান যুদ্ধের সময় তিনি একটি পা হারিয়েছিলেন।[৪]
তিনি কান্দাহার প্রদেশের কাকার উপজাতির একজন জাতিগত পশতুন ছিলেন। তিনি "কসাই" নামে পরিচিত ছিলেন। এমনকি সহকর্মী বিদ্রোহী তালেবান সদস্যদের সাথে তার কঠোরতা প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষত তিনি কয়েদি ও তালেবানের বিদ্রোহী পুরুষ সদস্যদের মাথা কেটে ফেলার জন্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন। এমনকি কারো কারো মতে, তার চরম আচরণের কারণে মোল্লা ওমর কর্তৃক তার থেকে অন্তত দুই বার তার পদবী ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।[৫] সামগ্রিকভাবে দাদুল্লাহ তালেবান আন্দোলনের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হন।
জাতিসংঘের আল-কায়েদা সংগঠনের সাথে যুক্ত বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার তালিকা অনুযায়ী, তিনি তালেবানের নির্মাণ মন্ত্রী ছিলেন।[৬] ২০০৭ সালে তিনি ব্রিটিশ ও জার্মান বিশেষ বাহিনীর যৌথ হামলায় নিহত হন।
মোল্লা দাদুল্লাহ পশতুন জাতির কাকার উপজাতির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের একটি মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করেছেন।[৭] মোল্লা দাদুল্লাহ দেওবন্দি ধারার সুন্নি ইসলামের অনুসারী ছিলেন।[৮] ১৯৮০-এর দশকের দিকে সোভিয়েত দখলের বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদদের সাথে লড়াই করার সময় তিনি একটি পা হারান। তাই ল্যাং বা ল্যাংড়া নামেও ডাকা হত।[৯] তিনি করাচির একটি হাসপাতাল থেকে একটি কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন করেছিলেন।
২০০১ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আক্রমণের আগে তিনি তালেবানের ১০ সদস্য-বিশিষ্ট নেতৃত্ব পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি তালেবান নেতা মোহাম্মদ ওমরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন বলে জানা যায়।
আফগান গৃহযুদ্ধের সময় মোল্লা দাদুল্লাহ একজন দক্ষ, কঠোর, ধর্মপ্রাণ এবং নির্দয় কমান্ডার হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৯৯৭-১৯৯৮ সালের মধ্যে, তিনি প্রায় ৬০০০ তালেবান সেনার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যারা কুন্দুজে অবরুদ্ধ ছিলেন। একজন সামরিক কমান্ডার হিসেবে তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এবং নিজের সৈন্যদের সাথে কঠোর হওয়ার জন্য পরিচিত ছিলেন। একটি দৃষ্টান্তে দেখা যায়, তিনি তার নিজের একজন সৈন্যকে গুলি করেছিলেন যে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল।[১০] ১৯৯০-২০০০ সালে তিনি বামিয়ান প্রদেশে হাজারাদের বিদ্রোহ দমনে নেতৃত্ব দেন এবং[১১] ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে দাদুল্লাহর বাহিনী ইয়াকাওলাং এলাকায় হাজারা বিদ্রোহীদের সাথে লড়াই করে। ২০০১ সালের ১০ মার্চ তিনি বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের তত্ত্বাবধান করেন, যার আদেশ ওমর দিয়েছিলেন।[১২] ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে তালেবান শাসনের পতন হলে দাদুল্লাহ কুন্দুজ প্রদেশে উত্তর জোটের বাহিনীর কাছে ধরা পড়া থেকে পালিয়ে যান।[১৩]
২০০১ সালের নভেম্বর মাসে মাজার-ই-শরীফের যুদ্ধের পর একটি গুজব প্রচারিত হয় যে, মোল্লা দাদুল্লাহ প্রায় ৮,০০০ তালেবান যোদ্ধা নিয়ে শহরটি পুনরুদ্ধার করার প্রস্তুতি নিয়েছেন। তখন মার্কিন স্থল এক হাজার বাহিনীর সৈন্য বিমানে করে শহরে পাঠানো হয়েছিল।[১৪]
২০০৩ সালের ২৭ মার্চে তিনি রিকার্ডো মুঙ্গুয়ার হত্যায় (সেল ফোনের মাধ্যমে আদেশ দিয়ে) অংশ নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০০৫ সালে পাকিস্তানের সংসদের সদস্য ও জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম (ফ) পার্টির সদস্য মুহাম্মদ খান শেরানিকে হত্যার চেষ্টার জন্য পাকিস্তান তাকে অপর তিনজনের সাথে তাদের অনুপস্থিতিতেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল। শেরানি, যিনি তালেবানের প্রতিপক্ষ ছিলেন, ২০০৪ সালের নভেম্বরে তার নিজ নির্বাচনী এলাকা বেলুচিস্তানে তাৎক্ষণিক উদ্ভাবিত বোমা হামলা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন এবং এই হামলার জন্য মোল্লা দাদুল্লাহসহ তার তিন সহকারি তালেবান সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয়।[১৫]
একটি "পশ্চিমী গোয়েন্দা সূত্র" দাবি করে যে, দাদুল্লাহ হয়তো পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে কাজ করেছে।[১৬] পাকিস্তান সরকারসহ অন্যরা দাবি করে যে, দাদুল্লাহ আফগানিস্তানের কান্দাহারের কাছে কাজ করেছিল। ২০০৬ সালে তিনি কান্দাহার, হেলমান্দ, জাবুল এবং ওরুজগানের দক্ষিণ প্রদেশের প্রাক্তন তালেবানদের কেন্দ্রস্থলে ১২,০০০ জন পুরুষ ও ২০টি জেলা নিয়ন্ত্রণ করার দাবি করেছিলেন, যাদের সবকিছুতে দাদুল্লাহর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত ছিল বলে দাবি করেন।[১৭]
দাদুল্লাহ তালেবানে পাকিস্তানি নাগরিকদের নিয়োগের একটি কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন বলে জানা যায়।[১১] তিনি তালেবান আন্দোলনে অসংখ্য পাকিস্তানি ব্যক্তি যোগদানের মাধ্যম ছিলেন বলে মনে করা হয়। তিনি তালেবানের অন্যতম মুখপাত্রও ছিলেন; প্রায়ই আল-জাজিরা টেলিভিশনের সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাত করতেন এবং আন্দোলন সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় তাদের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন। ২০০৬ সালের গ্রীষ্মে স্থানীয় পশতুন বিদ্রোহী যোদ্ধাদের পাকিস্তান সরকারের সাথে একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার জন্য মোল্লা ওমর তাকে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে পাঠান।[১৮] ২০০৬ সালের অক্টোবরে গুজব রটেছিল[১৯] যে, আফগানিস্তানের সরকার চলমান বিদ্রোহ বন্ধ করার জন্য তালেবানের সাথে একটি পুনর্মিলন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দাদুল্লাহকে দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে।
দাদুল্লাহ বিদ্রোহী হাজারা জাতির শিয়াদের গণহত্যার সাথে যুক্ত ছিল, যা ২০০১ সালে শিয়া গ্রামের পোড়া মাটির নীতি নামে সংঘটিত হয়েছিল, যা তিনি একবার রেডিওতে গর্ব করে বলেছিলেন। ২০০১ সালে নিজের কম্পাউন্ডে হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করার সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ডের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তিনি দেন। তিনি তাদের একটি মূল গোলচত্বরে ঝুলিয়েছিল। এছাড়াও বিবিসিকে দেওয়া তার একটি সাক্ষাত্কার অনুসারে, ন্যাটো সৈন্যদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর জন্য তার আদেশের জন্য শত শত আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী অপেক্ষা করছিল। সরকারী লক্ষ্যবস্তুতে তালেবানের আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের তিনি প্রশিক্ষণ দেন বলে জানা যায়।[৩]
দাদুল্লাহ ২০০৭ সালের মার্চ মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ড্যানিয়েল মাস্ত্রোগিয়াকোমো এবং তার দুই আফগান সহকারীকে জিম্মি করার কাজে তালেবানদের পক্ষে আলোচনার তদারকি করেছিলেন। মাস্ত্রোগিয়াকমের ড্রাইভারকে পরে শিরশ্ছেদ করা হয়েছিল এবং ওস্তাদ ইয়াসির, আব্দুল লতিফ হাকিমি, মনসুর আহমদ, যিনি দাদুল্লাহর ভাই ছিলেন এবং মো. হামদুল্লাহ ও আব্দুল গফফার নামে দুই কমান্ডারসহ পাঁচ সিনিয়র তালেবান নেতার সাথে মাস্ত্রোগিয়াকোমোর বিনিময় হয়েছিল বলে জানা গেছে। তখন কাবুল সরকার দুই তালেবান বন্দিকে মুক্তি না দিলে তালেবানরা দো-ভাষী আজমল নকশবন্দীকে (যিনি দুই আফগান সহকারীর একজন ছিলেন) ২০০৭ সালের ২৯শে মার্চ হত্যার হুমকি দেয়।[২০] আফগান সরকার আর কোনো তালেবান বন্দিকে মুক্তি দিতে অস্বীকার করার পর আজমলের শিরশ্ছেদ করা হয়েছিল। কান্দাহার প্রদেশের গভর্নর আসাদুল্লাহ খালিদের মতে, "মোল্লা দাদুল্লাহ ছিলেন তালেবানের মেরুদণ্ড। তিনি একজন ধার্মিক এবং যুদ্ধক্ষেত্রে একজন নৃশংস ও নিষ্ঠুর কমান্ডার ছিলেন, যিনি বিদ্রোহী আফগান নাগরিকদের হত্যা ও শিরচ্ছেদ করতেন।"[২১]
আফগান কর্মকর্তারা ২০০৭ সালের ১৩ই মে, রিপোর্ট করেছিলেন যে, দাদুল্লাহ আগের দিন সন্ধ্যায় হেলমান্দ প্রদেশে আফগান ও ন্যাটো বাহিনীর যৌথ অভিযানে নিহত হন, যে অভিযানটি সি স্কোয়াড্রন, স্পেশাল বোট সার্ভিস (এসবিএস) ও একটি ব্রিটিশ স্পেশাল ফোর্সের ইউনিটকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। দক্ষিণ আফগানিস্তানে সহকর্মী কমান্ডারদের সাথে বৈঠক করার তিনি নিজের "অভয়ারণ্য" ত্যাগ করেন এবং তখন এই যৌথ হামলা চালানো হয়।[২২] কিছু রিপোর্ট ইঙ্গিত করে যে, দাদুল্লাহকে গেরস্ক জেলায় হত্যা করা হয়েছে; অন্যরা দাবি করেছে যে, তাকে সঙ্গিন ও নারি সরজ জেলার কাছে হত্যা করা হয়।[২৩] কান্দাহার প্রদেশের গভর্নর আসাদুল্লাহ খালিদ দাদুল্লাহর মরদেহ নিজের সরকারি বাসভবনে প্রদর্শনের জন্য রাখেন। তার শরীরে তিনটি বুলেটের ক্ষত ছিলো, যার দুটি ধড়ে এবং একটি মাথার পেছনে। তালেবানের নেতৃত্ব তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দাদুল্লাহর ছোট ভাই মনসুর দাদুল্লাহকে (মোল্লা বখত) অধিষ্ঠিত করে।[২৪]
২০০৭ সালের ৭ জুন তালেবানের একজন নেতা বলেন, দাদুল্লাহর মৃতদেহ তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে; এর বিনিময়ে আফগান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জিম্মি করে রাখা চারজন কর্মীকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। কান্দাহারে তার পরিবার তাকে কবর দিয়েছে। তালেবান বলেছে যে, দাদুল্লাহর মরদেহ দ্রুত ফেরত না পাওয়ায় পঞ্চম জিম্মির শিরশ্ছেদ করা হয়।[২৫][২৬]