রবার্ট হ্যারি লোভি (জার্মান: Robert Lowie) (১২ই জুন, ১৮৮৩ - ২১শে সেপ্টেম্বর, ১৯৫৭) অস্ট্রিয়ায় জন্মগ্রহণকারী মার্কিন নৃবিজ্ঞানী। পেশাগত জীবনে সম্পূর্ণ সফল এই বিজ্ঞানী যে গবেষণা করেছেন তা বর্তমানে নৃবিজ্ঞান চর্চায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এই সময়ে নৃবিজ্ঞান তার গড়ন ও কার্যাবলি দিয়ে সমাজে যে অবদান রাখছে লোভি ও তার সমসাময়িক অন্যান্য বিজ্ঞানীরা না থাকলে তা সম্ভব হতো না। লোভির মাঠ পর্যায়ের গবেষণার মূল ক্ষেত্র ছিল অ্যারিজোনার হোপি এবং মন্টানার ক্রো জনগোষ্ঠী।
রবার্ট এইচ লোভি অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বংশধারা ছিল হাঙ্গেরীয়। জীবনের প্রথম ১০ বছর অস্ট্রিয়াতে কাটানোর পর ১৮৯৩ সালে তাদের পরিবার অভিবাসী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক সিটিতে চলে আসে। এই শহরের একটি প্রথাগত জার্মান পকেট এলাকায়ই তারা বস্তি স্থাপন করেছিলেন। এই এলাকায় লোভির বাল্যকালের অভিজ্ঞতার মত অনেক কিছুই জীবন্ত ছিল। এ বিষয়ে তিনি একবার বলেছিলেন, "American Melting Pot was not doing much melting in his neighborhood" (মার্ফি, পৃ-৮)। এ কারণে লোভি যে পরিবেশে বড় হয়েছেন সেখানে সাধারণ জার্মান জীবনধারাই অনুসৃত হতো। সেখানে জার্মান ইহুদি চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটলেও অনেকেই মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন।
পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা শেষ করার পর লোভি সিটি কলেজ অফ নিউ ইয়র্কে ভর্তি হন। এই কলেজে বেশ ভাল ফলাফল করেন এবং ১৯০১ সালে এখান থেকেই ব্যাচেলর্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষক ছিলেন ফ্রান্ৎস বোয়াস আর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন তার ভবিষ্যৎ সহকর্মী আলফ্রেড ক্রোয়েবার ও আলবার্ট লুইস। এখানে পড়ার সময়ই লোভি নৃবিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠেন ও এই বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। তিনি বলেছিলেন, "কোন নৃবিজ্ঞানী এমনকি স্বয়ং বোয়াসও নৃবিজ্ঞানী হওয়ার পেছনে আমার নায়ক বা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেনি" (মার্ফি, পৃ-১২)।
তারপরও বলা যায় শিক্ষাজীবনে ক্লার্ক উইসলারের দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন। উইসলার কলাম্বিয়ার অধ্যাপক ও অ্যামেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টরির চেয়ারম্যান ছিলেন। লোভিকে প্রথম মাঠ পর্যায়ে গবেষণার জন্য Shoeshoni গোষ্ঠীর কাছে পাঠিয়েছিলেন এই উইসলার। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সমভূমিতে ইন্ডিয়ানদের নিয়ে অধ্যয়ন করার জন্যও উইসলারই পাঠিয়েছিলেন। উল্লেখ্য ইন্ডিয়ানদের নিয়ে অধ্যয়ন করেই লোভি তার মাঠ পর্যায়ে গবেষণার ক্যারিয়ার গড়ে তুলেন। তার এই ক্যারিয়ার ছিল উচ্চমাত্রায় বর্ণনামূলক গবেষণামুখী; ব্যাখ্যামুখীনতা ও অধিবিদ্যাকে সবসময়ই এড়িয়ে গেছেন। লোভির সেরা গবেষণাকর্ম অর্থাৎ ক্রো ইন্ডিয়ানদের নিয়ে মাঠ পর্যায়ের অধ্যয়নও কিন্তু এই উইসলারের অধীনে সম্পন্ন হয়েছিল। ১৯১০ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত প্রতিটি মৌসুমে লোভি এই ক্রো জনগোষ্ঠীকে খুব কাছ থেকে অধ্যয়ন করেছিলেন।
১৯০৮ সালে লোভি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং তখন থেকেই উইসলারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের শুরু হয়। ১৯২১ সালে তাকে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলির অনুষদ সদস্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এর ফলে তার মাঠ পর্যায়ের গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়। ক্রোয়েবারের সাথে মিলে দীর্ঘ ২০ বছরে ইউসি, বার্কলির নৃবিজ্ঞান বিভাগকে তিলে তিলে গড়ে তোলেন। অনেককে বলতে শোনা যায়, লোভি ছিলেন তুখোড় বক্তা, কিন্তু তার ক্লাসগুলোতে এতো বেশি তথ্য ও বিশ্লেষণ থাকতো যে অনেকের পক্ষে লাগাম ধরে রাখা সম্ভব হতো না।
১৯৩৩ সালে লোভি লুয়েলা কোল-কে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তার কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে এবং আগের চেয়ে অনেক বেশি পেশাদার হয়ে উঠেন। ১৯৫০ সালে অবসর গ্রহণ করার পর লোভি সস্ত্রীক জার্মানিতে যান। সেখানে যুদ্ধ পরবর্তী মানুষের অবস্থা অধ্যয়ন করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে নতুন ধরনের একটি নৃবিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তিনি ও তার স্ত্রী একসাথে জার্মানির মানুষদের অধ্যয়ন করেন। অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন তারা যে জার্মানিকে চিনতেন আজকের এই জার্মানির সাথে তার অনেক পার্থক্য। অবসরের পরও লোভি অনেক সম্মাননা লাভ করেন। ১৯৫৭ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর বার্কলিতে তার শেষ সেমিনার শেষ করার পরপরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন লোভি। মৃত্যুর ঠিক আগে স্ত্রীকে ফাউস্ট থেকে একটি পঙ্ক্তি পড়ে শোনাচ্ছিলেন তিনি।
উইসলারের কাছ থেকে পাওয়া গবেষণাগুলো থেকেই লোভি "স্যালভিজ নরবিজ্ঞান" (salvage ethnography) নামে নতুন ধরনের এক নরবিজ্ঞানের প্রচলন করেন। একটি সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ঠিক আগে যে নিদর্শনগুলো রেখে যায় তার মধ্যে বেশ কিছু পরবর্তীতে অন্য কেউ উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। এই উদ্ধারকৃত নিদর্শনগুলো থেকে সেই সংস্কৃতি সম্বন্ধে ধারণা লাভের যে বিজ্ঞান তাকেই স্যালভিজ নরবিজ্ঞান বলা হয়। এই বিষয় নিয় তখন মূলত ব্যবহারিক অধ্যয়ন করতে হতো। কারণ আমেরিকার ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীগুলো বেশ দ্রুত তাদের পুরনো সংস্কৃতি ঝেড়ে ফেলছিল। লোভি তার নরবিজ্ঞান গবেষণার জন্য একেবারে সরাসরি সাক্ষাৎকারের উপর নির্ভর করতেন। যত বেশি সম্ভব বিবরণী সংগ্রহ করতেন। এটাই ছিল তার গবেষণার পদ্ধতি।
লোভির আগ্রহের মূল বিষয় ছিল সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান। অবশ্য তার নিজস্ব নরবিজ্ঞানের মধ্যে থেকে মাঝেমাঝে প্রত্নতত্ত্ব নিয়েও কাজ করতেন। সবে সবসময়ই তার চিন্তার মূল বিষয় ছিল নিজস্ব ধারার নরবিজ্ঞান। এরপরই সবচেয়ে বেশি গবেষণা করেছেন যে বিষয় নিয়ে তা হল, আদিম ধর্ম এবং আদিম সমাজ। এই গবেষণাই তাকে সাংস্কৃতিক বিবর্তনবাদ বিরোধী বিজ্ঞানী সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। এছাড়া তিনি সাংস্কৃতিক ব্যাপনবাদেরও বিপক্ষে ছিলেন। এই মতবাদে বলা হয় এক সমাজ অন্য সমাজ থেকে অনেক কিছু ধার করে এবং সেই সমাজকে অনেক কিছু দেয়। তাই সমাজ নিয়ে গবেষণাও এভাবেই করা উচিত। কিন্তু লোভি এক্ষেত্রে এক ধরনের নির্দিষ্টকরণের ধারণা নিয়ে আসেন যা তার সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে।
ধর্মের নৃবিজ্ঞান নিয়ে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন লোভি। ধর্মীয় প্রথা অনুশীলনের ব্যাপ্তী দেখে লোভি সহ সমসাময়িক অনেক নৃবিজ্ঞানীই বুঝতে পেরেছিলেন এই বিষয়ে পরিপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কোন গোষ্ঠীকে বুঝতে হলে নৃবিজ্ঞানীকে অবশ্যই তাদের বিশ্বাস প্রথা বুঝতে হবে। সমাজে কোন ব্যক্তির আচরণ ও অবদান কীভাবে বিশ্বাস ও ধর্মের প্রতি তার একাগ্রতা দ্বারা প্রভাবিত হয় তাও বুঝতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেছিলেন। এছাড়া ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়েও তিনি আলোচনা করেছেন। তার মতে, বিজ্ঞান কখনও মানুষকে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা ও প্রশান্তি দিতে পারে না। এই ক্ষেত্রে ধর্ম বিজ্ঞানকে ছাড়িয়ে যায়। তিনি বিজ্ঞান ও ধর্মের পৃথক পৃথক অবস্থানের ধারণায় বিশ্বাস করতেন।[১] উল্লেখ্য স্টিফেন জে গুল্ডের "স্বতন্ত্র বলয়" ধারণাটিও অনেকটা এমন।
ধর্ম সম্পর্কে লোভি ও সমসাময়িক কয়েকজন নৃবিজ্ঞানীর আরেকটি ধারণা বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। তারা ধারণা করেছিলেন, ধর্ম এবং পুরাণ মানুষের স্বপ্নে উৎপন্ন হতে পারে। সে হিসেবে এই উৎপত্তির সাথে জৈব প্রক্রিয়ার সম্পর্ক আছে যা জীববিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।[২]