রাণী পোখারীকে (নেপালি: रानी पोखरी) বলা হয় রাণীর পুকুর, যা নেপালী ভাষায় নূ পুখূ (Nepal Bhasa| न्हू पुखू) নামে পরিচিত ৷ এর অর্থ নতুন পুকুর, যা কাঠমন্ডুর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এক কৃত্রিম পুকুর ৷[১] বর্গাকৃতির এই পুকুরটি সপ্তদশ শতাব্দিতে শহরে সীমানায় পূর্বপাশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ৷ এটি প্রাক্তন ফটকের সামান্য বাইরে অবস্থিত ৷ এই পুকুরটি কাঠমন্ডুর অন্যতম একটি বিখ্যাত স্মৃতিচিহ্ন এবং ধর্মীয় ও নান্দনিকতার তাৎপর্য বহন করে ৷ এটির আকৃতি দৈঘ্য ও প্রস্থে ১৪০ ও ১৮০ মিটার ৷[২]
রাজা প্রতাপ মাল্লা ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে রাণী পোখারী নির্মাণ করেন ৷ তিনি মাল্লা শাসকবর্গের মধ্যে অন্যতম প্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন ৷ জানা যায় রাজার পুত্র হাতির পায়ে পদদলিত হয়ে মারা গেলে রাণী পুত্রশোকে পাগলপ্রায় হয়ে যান ৷ রাজা প্রতাপ রাণীর দুঃখের সান্তনায় এই পুকুরটি নির্মাণ করেন ৷ তিনি নেপাল ও ভারতে বিভিন্ন তীর্থস্থান ও নদী থেকে জল সংগ্রহ করেন ৷ এইসকল স্থানের মধ্যে গোষাইকুন্ডু, মুক্তিনাথ, বদ্রীনাথ ও কেদারনাথ অন্যতম ৷[৩][৪]
পুকুরের কেন্দ্রে একটি মন্দির অবস্থিত ৷ মন্দিরটি মাতৃকেশর মহাদেবের (হিন্দু দেবতা শিবএর আরেক রূপ) নামে ঊৎসর্গ করা হয় ৷ পুকুরটির দক্ষিণ প্রান্তে এক বিশাল হাতির ভাষ্কর্য অবস্থিত ৷ ভাষ্কর্যটিতে হাতির পিঠে রাজা প্রতাপ ও তার দুই পুত্র চক্রভর্তেন্দ্র মাল্লা ও মহিপতেন্দ্র মাল্লা বিরাজমান ৷ পুকুরের নিচে নালীর মাধ্যমে পুকুরটিতে সার্বক্ষণিক জলের ব্যবস্থা রাখা হয় ৷
পুকুরের চারটি কোণে চারটি মন্দির অবস্থিত ৷ উত্তরপূর্ব ও উত্তরপশ্চিম পাশে ভৈরবের মন্দির, দক্ষিণপূর্ব পাশে মহালক্ষ্মীর মন্দির ও দক্ষিণপশ্চিম পাশে গণেশের মন্দির অবস্থিত ৷ মন্দিরটির পূর্বপাশে কিছু অংশে ত্রি চন্দ্র কলেজ ও পুলিশ স্টেশন গড়ে উঠেছে যা স্থানটির সৌন্দর্যকে বাধাগ্রস্থ করছে ৷ [৫][৬]
রাণী পোখারির চারদিকে লোহার বার দিয়ে তৈরী বেড়ায় ঘেরা থাকে এবং তিহার উৎসবের পঞ্চম ও শেষ দিন ভাই ফোটার সময় খোলা হয় ৷
প্রত্যেক বছর বিশ্বের সবচেয়ে বড় চাহাত উৎসবও রাণী পোখারিতে অনুষ্ঠিত হয় ৷ মহিলারা রাণীকে উৎসর্গ করে ঠান্ডা জলে প্রবেশ করে ও সূর্যের নিকট প্রার্থনা করেন ৷[৭]
মাল্লা রাজত্বের সময়কালে ১৭২১ খ্রিষ্টাব্দে ইটালিয়ান খ্রিষ্টান ধর্মযাজক ইপোলিটো দিসাইদারি কাঠমন্ডু ভ্রমণ করেন ৷ তিনি রাণী পোখারী সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন ৷ তিব্বত থেকে ভারতে ভ্রমণের সময় তিনি শহরের মূল ফটকের পাশে পানিপূর্ণ এক বিরাট পুকুর দেখতে পান যা তিনি তার ভ্রমণবইতে লিপিবদ্ধ করেছেন ৷[৮]
ব্রিটিশ উইলিয়াম ক্রিকপ্যাট্রিক ১৭৯৩ সালে কাঠমন্ডু ভ্রমণ করেন ৷ তিনি তার গ্রন্থে লিখেছেন যে শহরের উত্তরপূর্ব পাশে এক চতূর্ভুজাকৃতির জলাধার রয়েছে ৷ তিনি রাণী পোখারীর চারপাশের মন্দিরগুলোর আকার ও সুস্পষ্ট বিবরণ দেন ৷[৯]
রাণী পোখারীর ভবনগুলো ঐতিহাসিক তাৎপর্য্য বহন করে ৷ ভবনগুলোর গঠনশৈলী সুন্দর ৷ পুকুরের পূর্বপাশে ঘণ্টাঘর অবস্থিত ৷ আসল ঘণ্টাঘরটির বৃহৎ কাঠামো ছিলো যেটা ১৮৩৪ সালের ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায় ৷ বর্তমান ঘণ্টাঘরটি ওই ভূমিকম্পের পর নির্মাণ করা হয়েছে ৷ এটি ১৮১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম কলেজ ত্রি চন্দ্র কলেজ এর প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠিত ৷
রাণী পোখারীর পশ্চিম পাশে অপর একটি ঐতিহাসিক ভবন রয়েছে ৷ ভবনটি দরবার উচ্চবিদ্যালয় যা ১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ৷ এই বিদ্যালয়টি প্রথম নেপালে আধুনিক শিক্ষার প্রচলন করে ৷ শুরুতে স্কুলটি শাসক পর্যায়ের ব্যক্তিদের সন্তানকে শিক্ষাদান করত ৷১৯০২ সালে বিদ্যালয়টি সকলের জন্য শিক্ষাদান শুরু করল ৷