রাণী রাসমণি | |
---|---|
জন্ম | ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৭৯৩ , বাংলা ১১ই আশ্বিন ১২০০ সন কোনা গ্রাম, হালিশহর-কাঁচড়াপাড়া সংলগ্ন (বর্তমানে চরনন্দনবাটি, কল্যাণী, নদীয়া তাঁর জন্মস্থানের কাছে একটি ঘাট ও মন্দির আছে) |
মৃত্যু | ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬১, বাংলা ৬ই ফাল্গুন ১২৬৭ সন কালীঘাটের বাড়ি (কোলকাতা) |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
পরিচিতির কারণ | দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি নির্মাণ, সমাজসেবা, সামাজিক আন্দোলন |
রাণী রাসমণি (২৮ সেপ্টেম্বর, ১৭৯৩ – ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬১)[১] ছিলেন কলকাতার জানবাজারের বাসিন্দা প্রসিদ্ধ মানবদরদি জমিদার। তিনি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির প্রতিষ্ঠাত্রী এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান পৃষ্ঠপোষক।[২]
রাণী রাসমণি তার বিবিধ জনহিতৈষী কাজের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে সুবর্ণরেখা নদী থেকে পুরী পর্যন্ত একটি সড়ক পথ নির্মাণ করেন। কলকাতার অধিবাসীদের গঙ্গাস্নানের সুবিধার জন্য তিনি কলকাতার বিখ্যাত বাবুঘাট, আহিরীটোলা ঘাট ও নিমতলা ঘাট নির্মাণ করেন। ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি (অধুনা ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার) ও হিন্দু কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠাকালে তিনি প্রভূত অর্থসাহায্য করেছিলেন।[৩]
১৭৯৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তৎকালীন কাঞ্চনপল্লীর 'কোনা' গ্রামে ( অধুনা নদীয়া ও উত্তর ২৪ পরগনা সীমান্তবর্তী অঞ্চল) রাণী রাসমণির জন্ম হয়।[৪][৫][৬] পিতা হরেকৃষ্ণ দাস ও মাতা রাম প্রিয়া, মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি তার মাকে হারান। তিনি ছিলেন অসামান্যা সুন্দরী। মাত্র এগারো বছর বয়সে কলকাতার জানবাজারের ধনী মাহিষ্য জমিদার বাবু রাজচন্দ্র দাস-এর সঙ্গে তার বিবাহ হয়। তাদের চার কন্যা- পদ্মমণি,কুমারী,করুণাময়ী,জগদম্বা। পদ্মমণির স্বামী রামচন্দ্র দাস, কুমারীর স্বামী প্যারিমোহন চৌধুরী,করুণার বিয়ে হয় মথুরবাবুর সাথে, বিয়ের কয়েক বছর পর করুণার মৃত্যু হয় মথুরমোহন বিশ্বাস তখন জগদম্বা কে বিয়ে করেন। ১৮৩৬ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি স্বহস্তে তার জমিদারির ভার তুলে নেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তা পরিচালনা করতে থাকেন। ব্যক্তিগত জীবনে রাণী রাসমণি এক সাধারণ ধার্মিক বাঙালি হিন্দু বিধবার মতোই সরল জীবনযাপন করতেন।[৭]
একবার ইংরেজ সরকার গঙ্গায় জেলেদের মাছ ধরার উপর জলকর আরোপ করে। নিরুপায় হয়ে জেলেরা রাণী রাসমণির কাছে গেলে রাণী রাসমণি ইংরেজ সরকারকে ১০ হাজার টাকা কর দিয়ে ঘুসুড়ি থেকে মোটিয়াবুরুজ এলাকার সমস্ত গঙ্গা জমা নেন এবং লোহার শিকল টানিয়ে জাহাজ ও নৌকো চলাচল বন্ধ করে দেন। এতে ইংরেজ সরকার আপত্তি করলে রাসমণি বলেন যে, জাহাজ চলাচল করলে মাছ অন্য জায়গায় চলে যাবে ফলে জেলেদের ক্ষতি হবে। এই অবস্থায় ইংরেজ সরকার রাণী রাসমণির ১০ হাজার টাকা ফেরত দেয় এবং জলকর তুলে নেয়।
একবার এক নীলকর সাহেব মকিমপুর পরগণায় প্রজাদের ওপর উৎপীড়ন শুরু করলে রাণী রাসমণি তা বন্ধ করেন। তিনি ১ লক্ষ টাকা খরচ করে স্টোনার খাল খনন করেন। এতে মধুমতী নদীর সঙ্গে নবগঙ্গার সংযোগ ঘটে। সোনাই, বেলিয়াঘাটা ও ভবানীপুরে তিনি বাজার স্থাপন করেন।
ধর্মচর্চার জন্য দক্ষিণেশ্বরে কালী মন্দির তিনিই নির্মাণ করেন। এর পিছনে কিংবদন্তি আছে যে, ১৮৪৭ সালে রাণী রাসমণি ঠিক করলেন কাশীতে গিয়ে মা অন্নপূর্ণা ও বিশ্বনাথের পূজা দেবে। তাই ২৪টি নৌকো দাস-দাসী রসদ আত্মীয়-স্বজন সবকিছুই তৈরি ছিল। কিন্তু, যাত্রার ঠিক আগের দিন রাতে শেষ প্রহরে জগজ্জননী মা ভবতারিণী রাণী রাসমণিকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন:
" রাণী কাশী যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, তুই এই গঙ্গা নদীর তীরে আমার মন্দির তৈরি করে পূজা কর আমি এখানে পূজা গ্ৰহণ করব।"[৮]
এই কারণে রাণী রাসমণি প্রতিষ্ঠা করলেন দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দির ১৮৫৫ সালে ৩১ মে বৃহস্পতিবারে স্নান যাত্রার পুণ্য তিথিতে। এবং রাণী রাসমণি এক লক্ষেরও বেশি টাকা খরচ করে রুপোর রথ বানিয়ে। তাঁর গৃহদেবতা রঘুবীরকে নিয়ে কলকাতার রাস্তায় শোভাযাত্রা বের করেছিলেন।
রাণী রাসমণি প্রচলিত সেই রথযাত্রা আজও রথের দিনে দক্ষিণেশ্বরে মহাসমারোহে পালন করা হয়। রথে আরোহণ করার জগন্নাথ পুরো দক্ষিণেশ্বর প্রদক্ষিণ করেন।
রানি রাসমণির জানবাজারের বাড়ির দুর্গাপুজো কলকাতার বিখ্যাত পুজো। মহালয়ার পর প্রতিপদ থেকেই পূজার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় এখানে। ষষ্ঠীর দিন দেবীর গায়ে গয়না-অলঙ্কার পরিয়ে দেবীর বরণ হয়। আর ঠিক এইদিনেই কলাবৌ স্নানকে ঘিরে ব্রিটিশ সাহেবের সঙ্গে কলহ বেধেছিল। রানি রাসমণির প্রধান পুরোহিত সেই ষষ্ঠীর ভোরে এসে রানিকে জানান যে কলাবৌ স্নানের সময় ঢাক-ঢোলের শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মামলা ঠুকেছেন এক ব্রিটিশ সাহেব। পরেরদিন আরো লোকলস্কর আর বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে রানি গঙ্গাস্নানে পাঠান মহিলাদের। তাতে আরো ক্ষুব্ধ হন সাহেব। এমনকি পঞ্চাশ টাকা জরিমানাও হয় রানির। এর প্রতিশোধ নিতে বাবুরোডের দুপাশে বাঁশের খুঁটি পুঁতে গাড়ি-ঘোড়া যাওয়ার পথ আটকে দেন রানি রাসমণি। অবশেষে রানির সঙ্গে মীমাংসা করে নেন সেই সাহেব।[৯]
১৮৬১ সালের ১৯-শে ফেব্রুয়ারি, কালীঘাটের বাড়িতে রাণী রাসমণি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পরে তার মৃতদেহ কেওড়াতলা মহাশ্মশানে, চন্দনকাঠে দাহ করা হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৬৮ বছর। রাণীমা সাধারণ মানুষের প্রতি দয়া-মায়া থাকার জন্য তিনি 'লোকমাতা' সম্মান লাভ করেন। রাণী রাসমণির মৃত্যুর পর তাঁর জন্ম শতবার্ষিকীতে ভারত সরকার তার স্মৃতি রক্ষার্থে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেন।[১০]
রানি রাসমণির জন্মের ২০০ বছর পূর্তিতে রাসমণির একটি মর্মর মূর্তি স্থাপিত হয় কলকাতার কার্জন পার্কে। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের ভিতরেও তাঁর একটি মূর্তি ও স্মৃতিসৌধ রয়েছে।
রানী রাসমণি বাংলা ভাষায় একটি জীবনীমূলক চলচ্চিত্রের বিষয়ও হয়েছেন, যার নাম রানি রাসমণি (১৯৫৫), কালীপ্রসাদ ঘোষ পরিচালিত, এবং এতে রানী রাসমনির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত থিয়েটার ব্যক্তিত্ব এবং অভিনেত্রী মলিনা দেবী।[১১]
জি বাংলা করুণাময়ী রাণী রাসমণি নামে রানীর জীবন চিত্রিত একটি দৈনিক ধারাবাহিক প্রদর্শন করেছিল, যা ২৪ জুলাই ২০১৭-এ প্রিমিয়ার হয়েছিল এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত প্রতিদিন প্রচারিত হয়েছিল।[১২]