রাসায়নিক পদার্থবিজ্ঞান রসায়নশাস্ত্র ও পদার্থবিজ্ঞানের একটি আন্তঃশাস্ত্রীয় ক্ষেত্র যেখানে রসায়ন (বিশেষত ভৌত রসায়ন) এবং পদার্থবিজ্ঞানের (বিশেষত আণবিক ও পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান ও ঘনপদার্থবিজ্ঞানের) মূলনীতি, কৌশল ও পদ্ধতিগুলিকে প্রয়োগ করে আণবিক, পারমাণবিক এমনকি অতিপারমাণবিক স্তরের রাসায়নিক বিক্রিয়া ও ব্যবস্থাগুলির গাঠনিক কাঠামো, ধর্ম ও আচরণ অধ্যয়ন ও ব্যাখ্যা করা হয় ও সেগুলিকে কীভাবে বৃহৎ মাপনীতে (ম্যাক্রোস্কেল) কাজে লাগানো যায়, তা গবেষণা করা হয়।[১] রাসায়নিক পদার্থবিজ্ঞানে অধীত বিষয়গুলির মধ্যে আছে অসমসত্ব কাঠামো, সমরেখকরণ ও পৃষ্ঠতলীয় ঘটনাবলী, কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান, গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান, পরিসংখ্যানিক বলবিজ্ঞান, চিরায়ত বলবিজ্ঞান, রাসায়নিক চলবিজ্ঞান, লেজার পদার্থবিজ্ঞান, বর্ণালীবীক্ষণ, আণবিক গতিবৈজ্ঞানিক ছদ্মায়ন, ইত্যাদি।[২] রাসায়নিক পদার্থবিজ্ঞানের সুবাদে রাসায়নিক প্রক্রিয়াসমূহের মৌলিক আচরণ অনুধাবন করা যায়, উপাদান বিজ্ঞানের উন্নতিসাধন হয় এবং নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন সম্ভব হয়। বর্তমানে শাস্ত্রটিতে জটিল বিক্রিয়াসমূহের কার্যপদ্ধতি উদ্ঘাটন, দক্ষ অনুঘটক নকশাকরণ ও চরম অবস্থায় উপাদানসমূহের আচরণ, ইত্যাদি ব্যাপারগুলি অধ্যয়ন করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিককালে শাস্ত্রটিতে যেসব অগ্রগতি ঘটেছে, তার মধ্যে আছে উন্নত পরিগণনামূলক পদ্ধতি যেমন যন্ত্রীয় শিখন (মেশিন লার্নিং) ব্যবহার করে উপাদান আবিষ্কার ও নকশাকরণ, নতুন অতিদ্রুত বর্ণালীবীক্ষণ কৌশল ব্যবহার করে ফেমটোসেকেন্ড সময়মাপনীতে আণবিক গতিশীলতা অধ্যয়ন এবং মর্জিমাফিক ধর্মের নতুন ন্যানোউপাদানসমূহের সংশ্লেষণ।
ভবিষ্যতে রসায়নে কোয়ান্টাম পরিগণনের (কম্পিউটিং) প্রয়োগ, আলোকীয় অনুঘটন ও কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তি আহরণ, জীবজ অণুসমূহের গতিবিজ্ঞান অনুধাবন, এবং অনন্য ইলেকট্রনীয়, আলোকীয় ও যান্ত্রিক ধর্মবিশিষ্ট নতুন উপাদান সৃষ্টি, আণবিক স্তরে কোয়ান্টাম ঘটনাবলী অনুধাবন ও নিয়ন্ত্রণ, ইত্যাদি শাস্ত্রটির কিছু সম্ভাব্য অধ্যয়নযোগ্য বিষয়।
রাসায়নিক পদার্থবিজ্ঞানের কিছু ব্যবহারিক প্রয়োগের মধ্যে আছে বর্ণালীবীক্ষণিক পদ্ধতির দ্বারা রোগনির্ণয় ও নতুন ঔষধ আবিষ্কার, পরিগণনামুলক প্রতিমাণ নির্মাণ ও ছদ্মায়ন কৌশলের দ্বারা নতুন উপাদান নকশাকরণ, বর্ণালীবীক্ষণিক কৌশলের দ্বারা পরিবেশের নমুনা অতিক্ষুদ্র দূষক পদার্থ, অতিসামান্য অবশিষ্ট গ্যাস ও অন্যান্য দূষক পদার্থ উচ্চ সংবেদনশীলতা ও বাছাইক্ষমতার (selectivity) সাথে শনাক্ত করা, বাস্তব সময়ে সরাসরি দূষক শনাক্ত করার জন্য সুবেদী গ্রাহক (সেনসর) নির্মাণ করা ও এভাবে পরিবেশ নজরদারি, এবং নতুন উপাদান সৃষ্টি ও অন্যান্য রাসায়নিক কৌশলগুলির (যেমন পাতলা ঝিল্লি অধঃক্ষেপণ) উন্নতিসাধনের দ্বারা উন্নত ইলেকট্রনীয় কলকৌশল নির্মাণ।
রাসায়নিক পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের মধ্যে আছেন লিনুস পাউলিং, যিনি রাসায়নিক বন্ধনের উপর গবেষণাকর্মের জন্য বিখ্যাত; এবং জন পপল, যিনি পরিগণনামূলক রসায়নের পদ্ধতিগুলির জন্য সুপরিচিত এবং আহমেদ জেওয়াইল, যিনি ফেমটোসেকেন্ড সময়মাপনীতে সংঘটিত রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি অতিদ্রুত লেজার প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাস্তব সময়ে পর্যবেক্ষণ করেন।
রাসায়নিক পদার্থবিজ্ঞান অধ্যয়নশেষে উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় গবেষক, শিল্পখাত (রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন কারখানা), সরকারি বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার, গুণমান প্রকৌশলী, শিল্প প্রকৌশলী, দেহকলা প্রকৌশলী, উপাদান বিজ্ঞানী হিসেবে কিংবা পেট্রোরসায়ন, প্রাণরসায়ন ও জৈবপ্রযুক্তি খাতের পদে এমনকি নতুন সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মজীবন শুরু করার সম্ভাবনা আছে, যেখানে রাসায়নিক পদার্থবিজ্ঞানীরা তাত্ত্বিক প্রতিমান নির্মাণ (মডেলিং), পরীক্ষামূলক কৌশল ও আন্তঃশাস্ত্রীয় সহযোগিতার উপর জোর দিয়ে থাকেন।