রোগীভিত্তিক পরীক্ষণ (ইংরেজি: Clinical trial) বলতে এক ধরনের সুপরিকল্পিত পরীক্ষামূলক, রোগীভিত্তিক ও অনুসন্ধানমূলক গবেষণা কর্মকাণ্ডকে বোঝায় যেখানে একাধিক রোগী বা ব্যক্তির দলের উপরে কোনও নির্দিষ্ট ঔষধ, টিকা, বা অন্য কোনও ধরনের চিকিৎসা (যেমন শল্যচিকিৎসা, বিকিরণ চিকিৎসা, কোষীয় চিকিৎসা, জৈবিক চিকিৎসা, আচরণীয় চিকিৎসা, ইত্যাদি) প্রয়োগ করা হয় এবং রোগীদের স্বাস্থ্যের উপর এর ফলাফল নৈর্ব্যক্তিক তথ্য-উপাত্ত আকারে সংগ্রহ করে সেই ঔষধ, টিকা বা চিকিৎসা পদ্ধতির কার্যকারিতা (নিরাময় ক্ষমতা) ও নিরাপত্তার পরিসংখ্যানিক বিশ্লেষণভিত্তিক বিজ্ঞানসিদ্ধ মূল্যায়ন করা হয়।[১][২][৩]
সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সম্ভাব্য উপকারিতা বনাম ঝুঁকির অনুপাত বিবেচনা করে অনুমোদন করলে তবেই এই পরীক্ষণ সম্পাদন করা যায়। এমনভাবে নকশা করা হয় যাতে পরীক্ষণের বৈজ্ঞানিক বৈধতা ও পুনরাবৃত্তিযোগ্যতা নিশ্চিত হয়। অনুমোদন পেতে পেতে কোনও নতুন ঔষধ পরীক্ষণের খরচ বহু শত কোটি মার্কিন ডলার লেগে যেতে পারে।[৪] সাধারণত সরকারি সংস্থা, ঔষধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা-যন্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বা জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এইসব পরীক্ষণের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। এক বা একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এই পরীক্ষাগুলি সম্পাদন করা হতে পারে।
সাধারণত রোগীভিত্তিক পরীক্ষণ খুবই কঠোর প্রণালীতে পরিকল্পিতভাবে নকশা করা হয় এবং এর আদর্শ রূপটি একটি দ্বৈত-অন্ধ দৈবকৃত নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষণ; এই ক্ষেত্রে পরীক্ষাধীন ঔষধ বা চিকিৎসাপদ্ধতিটিকে একটি অংশগ্রহণকারী রোগীর বা ব্যক্তির দলের উপরে প্রয়োগ করা হয় ও একই বয়স, লিঙ্গ, রোগাবস্থাবিশিষ্ট অপর একটি দলকে বিদ্যমান আদর্শ চিকিৎসা বা সান্ত্বনামূলক ঔষধ দেওয়া হয় এবং এই দুইয়ের ফলাফলের মধ্যে তুলনা করা হয়। আদর্শ পরীক্ষণে চিকিৎসক ও রোগী কেউই জানেন না কোন্ দলে কোন্ রোগী বা অংশগ্রহণকারী আছেন; তাই একে দ্বৈত-অন্ধ পরীক্ষা বলে, এবং এটিই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পন্থা।[৫] রোগীভিত্তিক পরীক্ষণে সীমিতসংখ্যক নমুনা রোগীর উপর গবেষণা চালানো হয়, কিন্তু এর লক্ষ্য ভবিষ্যতে সমস্ত রোগীর উপরে নির্ভরযোগ্যভাবে কোনও চিকিৎসা প্রয়োগ করা যাবে কি না, তা নির্ধারণ করা। যেহেতু বহু মানুষের উপরে পরীক্ষা চালানো হয়, সেহেতু গবেষণাবিধি শতভাগ মান্যকরণ নিশ্চিত করা অসম্ভব; গবেষক বিজ্ঞানীদেরকে এ ব্যাপারটিকে গণনায় ধরেই পরীক্ষণ পরিকল্পনা ও ফলাফল হিসেবে প্রাপ্ত উপাত্তের বিশ্লেষণ করতে হয়।
রোগীভিত্তিক পরীক্ষণ একটিমাত্র রোগীর উপরে করা হয় না, বরং বহুসংখ্যক রোগীর একটি প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনা জনসমষ্টির উপরে প্রযুক্ত হয়। রোগীভিত্তিক পরীক্ষণ এক ধরনের হস্তক্ষেপমূলক ও পরীক্ষামূলক গবেষণা, পর্যবেক্ষণমূলক নয়, কেননা এখানে রোগীদেরকে পরোক্ষভাবে পর্যবেক্ষণের বদলে সরাসরি তাদের দেহে কোনও নতুন ঔষধ বা চিকিৎসা প্রয়োগ করা হয়।[৫] এটি এক ধরনের অনুদৈর্ঘ্য গবেষণা, অনুপ্রস্থ নয়, কেননা এখানে একই ধরনের ব্যক্তির দলের কিছু বৈশিষ্ট্য সময়ের সাপেক্ষে আগে ও পরে পরিমাপ করা হয়। এটি একটি ভবিষ্যৎ-সাপেক্ষ গবেষণা, অতীত-সাপেক্ষ গবেষণা নয়; কারণ এখানে অপরিকল্পিতভাবে অতীতে সংগৃহীত তথ্যের বা নথির সাথে ইতিমধ্যে সংঘটিত চিকিৎসা ফলাফল অধ্যয়ন করা হয় না, বরং এটিতে পরিকল্পিতভাবে চিকিৎসা প্রয়োগের পরে রোগীকে অনুসরণ করে প্রাপ্ত ভবিষ্যতের ফলাফল অধ্যয়ন করা হয়।[৫] এটি একটি বিশ্লেষণমূলক গবেষণা, বিবরণমূলক নয়, কারণ এখানে দুই বা তার বেশি রোগীর দল থেকে প্রাপ্ত ফলাফল তুলনা করা হয়।[৫]
সাধারণত রোগীভিত্তিক পরীক্ষণে অধীত ঔষধগুলির মাত্র ১০%-কে অনুমোদন দেওয়া হয়।[৬]
প্রাক-রোগীভিত্তিক গবেষণায় পরীক্ষাগারে কাচের নলে জীবন্ত দেহকলাতে কিংবা প্রাণীর উপরে ঔষধ প্রয়োগ করে সে বাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এরপর রোগীভিত্তিক পরীক্ষণ ক্রমবর্ধমান কিছু দশায় সম্পাদন করা হয়। রোগীভিত্তিক পরীক্ষণকে চারটি (মতান্তরে পাঁচটি) দশায় ভাগ করা যায়।[১][৭]
শূন্যতম দশার পরীক্ষণ – এক্ষেত্রে ঔষধটি খুবই স্বল্প মাত্রায় স্বল্পসংখ্যক (১০ থেকে ১৫ জন) রোগী বা ব্যক্তির উপরে প্রয়োগ করে দেহের ঔষধের শোষণ, বিপাক, কার্যপ্রণালী (ঔষধসঞ্চরণবিজ্ঞান ও ঔষধক্রিয়াবিজ্ঞান) ও স্বাস্থ্যের উপরে এর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা হয়।[৭]
প্রথম দশার পরীক্ষণ – এক্ষেত্রে কোনও ঔষধের সবচেয়ে কমসংখ্যক বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা নির্ণয় করার চেষ্টা করা হয়। সাধারণত ১৫ থেকে ৩০ জন রোগীর উপরে ঔষধ প্রয়োগ করা হয়। প্রথমে কিছু রোগীর উপরে স্বল্পমাত্রায় প্রয়োগ করা হয়, এবং পরবর্তীতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুরুতর রূপ ধারণ না করার আগ পর্যন্ত ধীরে ধীরে মাত্রার পরিমাণ বাড়ানো হয়। যদি পরীক্ষণ শেষে ঔষধটি যথেষ্ট নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে এটিকে দ্বিতীয় দশার পরীক্ষণের জন্য প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা হয়।[৫][৭]
দ্বিতীয় দশার পরীক্ষণ – এর আরেক নাম পরীক্ষামূলক কার্যকারিতা গবেষণা। এক্ষেত্রে প্রথম দশার তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশীসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবকদের দেহে ঔষধ বা টিকার কার্যকারিতা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। টিকার ক্ষেত্রে অনাক্রম্যতা-উৎপাদনী ক্ষমতার উপর জোর দেওয়া হয়, অন্যদিকে ঔষধের ক্ষেত্রে এর নিরাময় ক্ষমতার উপরে জোর দেওয়া হয়। তবে এই দশায় রোগের বিদ্যমান চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধের সাথে তুলনা করা হয় না। এছাড়া এই দশাতে ঔষধের নিরাপত্তার উপরে আরও পরীক্ষা চালানো হয়। যদি ঔষধটি কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে এটিকে তৃতীয় দশার পরীক্ষণের জন্য নির্বাচিত করা হয়।[১][৭]
তৃতীয় দশার পরীক্ষণ – বিস্তৃত রোগীভিত্তিক পরীক্ষণ। এই দশাটিতে কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করা হয় এবং নতুন ঔষধ ও বিদ্যমান চিকিৎসা-সেবাতে ব্যবহৃত আদর্শ ঔষধের মধ্যে তুলনা করা হয়। সাধারণত বৃহৎ সংখ্যক (শতাধিক) রোগীর উপরে এটি পরিচালনা করা হয়। অংশগ্রহণকারীদেরকে দ্বৈত-অন্ধ পদ্ধতিতে দৈবভাবে অধীত দল ও নিয়ন্ত্রক দলের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। নিয়ন্ত্রক দলটি বিদ্যমান আদর্শ ঔষধ গ্রহণ করে। তৃতীয় দশাশেষে নতুন ঔষধটি অধিকতর নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হলে সাধারণত নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ সাধারণ রোগীদের উপরে ঔষধটির ব্যবহার অনুমোদন করে।[১][৭]
চতুর্থ দশার পরীক্ষণ – বিপণনোত্তর রোগীভিত্তিক পরীক্ষণ। নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ঔষধ বা টিকা নিবন্ধন করতে অনুমোদন দিলে এবং এর গণউৎপাদন ও বিপণন শুরু হলে বিপুল সংখ্যক (বহু হাজার) ব্যক্তির উপরে এই পরীক্ষণটি সম্পাদন করা হয়। এর সাধারণ লক্ষ্য হল বাস্তব জীবনে ঔষধ ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট বিরল স্বল্পমেয়াদী বা দীর্ঘমেয়াদী বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলি প্রাক্কলন করা। সম্ভাব্য নতুন কোনও উপকারিতা বা কার্যকারিতা কিংবা ভিন্ন আরেকটি চিকিৎসার সাথে একত্রে ব্যবহারের সম্ভাব্য উপকারিতা, ইত্যাদি ব্যাপারগুলি আবিষ্কার করাও সম্ভব হতে পারে।[১][৭]
Of the drugs started in clinical trials on humans, only 10 percent secure F.D.A. approval. ...