লালদীঘি পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ অঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি বৃহদাকার ঐতিহাসিক জলাশয়। এই দীঘির ইতিহাস কলকাতা মহানগরীর ইতিহাস অপেক্ষাও প্রাচীনতর। ব্রিটিশ যুগে এই জলাশয়টি ছিল শহরের অন্যতম মিষ্টি পানীয় জলের উৎস। বর্তমানে এই দীঘির উত্তর ভাগে মহাকরণের সম্মুখে রাজ্য সরকার একটি ভূগর্ভস্থ কার পার্কিং প্লাজা নির্মাণ করছে।
জব চার্নকের আগমনের পূর্বেই ডিহি কলিকাতা গ্রামে লালদীঘির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়।[১] লালদীঘির নিকটেই সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের একটি কাছারি ও গৃহদেবতা শ্যামরায়ের (শ্রীকৃষ্ণ) মন্দিরটি অবস্থিত ছিল। অনুমান করা হয়, দোলযাত্রা উপলক্ষে রং খেলার পর এই দীঘির জল লাল হয়ে উঠত বলে দীঘিটি লালদীঘি নামে পরিচিত হয়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উক্ত কাছারিবাড়িটি প্রথমে ভাড়া ও পরে ক্রয় করে নিয়েছিলেন।[২]
অবশ্য লালদীঘির নামকরণ নিয়ে অন্য কাহিনিও প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলেন, পুরনো কেল্লার লাল রংটি এই দীঘির জলে প্রতিবিম্বিত হতো বলে দীঘিটি লালদীঘি নামে পরিচিত হয়।[২] অন্যমতে, জনৈক লালচাঁদ বসাক এই দীঘিটি খনন করিয়েছিলেন। তার নামানুসারেই দীঘিটির নাম হয় লালদীঘি।[৩]
নব্যভারত-এ প্রাণকৃষ্ণ দত্ত এই দীঘির অন্য একটি ইতিহাসের বর্ণনা দিয়েছেন। তার মতে, গোবিন্দপুরের মুকুন্দরাম শেঠ বা তার পুত্রেরা এই দীঘি খনন করিয়ে থাকবেন। এই দীঘির ধারে তার কাছারি অবস্থিত ছিল। দোলের দিন রংখেলার পর দীঘির জল লাল হয়ে যেত বলে দীঘির নামকরণ হয় লালদীঘি।[২]
যাই হোক, ১৭০৯ সালে এই নোংরা শ্যাওলা ও পানায় ভরতি পুকুরটির জল শোধিত করে এটিকে একটি মিষ্টি জলের জলাধারে পরিণত করা হয়।[১]
অষ্টাদশ শতকে ট্যাঙ্ক স্কোয়ার বা লালদীঘি-সংলগ্ন চত্বরটি ছিল ‘শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত’। এই দীঘির আয়তন ছিল ২৫ একর। ডাচ অ্যাডমিরাল স্ট্যাভার্নিয়াস ১৭৭০ সালে এই অঞ্চল পরিভ্রমণের পর লেখেন, ‘সরকারের আদেশক্রমে কলকাতাবাসীদের শুদ্ধ ও মিষ্টি পানীয় জল সরবরাহের উদ্দেশ্যে এই দীঘি খনন করা হয়। একাধিক জলের উৎস দীঘির জল সর্বদা সব স্তরে রাখতে সাহায্য করে। এটির চারিদিক রেলিং দিয়ে ঘেরা। তাই কেউ এই দীঘির জল ব্যবহার করতে পারে না।’ পূর্বে দীঘিটি আরও বড়ো ছিল। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে দীঘিটি পরিষ্কার করে এর পাড় বাঁধিয়ে দেওয়া হয়। এই দীঘির জল সেই সময় ছিল শহরের সবচেয়ে মিষ্টি জল। পৌরসংস্থার জল সরবরাহ পরিষেবা চালুর আগে এই দীঘিই শহরের ইউরোপীয় বাসিন্দাদের জলের চাহিদা মেটাত।[৪]
১৭৫৬ সালের ১৮ জুন, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও বাংলার নবাব সিরাজদৌলার মধ্যে সংঘটিত লালদীঘির যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর পরাজয় ঘটেছিল। এর ফলে কলকাতা ব্রিটিশদের হাতছাড়া হয়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরা আবার শহরের দখল নিতে সক্ষম হয়।[৫]
পশ্চিমবঙ্গ সরকার দীঘির উত্তর পাড়ে মহাকরণের সম্মুখে ১১৫,০০০ বর্গফুট আয়তনবিশিষ্ট একটি ভূগর্ভস্থ কার পার্ক তৈরি করেছে। ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়েছে এবং উক্ত কার পার্কে ৭০০ গাড়ি পার্ক করা যায়। বর্তমানে এটিই শহরের বৃহত্তম কার পার্কিং প্লাজা।[৬][৭]