শচীন দেববর্মণ | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | অক্টোবর ৩১, ১৯৭৫ | (বয়স ৬৯)
অন্যান্য নাম | এস. ডি. বর্মণ |
কর্মজীবন | ১৯৩৩-১৯৭৫ |
দাম্পত্য সঙ্গী | মীরা দেববর্মণ, বিবাহ-পূর্বঃ মীরা দাসগুপ্ত (১৯২৩-২০০৭) |
সন্তান | রাহুল দেববর্মণ |
পুরস্কার | পূর্ণ তালিকা |
শচীন দেববর্মণ (১ অক্টোবর, ১৯০৬ - ৩১ অক্টোবর, ১৯৭৫) বিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দী গানের কিংবদন্তীতুল্য ও জনপ্রিয় সঙ্গীত পরিচালক , সুরকার , গায়ক ও লোকসঙ্গীত শিল্পী । প্রায়শ তাঁকে এস ডি বর্মণ হিসেবেই উল্লেখ করা হয়। কিছুটা অনুনাসিক কণ্ঠস্বরের জন্য তিনি তার শ্রোতাদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। প্রায় একশো বছর পার করেও বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে তার কালোত্তীর্ণ গানের আবেদন কিছুমাত্র লঘু হয়নি। কেবল সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে নয়, গীতিকার হিসাবেও তিনি সার্থক। তিনি বিভিন্ন চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর পুত্র রাহুল দেববর্মণ ভারতের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। তাঁর ছাত্রী এবং পরবর্তীতে সহধর্মিনী মীরা দেববর্মণ গীতিকার হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি রবি গুহ মজুমদার এর অনেক গানে সুর দিয়েছেন এবং তা শিল্পে রূপান্তরিত করেছেন। তিনি ২ বার (১৯৫৫ ও ১৯৭৪) সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার এবং ১৯৭০ সালে শ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়ক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (ভারত) লাভ করেন।
তার জন্ম কুমিল্লার ত্রিপুরা রাজবাড়িতে৷ তবে আদিবাস বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে৷ তিনি ছিলেন ত্রিপুরার চন্দ্রবংশীয় মানিক্য রাজপরিবারের সন্তান। বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা শুরু করেন। তৎকালীন ত্রিপুরার অন্তর্গত কুমিল্লার রাজপরিবারের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। মা মণিপুর রাজবংশের মেয়ে নিরুপমা দেবী। ত্রিপুরার আগরতলায় কুমার বোর্ডিং স্কুলে শচীন দেববর্ম্মণের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়। ত্রিপুরার রাজপরিবারের সন্তানদের এবং তথাকথিত ধনী ঘরের সন্তানদের পড়াশোনার জন্যেই এই স্কুলটি বিশেষভাবে তৈরি হয়েছিল। পরে তাঁর বাবা নবদ্বীপচন্দ্র তাঁকে কুমিল্লার ইউসুফ স্কুলে ভর্তি করে দেন। এই স্কুলে কিছুদিন কাটিয়ে কুমিল্লা জেলা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন শচীন দেববর্মণ।১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ঐ কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ তে ভর্তি হন। ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে তিনি সঙ্গীতের প্রথাগত তালিম নেওয়া শুরু করেন। তারপর একে একে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, সারেঙ্গীবাদক বাদল খান, সরোদবাদক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কাছে সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের শিক্ষা গ্রহণ করেছেন শচীন দেববর্ম্মণ। কুমিল্লায় থাকাকালীন বিখ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে স্থায়ীভাবে মুম্বাইয়ে বসবাস করতে শুরু করেন ছোটবেলা থেকে সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগী ছিলেন।। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে প্যারালিটিক স্ট্রোক হয়ে কোমায় ছিলেন পাঁচ মাস। ৩১ অক্টোবর, ১৯৭৫ তার প্রয়াণ হয়।
কুমিল্লার ঐতিহাসিক অভয় আশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক সংগীত প্রাণ প্রয়াত শ্রী পরিমল দত্তের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, শহরের চর্থা এলাকার গোল পুকুরের দক্ষিণ পাড়ের এই বাড়িটি ছিল তৎকালীন ভারত বর্ষের ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের সৎভাই মহারাজ নবদ্বীপ কুমার দেববর্মন বাহাদুরের। ত্রিপুরার এই মহারাজার স্ত্রী ছিলেন বেশ কয়েকজন। তার মধ্যে পাটরাণী পুত্র মহারাজা নবদ্বীপ কুমার দেববর্মন বাহাদুরকে আরেক রাণীর পুত্র বীরচন্দ্র মানিক বাহাদুর হত্যা করতে উঠে পড়ে লাগলে উপায়ান্তর না দেখে মহারাজ নবদ্বীপ রাজ বাড়ির কর্মকর্তা শ্রী কৈলাস সিংহের পরামর্শে সপরিবারে কুমিল্লায় চলে আসেন। জানা যায়, বিখ্যাত ‘রাজমালা’ গ্রন্থটি কৈলাশ সিংহ রচনা করেছিলেন। কৈলাস সিংহের পরামর্শে মহারাজ নবদ্বীপ সিংহাসনের দাবীও এ সময় ছেড়ে দিয়েছিলেন। কুমিল্লা শহরের পূর্ব চর্থায় অবস্থিত এ বাড়িটি তৎসময়ে নির্মিত হয়েছিল। বাড়িটি দেখতে কুমিল্লা শহরের ব্রিটিশ আমলে তৈরী বাড়িগুলোর মতোই মনে হয়। কোন রাজ প্রসাদের মত দেখতে এ বাড়িটি নয়। এই কুমার দেববর্মণ বাহাদুরের পুত্রই হলেন শচীন দেববর্মন।
বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণ ছিলেন একজন সেতারবাদক এবং ধ্রূপদী সঙ্গীতশিল্পী। তিনিই ছিলেন শচীন দেববর্মণের প্রথম শিক্ষক। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে হতে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে সঙ্গীতচর্চা করেন। এরপর তার সঙ্গীত শিক্ষা চলে উস্তাদ বাদল খান এবং বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে। ধ্রূপদী সঙ্গীতের এই শিক্ষা তার মধ্যে সঙ্গীতের মৌলিক জ্ঞান সঞ্চারে গভীর ভূমিকা পালন করে। এই শিক্ষা তার পরবর্তী জীবনের সুর-সাধনায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। পরবর্তীতে তিনি উস্তাদ আফতাবউদ্দিন খানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শহরের চর্থা এলাকার শচীন দেববর্মনের বাড়ির উল্টো দিকে অবস্থিত মুন্সি বাড়ির ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাড়ির জমিদার সালাহউদ্দিন আহম্মেদ প্রকাশ মর্তুজ মিয়ার বন্ধু ছিলেন শচীন দেববর্মণ। মর্তুজ মিয়ার পরিবারিক ইতিহাস থেকে শচীন দেববর্মণের গায়ক হওয়ার পিছনের চমকপ্রদ তথ্য জানা যায়। জানা যায়, কৈশোরে একদিন শচীন দেববর্মণ ও মর্তুজ মিয়া যখন মুন্সি বাড়ির সামনের রাস্তায় রাতের বেলায় পায়চারী করছিলেন তখন শচীন দেববর্মণগুণগুন করে গান গাইছিলেন। এ সময় বাড়ির সামনে বসা জমিদার নাবালক মিয়া বাড়ির চাকর সফর আলীকে রাস্তায় গান গাওয়া ছেলেটাকে ডেকে আনতে বললেন। সফর গিয়ে শচীন দেববর্ম্মণ কে বললেন, শচীন কর্তা আপনাকে হুজুর ডেকেছে। তখন শচীন দেববর্মণ ভয় পেয়ে যান। পরে অভয় দিয়ে তাকে ডেকে এনে নাবালক মিয়া জিজ্ঞাসা করেন, তোর তো গলা ভালো, কোন বাদ্য যন্ত্র আছে কিনা? তখন শচীন না সূচক উত্তর দিলে জমিদার নাবালক মিয়া পিয়ানো, হারমোনিয়াম, তবলাসহ সংগীতের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি কিনে তার নিজ গৃহের একটি কে সংগীত সাধনের ব্যবস্থা করে দেন। কানাকেষ্ট নামের এক তবলচি রেখে দেন। সে থেকে সংগীতে শচীনের উত্থান ঘটে।
বীরচন্দ্র মাণিক্যের অর্থানুকূল্যে, কুমিল্লার চর্থায় ৬০ একর জমি নিয়ে প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন কুমার বাহাদুর নবদ্বীপচন্দ্র। এই প্রাসাদে ১৯০৬ সালের পয়লা অক্টোবর তার ছোট সন্তান শচীন দেববর্মণের জন্ম। ১৯১০ থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ঠাকুরপাড়ার সুরলোক, কান্দিরপাড়ের সবুজ সংঘ নাট্যদল, দি গ্রেট জার্নাল থিয়েটার পার্টি, ইয়ংম্যান্স ক্লাব ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠেছিল কুমিল্লার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল। ত্রিপুরার মহারাজারা কুমিল্লায় তৈরি করেছেন টাউনহল, নাট্যশালা, লাইব্রেরি এবং নানা সংস্কৃতিক কেন্দ্র। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে শচীন দেবের বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, অজয় ভট্টাচার্য, মোহিনী চৌধুরী, সমরেন্দ্র পাল, কাজী নজরুল ইসলাম, শৈলবালা দাম, ধ্রুপদীয়া সৌরেন দাশ, সুধীন দাশ প্রমুখ। সেখানে নিয়মিত আসতেন চলচ্চিত্র পরিচালক সুশীল মজুমদার, ননী মজুমদার, ব্রজেন ব্যানার্জি, জিতু দত্ত, অরুণ মহলানবিশ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। গানের ধরন ছিল ভোরকীর্তন, নগরকীর্তন, কবিগান, ঢপযাত্রা। সাহিত্যিক, সুরকার, গীতিকার, কবি ও সঙ্গীতজ্ঞগণ একত্রিত হতেন ইয়ংমেন্স ক্লাবে। আড্ডা থেকে ভেসে আসত নজরুল ও শচীন দেববর্ম্মণের গান। নজরুল কুমিল্লা এলে থাকতেন তালপুকুরের পশ্চিমপাড়ে একটি ঘরে।[১] কুমিল্লা থেকে শচীন দেববর্ম্মণ কলকাতা চলে আসেন ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে।[১]কুমিল্লার বাড়িটি ইতিমধ্যে স্মৃতি হিসেবে সংক্ষরণ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে সংস্কার ও সংরক্ষণ কাজ করা হয়েছে। এখানে আন্তর্জাতিক মানের একটি সংগীত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং মিউজিক্যাল আর্কাইভ স্থাপন করা হবে।[২]
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে তিনি প্রথম গান করেন। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে পিতা নবদ্বীপচন্দ্র কলকাতায় দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন ত্রিপুরার প্রধানমন্ত্রী। শচীন দেববর্ম্মণ তখন থাকতেন কলকাতার ত্রিপুরা প্যালেসে। নিজের লেখা সরগমের নিখাদ নামক আত্মজীবনীতে শচীন দেববর্মণ স্বয়ং লিখেছেনঃ "পিতার মৃত্যুর পর আমি যেন অগাধ জলে পড়ে গেলাম। এই অবস্থায় আমি আগরতলা বা কুমিল্লা গিয়ে থাকলে রাজকীয় আরামে ও নিশ্চিন্তে নিজেদের বাড়িতে বাস করতে পারতাম এবং রাজ্য সরকারের কোনো উচ্চপদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতাম। আমার বড় ভাইরা আমাকে তাই করতে বললেন। আমার কিন্তু এ ব্যবস্থা মনঃপূত হলো না। নিজে একলা সংগ্রাম করে, নিজে উপার্জন করে সঙ্গীত সাধনায় জীবন কাটিয়ে দেব। মনের মধ্যে একমাত্র এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কলকাতার ত্রিপুরা প্রাসাদ ছেড়ে ভাড়া করা সামান্য একখানা ঘরে আমার আস্তানা বাঁধলাম।"[৩]
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অডিশনে ফেল করলেন ভারতের রেকর্ড প্রস্তুতকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এইচএমভিতে। তবে সে একই বছর তার প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বের হয় হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস থেকে শচীন দেববর্ম্মণ প্রথম রেকর্ডকৃত দুটি গান হল পল্লীগীতির ঢঙে গাওয়া "ডাকিলে কোকিল রোজ বিহানে" যার গীতিকার হেমেন্দ্র কুমার রায় এবং খাম্বাজ ঠুমরি অঙ্গের রাগপ্রধান "এ পথে আজ এসো প্রিয়" যার গীতিকার শৈলেন রায়। ১৯৩০-এর দশকে তিনি রেডিওতে পল্লীগীতি গেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পূর্ব বাংলা এবং উত্তর-পূর্ব বাংলার পল্লীগীতির উপর তার বিশেষ ঝোঁক ছিল।
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে অল ইন্ডিয়ান মিউজিক কনফারেন্সে তিনি গান গেয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে ঠুমরি পেশ করে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁকে মুগ্ধ করেছিলেন। শেখ ভানুর রচনা ‘নিশিথে যাইয়ো ফুলবনে’ দেহ ও সাধনতত্ত্বের গানটিকে প্রেমের গানে রূপান্তর করলেন কবি জসিমউদ্দিনকে দিয়ে এবং রূপান্তরিত এই গানটি রেকর্ড করলেন ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে। [১] ১৯৩৭ এ মীরা ধরকে বিয়ে করেন। মীরা ধর ছিলেন তার সঙ্গীত জীবনের বিশ্বস্ত সঙ্গী। বাংলা গানের জগতে মীরা ধর তথা মীরা দেববর্মণ অন্যতম সার্থক গীতিকার। তার লেখা গানের মধ্যে আছে;
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজগী নামক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তার সঙ্গীত পরিচালনা জীবনের শুরু। তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গান হলো: