শ্যামপুকুর উত্তর কলকাতার একটি অঞ্চল, থানা এলাকা ও বিধানসভা কেন্দ্র। মূল শ্যামপুকুর এলাকার আয়তন অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকার হলেও, থানা ও বিধানকেন্দ্রটি বেশ বড়ো।
হুগলি জেলার শেঠ ও বসাক বণিকগণ ছিলেন সুতানুটি অঞ্চলের আদি বাসিন্দা। এঁরাই সুতানুটির জঙ্গল পরিষ্কার করে এই অঞ্চলটিকে বাসযোগ্য করে তোলেন। শ্যামপুকুর ও তৎপার্শ্ববর্তী শ্যামবাজার অঞ্চলদুটি সম্ভবত বসাকদের গৃহদেবতা শ্যাম রায়ের (কৃষ্ণ) নামে নামাঙ্কিত।[১]
প্রাচীন সুতানুটির প্রাণকেন্দ্র ছিল শ্যামপুকুর। ১৭৮৫ সালে প্রথম কলকাতার থানাগুলির তালিকা প্রস্তুত করা হয়। এই তালিকায় শ্যামপুকুর থানার নাম পাওয়া যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা কলকাতায় অনেক সুসংহতভাবে প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে। থানাগুলি থেকে সেই সময় নানা নাগরিক সুযোগ সুবিধাও পাওয়া যেত। ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার পুলিশ কমিশনার (নগরপাল) মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যানের (মহানাগরিক) দায়িত্বও পালন করতেন। ১৮৮৮ সালে কলকাতায় যে পঁচিশটি থানার অস্তিত্ব ছিল, তার মধ্যে একটি ছিল শ্যামপুকুর থানা। যদিও আঞ্চলিক গুরুত্বের বিচারে শ্যামপুকুরের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ একই থানা এলাকার অন্তর্গত শ্যামবাজার ও বাগবাজার। এই দুই অঞ্চল ছিল সেকালের বাঙালি সংস্কৃতি ও আভিজাত্যের পীঠস্থান।[২]
কলকাতা পুলিশের শ্যামপুকুর থানা এলাকাটি শ্যামবাজার, বাগবাজার, কুমারটুলি ও শোভাবাজারের একাংশ নিয়ে গঠিত। বাগবাজার ঘাট, প্রমদাসুন্দরী ঘাট, কাশী মিত্র ঘাট, কুমারটুলি ঘাট ও শোভাবাজার ঘাট এই থানা এলাকার মধ্যে অবস্থিত হুগলি নদীর কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী ঘাট।[৩]
শ্যামপুকুর থানা কলকাতা পৌরসংস্থার ৭ নং (বাগবাজার), ৮ নং (বাগবাজার-শোভাবাজার), ৯ নং (শোভাবাজার), ১০ নং (শ্যামবাজারের অংশ) ও ১১ নং (আংশিক শ্যামপুকুর, আংশিক বড়তলা) ওয়ার্ডগুলি নিয়ে গঠিত। ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, এই থানা এলাকার মোট জনসংখ্যা ১১০,৪২০। এর মধ্যে ৬৬,৩৫৯ জন পুরুষ ও ৫৪,০৬১ জন মহিলা। ৮,৯ ও ১১ নং ওয়ার্ডের কয়েকটি অংশে দশকীয় বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক।[৪]
২০০৪ সালের উপনির্বাচনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মদন মিত্র এবং ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্যকে পরাজিত করে ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী জীবন প্রকাশ সাহা শ্যামপুকুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করেন। উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে এখানকার স্থানীয় বিধায়ক সুব্রত বসু বারাসত লোকসভা কেন্দ্র থেকে লোকসভায় নির্বাচিত হলে এখানে উপনির্বাচন আবশ্যক হয়ে পড়ে। ২০০১ সালে ফরওয়ার্ড ব্লকের সুব্রত বসু তৃণমূল কংগ্রেসের পুলকচন্দ্র দাসকে পরাজিত করেছিলেন। ফরওয়ার্ড ব্লকের শান্তিরঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৯৬ সালে কংগ্রেসের সমীর চক্রবর্তী এবং ১৯৯১ সালে কংগ্রেসের শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করেন। ১৯৮৭ ও ১৯৮২ সালে কংগ্রেসের কিরণ চৌধুরী ফরওয়ার্ড ব্লকের নলিনীকান্ত গুহকে এই কেন্দ্র থেকে পরাজিত করেছিলেন। ১৯৭৭ সালে ফরওয়ার্ড ব্লকের নলিনীকান্ত গুহ জেএনপি-র বিনয় সরকারকে এই কেন্দ্র থেকে পরাজিত করেছিলেন।[৫][৬]
শ্যামপুকুর বিধানসভা কেন্দ্র কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত।[৭] বর্তমানে এই কেন্দ্রের সাংসদ তৃণমূল কংগ্রেসের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৮৯১ সালে শ্যামপুকুরের মহারাজা দুর্গাচরণ লাহার বদান্যতায় মোহনবাগান দল ফড়িয়াপুকুর থেকে শ্যামবাজারের মাঠে উঠে আসে। এই মাঠটি বর্তমানে শ্যাম স্কোয়ার নামে পরিচিত।[৮]
১৯০২ সালে যখন জামসেদজি ফ্রামজি মদন তার ‘বায়োস্কোপ’ দৃশ্য তুলতে শুরু করেন, তখন তিনি কলকাতা ময়দান ও শ্যামপুকুরে তাঁবু খাটিয়ে সেই সব চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতেন।[৯]
১৯১১ সালে চালু হওয়া শ্যামপুকুর আদি সর্বজনীনের দুর্গাপূজা কলকাতা দ্বিতীয় প্রাচীনতম বারোয়ারি দুর্গাপূজা।[১০]
ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর রামকৃষ্ণ পরমহংসকে দক্ষিণেশ্বর থেকে কলকাতার শ্যামপুকুরের ৫৫ নং শ্যামপুকুর স্ট্রিটের বাড়িতে এনে রাখা হয়। এই বাড়িটি শ্যামপুকুর বাটী নামে পরিচিত। পরে তাকে এই বাড়ি থেকে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানেই তার প্রয়াণ ঘটেছিল। বর্তমানে রামকৃষ্ণ মিশন এই বাড়িটি অধিগ্রহণ করেছেন। এই বাড়িতে তার ব্যবহৃত কিছু জিনিস ও কয়েকটি চিত্র রাখা আছে। অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে রয়েছে সেই ক্যামেরার কয়েকটি অংশ, যেটি দিয়ে প্রথম রামকৃষ্ণ পরমহংসের ছবি তোলা হয়েছিল।[১১]