গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রীয় রোগলক্ষণসমষ্টি সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস (SARS-CoV বা SARS-CoV-1)[২][৩] করোনাভাইরাসের একটি স্ট্রেন যার কারণে গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রীয় রোগলক্ষণসমষ্টি (সার্স)[৪] নামক রোগাবস্থার সৃষ্টি হয়। এটি একটি আবৃত, ধনাত্মক দিকমুখী, একক-সূত্রবিশিষ্ট আরএনএ ভাইরাস যা ফুসফুসের এপিথেলিয়াল কোষগুলিকে সংক্রমিত করে।[৫] অ্যাঞ্জিওটেনসিন-রূপান্তরকারী এনজাইম 2 (ACE2) রিসেপ্টর এর মাধ্যমে ভাইরাসটি হোস্ট কোষে প্রবেশ করে[৬] এটি মানুষ, বাদুড় এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সংক্রমিত করে।[৭][৮]
২০০৩ সালের ১৬ই এপ্রিল, এশিয়ায় সার্সের প্রাদুর্ভাব এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে গৌণভাবে রোগটির প্রাদুর্ভাবের পর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলে যে বেশ কয়েকটি গবেষণাগার দ্বারা করোনাভাইরাসের চিহ্নিতকরণ সার্স-এর আনুষ্ঠানিক কারণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এবং কানাডার ন্যাশনাল মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবরেটরি (এনএমএল) ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে সার্স-কোভ-১ (SARS-CoV-1) জিনোমটি শনাক্ত করে।[৯][১০] নেদারল্যান্ডের রটারডামের ইরাসমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে সার্স করোনাভাইরাস রবার্ট কচের মৌলিক নীতি পূরণ করেছে যার ফলে এটিকে তাঁরা করোনাভাইরাসের মাধ্যম হিসেবে নিশ্চিত করেছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায়, ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত ম্যাককের মধ্যে (একজাতের ছোটো লেজওয়ালা বাঁদর) মানব সার্স আক্রান্তদের মত একই উপসর্গ বিকশিত হয়।[১১]
গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রীয় রোগলক্ষণসমষ্টি, সার্স-কোভ-১ (SARS-CoV-1) দ্বারা সৃষ্ট রোগ। এটি প্রায়শই গুরুতর অসুস্থতার কারণ হয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের উপসর্গ[১৩] প্রধানত কাশি, ডিস্পনিয়া এবং নিউমোনিয়া শুরু হওয়ার ২-১৪ দিনের মধ্যে এই রোগটিকে প্রাথমিকভাবে পেশী ব্যথা, মাথা ব্যথা এবং জ্বরের লক্ষণ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। সার্স রোগীদের রক্তে ছড়িয়ে থাকা লিম্ফোসাইটের সংখ্যা হ্রাস হয়।[১৪]
২০০৩ সালের সার্স মহামারীতে, সার্স-কোভ-১ সংক্রমিত রোগীদের মধ্যে প্রায় ৯% রোগী মারা যান।[১৫] ৬০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে এই রোগের মৃত্যুর হার অনেক বেশি, এই সাবসেটের রোগীদের জন্য মৃত্যুর হার ৫০% এর কাছাকাছি।[১৫]
২০০৩ সালের ১৭ই মার্চ, হু সার্স-এর কারণমূলক মাধ্যম সনাক্তকরণে সহযোগিতা করার জন্য নেতৃস্থানীয় গবেষণাগারগুলির একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক স্থাপন করে। প্রথমদিকে, নেটওয়ার্কের গবেষণাগারগুলি প্যারামিক্সোভাইরাস এবং করোনাভাইরাস পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অনুসন্ধান সীমাবদ্ধ করেছিল। গবেষণাগারগুলি দ্বারা ভাগ করা প্রাথমিক ফলাফলগুলি ক্রমবর্ধমান ধারাবাহিকতার সাথে করোনভাইরাসের দিকে ইঙ্গিত করে। ২১শে মার্চ হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা একটি নতুন ভাইরাসকে আলাদা করার ঘোষণা করেন যা কে সার্স-এর কারণ হিসেবে সন্দেহ করা হয়।[১৬]
১২ই এপ্রিল ভ্যানকুভারের মাইকেল স্মিথ জিনোম সায়েন্সেস সেন্টারে কর্মরত বিজ্ঞানীরা একটি করোনাভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্স ম্যাপিং শেষ করেন যা সার্স-এর সাথে যুক্ত বলে বিশ্বাস করা হয়। এই দলটির নেতৃত্ব মার্কো মারা করেছিলেন এবং তিনি ব্রিটিশ কলম্বিয়া সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ও ম্যানিটোবার উইনিপেগে ন্যাশনাল মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবরেটরির সহযোগিতায় কাজ করেছিলেন আর ব্যবহার করা হয়েছিল টরন্টোর আক্রান্ত রোগীদের নমুনা। এই ম্যাপিং কে সার্স-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যা জিএসসি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীদের সাথে শেয়ার করা হয়েছে (নীচে দেখুন)। টরন্টোর মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের ডোনাল্ড লো এই আবিষ্কারকে "অভূতপূর্ব গতিতে" করা হয়েছে বলে বর্ণনা করেছিলেন।[১৭] পরবর্তীকালে সার্স- করোনাভাইরাসের সিকোয়েন্সটি অন্যান্য স্বাধীন গ্রুপ দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে।
আণবিক মহামারীবিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে ২০০২-২০০৩ সালের দক্ষিণ চীনের ভাইরাস এবং ২০০৩ সালের শেষের দিকে একই এলাকার থেকে প্রাপ্ত ভাইরাস ভিন্ন এবং ২০০৪ সালের শুরুর ভাইরাসও আলাদা, যা পৃথক প্রজাতির ক্রসিংয়ের ইঙ্গিত দেয়।[১৮] প্রাদুর্ভাবের স্ট্রেনের ফাইলোজেনি (প্রজাতির বিবর্তনের ইতিহাস) দেখায় যে মানব সার্স-কোভ-১ ইউন্নান, কুয়েইচৌ এবং কুয়াংশি-সহ দক্ষিণ-পশ্চিম প্রদেশগুলিতে অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় ভাল, তবে ভাইরাসগুলির বিবর্তন পোষকের মিথস্ক্রিয়া এবং বিশেষত্বের ফলাফল স্বরুপ হয়।[১৯]
২০০৩ সালের মে মাসের শেষের দিকে চীনের কুয়াংতুংয়ের স্থানীয় বাজারে খাদ্য হিসেবে বিক্রি করা বন্য প্রাণীর নমুনাগুলি থেকে প্রাপ্ত গবেষণায় পাম সিভেট (এক ধরনের বিড়াল) এর থেকে সার্স করোনাভাইরাসের একটি স্ট্রেনকে আলাদা করা হয়েছে , কিন্তু এই প্রাণীরা সবসময় ক্লিনিক্যাল লক্ষণ দেখায় না। প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ছিল যে সার্স ভাইরাস পাম সিভেট থেকে মানুষের জেনোগ্রাফিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে, এবং তার ফলস্বরুপ কুয়াংতুং প্রদেশে ১০,০০০ এর ও বেশি পাম সিভেটকে হত্য়া করা হয়। পরবর্তীতে ভাইরাসটি রাকুন কুকুর, ফেরেট ব্যাজার এবং গার্হস্থ্য বিড়ালের মধ্যে পাওয়া যায়। ২০০৫ সালে, দুটি গবেষণায় চীনা বাদুড়গুলিতে বেশ কয়েকটি সার্স-জাতীয় করোনভাইরাস চিহ্নিত করা হয়েছিল।[২০][২১] যদিও বাদুড়-সার্স ভাইরাস সেল কালচারে প্রতিলিপি তৈরি করতে পারেনি, ২০০৮ সালে আমেরিকান গবেষকরা[২২] উভয় বাদুড় এবং ইঁদুরের ক্ষেত্রেই মানব রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেন এর সাথে বাদুড়-সার্স ভাইরাসের জিনগত কাঠামো পরিবর্তন করেছিলেন যা প্রমাণ করেছিল যে বিবর্তনে কীভাবে জুনোসিস (একটি সংক্রামক রোগ যা একটি অমানব প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়) ঘটতে পারে।[২৩] এই ভাইরাসের ফিলোজেনেটিক বিশ্লেষণ একটি উচ্চ সম্ভাবনা নির্দেশ করে যে সার্স করোনাভাইরাস বাদুড়ের মধ্যে উৎপন্ন হয় এবং সরাসরি বা চীনা বাজারে আক্রান্ত প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বাদুড়ের মধ্যে এই রোগের কোন দৃশ্যমান লক্ষণ দেখা যায়নি, কিন্তু এরা সম্ভবত সার্স-জাতীয় করোনভাইরাসগুলির প্রাকৃতিক আধার। ২০০৬ সালের শেষের দিকে হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র এবং কুয়াংচৌ রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রে বিজ্ঞানীরা সিভেট (এক জাতীয় বিড়াল) এবং মানুষের মধ্যে আবির্ভূত সার্স করোনাভাইরাসের মধ্যে একটি বংশাণুগত যোগসূত্র স্থাপন করেন, যা নিশ্চিত করে যে এই ভাইরাস এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে সংক্রমিত হতে পারে।[২৪]
সার্স-কোভ-১ করোনভাইরাস উপপরিবারের সাধারণ প্রতিরূপ কৌশল অনুসরণ করে। এই ভাইরাসের প্রাথমিক মানব গ্রাহক হচ্ছে অ্যাঞ্জিওটেনটিন-রূপান্তরকারী এনজাইম ২ এবং হেমাগ্লুটিনিন,[২৫] যা প্রথম ২০০৩ সালে সনাক্ত করা হয়।[২৬][২৭]
মানব সার্স-কোভ-১ এর মধ্যে বিভিন্ন পশুর দ্বারা হোস্ট করা বংশানুক্রমিক করোনভাইরাসগুলির পুনঃসংযোগের একটি জটিল ইতিহাস ছিল বলে মনে করা হয়।[২৮][২৯] পুনঃসংযোগের জন্য অন্তত দুটি সার্স-কোভ-১ জিনোম একই হোস্ট কোষে উপস্থিত থাকতে হবে। জিনোম প্রতিলিপির সময় পুনঃসংযোগ ঘটতে পারে যখন আরএনএ পলিমারেজ এক টেমপ্লেট থেকে অন্য টেমপ্লেটে পরিবর্তিত হয়।[২৯]
করোনাভাইরাস দস্তা বা জিঙ্কের প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হয়। ফুসফুসে প্রচুর দস্তা আছে। এই ভাইরাস প্রাথমিকভাবে ফুসফুস এবং কৈশিকনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে কারণ এখানে দস্তা-সমৃদ্ধ উৎসেচক পাওয়া যায়।[৩০]
মানুষকে সংক্রামিত করার জন্য সাতটি পরিচিত করোনভাইরাসগুলির মধ্যে একটি হল সার্স-কোভ-১। অন্য ছয়টি হল[৩১]
মানব করোনভাইরাস ২২৯ই
মানব করোনভাইরাস এনএল৬৩
মানব করোনভাইরাস ওসি৪৩
মানব করোনভাইরাস এইচকিউ১
মধ্যপ্রাচ্যের শ্বাসযন্ত্রীয় রোগলক্ষণসমষ্টি সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস ২
গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রীয় রোগলক্ষণসমষ্টি সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস ২
↑"Coronaviruses (including SARS)"। Infectious Disease Advisor (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৯-০১-২০। ২০২১-০৪-১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-১৪।