সুদর্শন মহাস্থবির (দেবনাগরী: सुदर्शन महास्थविर) (বিকল্প নাম: সুদর্শন ভান্তে, জন্ম লুম্বিনী রাজ শাক্য) (১৯৩৮–২০০২) হলেন একজন নেপালি ভিক্ষু এবং লেখক, যিনি নেপালে থেরোবাদী বৌদ্ধধর্মের এবং নেপাল ভাষার সাহিত্যের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ভাষা অধিকারের সমর্থনে কর্মকাণ্ডের জন্য দমনমূলক পঞ্চায়েত শাসকেরা তাকে কারারুদ্ধ করেছিলেন।[১][২]
সুদর্শন মহাস্থবির ললিতপুরের ওকুল বহায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হ্নুচ্ছে রাজ শাক্য এবং মায়ের নাম হর্খা মায়া শাক্য। সুদর্শন মহাস্থবিরের জন্ম নাম ছিল লুম্বিনী রাজ শাক্য এবং ধর্ম নাম হলো সুদর্শন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতের কুশীনগরে যান এবং শিক্ষানবিশ ভিক্ষু হিসেবে দীক্ষা নিয়ে সুদর্শন নাম ধারণ করেন। তিনি সারনাথ থেকে উচ্চ পৌরহিত্য লাভ করেন।
সুদর্শন ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দি এবং ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে নেপাল ভাষার সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নেপালের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং প্রত্নতত্ত্বের ওপর মাস্টার ডিগ্রি লাভ করতে যান। তিনি বেশ কিছু বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এবং কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক রূপে যোগ দেন।
সুদর্শন বহুমাত্রার সাহিত্যিক ছিলেন এবং নেপাল ভাষার সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করেন। তার প্রিয় সাহিত্যধারা নাটক, এবং তিনি অন্তত নয়টি নাটক রচনা করেন। নাটকগুলোর অধিকাংশই বৌদ্ধধর্মীয় পটভূমির ওপর রচিত ছিল। এছাড়াও তিনি গদ্য এবং কবিতা রচনা করেন। নেপাল ভাষার পাশাপাশি তিনি নেপালি এবং ইংরেজি ভাষাতেও সাহিত্যরচনা করেন। বৌদ্ধধর্মের ওপর তার রচিত একাধিক বই ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।[৩]
এছাড়াও সুদর্শন মহাস্থবির সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি দৈনিক নেপাল ভাষা পত্রিকা, মাসিক ধর্মোদয়, মাসিক লুম্বিনী এবং বার্ষিক পূর্ণিমা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
এছাড়াও সুদর্শন লুম্বিনীতে একটি বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য লুম্বিনী বিকাশ কোষ (লুম্বিনী ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্ট) নামক একটি প্রাথমিক সরকারি কমিটির সদস্য মনোনীত হন। এই পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে লুম্বিনী বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।[৪]
সুদর্শন কীর্তিপুরে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে থাই স্থাপত্যশৈলীতে স্বনির্মীত শ্রী কীর্তি বিহার নামক থেরোবাদী বৌদ্ধ বিহারের মঠাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এছাড়াও বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা দানের জন্য তিনি এখানে শ্রী কীর্তি বৌদ্ধধর্ম কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।[৩][৫]
সুদর্শন নেপাল ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে নেপালের পঞ্চায়েত সরকার (১৯৬২-১৯৯০) নেপালের রাষ্ট্রীয় ও তৎকালে দেশটির একমাত্র রেডিও স্টেশন রেডিও নেপাল থেকে নেপাল ভাষায় সম্প্রচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।[৬] সুদর্শন মহাস্থবির এর প্রতিবাদে আয়োজিত গণবিক্ষোভে অংশ নেন এবং সে কারণে নিরাপত্তা আইনে আটক হয়ে ছয় মাস ও ছয় দিন কারারুদ্ধ থাকেন।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর নেপাল সরকারের ডাক সেবা বিভাগ দেশের প্রতি সুদর্শন মহাস্থবিরের অবদানের প্রতি সম্মান জানিয়ে সচিত্র স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন করে।[৭]
নেপাল ভাষার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে নেপাল ভাষা পরিষদ তাকে ভাষা থুওয়া ("ভাষার পোষক বা রক্ষক") উপাধি প্রদান করে। কাঠমান্ডুর সর্বশেষ রাজা জয়প্রকাশ মল্লের ওপর রচিত তার নাটক জুজু জয় প্রকাশ ("রাজা জয় প্রকাশ") এর জন্য ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি "শ্রেষ্ঠ শিরোপা" অর্জন করেন।
১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০০২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে সুদর্শন মহাস্থবির নাটক, জীবনী, অনুবাদ, প্রবন্ধ এবং কবিতা রচনা করেছেন। তিনি নেপালিতে চারটি এবং নেপাল ভাষায় ৭৫টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। তার রচিত নাটকের মধ্যে রয়েছে অম্বাপালি (১৯৫৫), রাষ্ট্রপাল (১৯৫৮), অমৃতমায়া মৌন (১৯৫৮), জুজু জয় প্রকাশ (১৯৬২), ৮৫ পাও (১৯৬২), অশঙ্ক (১৯৭১), প্রতিশোধ (১৯৮৬), নির্বাণ (১৯৯৩) এবং পাতাছারা (১৯৯৭) ইত্যাদি।[৮]