সৌর পদার্থবিজ্ঞান (ইংরেজি: Solar physics) হল জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের একটি শাখা। সূর্য পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা এই শাখার উপজীব্য বিষয়। সূর্য পৃথিবীর নিকটতম নক্ষত্র এবং নক্ষত্রগুলির মধ্যে একমাত্র সূর্যেরই বিস্তারিত তথ্য-পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব। এই সব তথ্য-পরিসংখ্যানই সৌর পদার্থবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়বস্তু। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা সৌর পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। এগুলি হল বিশুদ্ধ পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান, কম্পিউটার বিজ্ঞান, ফ্লুইড ডায়নামিকস, প্লাজমা পদার্থবিজ্ঞান, ম্যাগনেটোহাইড্রোডায়নামিকস, ভূকম্পনবিজ্ঞান, কণা পদার্থবিজ্ঞান, আণবিক পদার্থবিজ্ঞান, পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান, নাক্ষত্রিক বিবর্তন, মহাকাশ পদার্থবিজ্ঞান, বর্ণালিবিজ্ঞান, রেডিয়েটিভ ট্রান্সফার, ফলিত আলোকবিজ্ঞান, সিগনাল প্রসেসিং, কম্পিউটার ভিশন, পরিগণনা-সংক্রান্ত পদার্থবিজ্ঞান, নাক্ষত্রিক পদার্থবিজ্ঞান ও সৌর জ্যোতির্বিজ্ঞান।
পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে সূর্য যেহেতু সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে পৃথিবীর খুব কাছে অবস্থিত (সূর্যের স্থানিক বা সময়গত যে রেজোলিউশন পাওয়া সম্ভব, তা অন্য নক্ষত্রের ক্ষেত্রে পাওয়া সম্ভব নয়), সেই হেতু (দূরবর্তী নক্ষত্রগুলির) পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান ও পর্যবেক্ষণমূলক সৌর পদার্থবিজ্ঞানের মধ্যে একটি বিশেষ বিভাজনরেখা সৃষ্টি হয়েছে।
প্লাজমা পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি "ভৌত পরীক্ষাগার" ("physical laboratory") হিসাবেও সৌর পদার্থবিজ্ঞানের পর্যালোচনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।[১]
ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যগ্রহণের ঘটনাগুলি নথিভুক্ত করে রাখতেন। তাদের নথিতে উল্লিখিত প্রাচীনতম সূর্যগ্রহণের ঘটনাটি ঘটেছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ অব্দ নাগাদ। অধুনা সিরিয়া রাষ্ট্রে অবস্থিত প্রাচীন উগারিট শহর থেকে এই সূর্যগ্রহণটি দেখা গিয়েছিল।[২] প্রাচীন চীনা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও তাদের চাদ্র ও সৌরচক্র-ভিত্তিক পঞ্জিকার হিসাব রাখার উদ্দেশ্যে সূর্যগ্রহণ ও দৃশ্যমান সৌরকলঙ্কের মতো ঘটনাগুলি পর্যবেক্ষণ করতেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৭২০ অব্দের পূর্ববর্তী নথিগুলি অত্যন্ত অস্পষ্ট। এগুলির থেকে দরকারি কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৭২০ অব্দের পর ২৪০ বছরের মধ্যে ৩৭টি সূর্যগ্রহণের কথা তারা উল্লেখ করে গিয়েছেন।[৩]
মধ্যযুগীয় ইসলামি বিশ্বে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা বিশেষ সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। সেই সময় দামাস্কাস থেকে বাগদাদ পর্যন্ত একাধিক শহরে অনেকগুলি মানমন্দির গঠিত হয়। এগুলি থেকে বিস্তারিতভাবে জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের কাজ চলত। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এই সব মানমন্দির থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অল্প কয়েকটি সৌর স্থিতিমাপ গ্রহণ করেন এবং সূর্যকে বিস্তারিতভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। মানচিত্র ও যন্ত্রপাতির সাহায্যে জাহাজের যাত্রাপথ বা অবস্থান নির্ণয়ের জন্য সৌর পর্যবেক্ষণের কাজ চলত। তবে এই পর্যবেক্ষণের মূল্য উদ্দেশ্য ছিল সময় গণনা। মুসলমানেরা আকাশে সূর্যের নির্দিষ্ট অবস্থান অনুযায়ী দিনে পাঁচ বার নামাজ পড়েন। সেই জন্য সূর্য ও আকাশে সূর্যের গতিপথ নিঁখুতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হত। ১০ম শতাব্দীতে ইরানীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবু-মাহমুদ খোজান্দি তেহরানের কাছে প্রকাণ্ড একটি মানমন্দির নির্মাণ করেন। সেখান থেকে তিনি পরপর সূর্যের মধ্যরেখা অতিক্রমণের নিঁখুত পরিমাপ গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে সেই পরিমাপগুলির তিনি ক্রান্তিকোণ নির্ণয়ের কাজে ব্যবহার করেছিলেন।[৪]
পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পশ্চিম ইউরোপ প্রাচীন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সমস্ত সূত্রগুলির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। বিশেষত গ্রিক ভাষায় লিখিত সূত্রগুলি বিস্মৃতির আড়ালে চলে যায়। সেই সঙ্গে নগরাঞ্চল থেকে দলে দলে মানুষের গ্রামাঞ্চলে চলে আসা ও ব্ল্যাক ডেথের মতো মহামারীর প্রকোপে মধ্যযুগীয় ইউরোপে, বিশেষত মধ্যযুগের গোড়ার দিকে, বিজ্ঞানচর্চার বিশেষ অবনতি ঘটে। সেই সময় সূর্য পর্যবেক্ষণ হয় রাশিচক্রের পরিপ্রেক্ষিতে অথবা চার্চ ও ক্যাথিড্রালের মতো উপাসনালয় নির্মাণকার্যের প্রয়োজনে জন্য করা হত।[৫]
জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রেনেসাঁ যুগের সূত্রপাত ঘটে নিকোলাস কোপারনিকাসের গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। তিনি বলেন, গ্রহগুলি পৃথিবীকে নয়, সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। তার এই মতবাদ সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্ব নামে পরিচিত।[৬] পরবর্তীকালে জোহানেস কেপলার ও গ্যালিলিও গ্যালিলি তার মতবাদটিকে সম্প্রসারিত করেন। গ্যালিলিও সূর্য পর্যবেক্ষণের কাজে তার নতুন দূরবিন ব্যবহার করেন। ১৬১০ সালে তিনি সূর্যের পৃষ্ঠভাগে সৌরকলঙ্ক আবিষ্কার করেন। ১৬১১ সালের শরতে জোহানেস ফ্যাব্রিসিয়াস সৌরকলঙ্ক-বিষয়ক প্রথম বই দে মাকুলিস ইন সোল অবসারভাতিস (সূর্যে পর্যবেক্ষিত কলঙ্ক প্রসঙ্গে) রচনা করেন।[৭]
বর্তমান যুগে সৌর পদার্থবিজ্ঞানের উপজীব্য বিষয় হল আধুনিক দূরবিন ও কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে সূর্য পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা। সৌর আলোকমণ্ডলের গঠন, সৌরকিরীটের উত্তাপ-সংক্রান্ত সমস্যা এবং সৌরকলঙ্ক এযুগের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিশেষ আগ্রহের বিষয়।[৮]
আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির সোলার ফিজিক্স ডিভিশন ৫৫৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত (২০০৭ সালের মে মাসের হিসাব অনুযায়ী)।[৯]
২০০৯ সালে সূর্য সহ সমগ্র সৌরজগৎ এবং সৌরগোলকের আন্তঃগ্রহ মহাকাশের মধ্যে এবং গ্রহ ও গ্রহগুলির বায়ুমণ্ডলের উপর সূর্যের প্রভাব সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য সৌর পদার্থবিজ্ঞান গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সৌরগোলকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক প্রভাববিস্তারকারী ঘটনাগুলির অনুসন্ধান অথবা সৌরগোলকীয় ক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সকল বিষয়গুলিকে হেলিওফিজিক্স নামে অভিহিত করা হয়। বর্তমান সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে এই শব্দটির প্রচলন ঘটেছিল।
২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নাসা কেপ ক্যানাভেরাল থেকে সোলার ডায়নামিক্স অবজার্ভেটরি (এসডিও) উৎক্ষেপণ করে। এই মিশনের প্রধান উদ্দেশ্য হল কীভাবে সৌর সক্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কীভাবে তা পৃথিবীর জীবনের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব বিস্তার করছে এবং কীভাবে সঞ্চিত চৌম্বক শক্তি রূপান্তরিত ও মহাকাশে মুক্তি লাভ করছে, তার অনুসন্ধান চালানো।[১০]
সোলার অ্যান্ড হেলিওস্ফেরিক অবজার্ভেটরি (এসওএইচও) হল নাসা ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির একটি যৌথ প্রকল্প। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্মর মাসে এটি উৎক্ষেপিত হয়। সূর্যের আভ্যন্তরিণ গঠন অনুসন্ধান, সৌরবায়ু এবং তার সঙ্গে জড়িত ঘটনাগুলি পর্যবেক্ষণ এবং সূর্যের বহিঃস্থ স্তরগুলি অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে এটি উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল।[১১]
হাইনোড উপগ্রহটি জনসাধারণের অর্থসাহায্যে জাপানিজ এরোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি পরিচালিত একটি মিশন। ২০০৬ সালে এটি উৎক্ষেপিত হয়। এই উপগ্রহটি আলোকীয়, অত্যধিক অতিবেগুনি ও রঞ্জন-রশ্মি যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে গঠিত। এগুলির সাহায্যে সৌরকিরীট ও সূর্যের চৌম্বকমণ্ডলের মধ্যবর্তী পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলি পর্যবেক্ষণ করা হয়।[১২][১৩]
অ্যাডভান্সড টেকনোলজি সোলার টেলিস্কোপ (এটিএসটি) হল মাউইতে নির্মাণাধীন একটি সৌর দূরবিন প্রকল্প। এই প্রকল্পে বাইশটি সংস্থা সহকারীরূপে কাজ করছে। ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন এই প্রকল্পের প্রধান আর্থিক সহযোগী।[১৪]
সানস্পট সোলার অবজার্ভেটরি (এসএসও) ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের (এনএসএফ) পক্ষ থেকে রিচার্ড বি. ডান সোলার টেলিস্কোপ (ডিএসটি) পরিচালনা করে।
ক্যালিফোর্নিয়ার বিগ বিয়ার সোলার অবজার্ভেটরিতে বেশ কয়েকটি দূরবিন রয়েছে। নিউ সোলার টেলিস্কোপ (এনটিএস) সেগুলির অন্যতম। এটি ১.৬ মিটার দীর্ঘ, ক্লিয়ার-অ্যাপারচার, অফ-অ্যাক্সিস গ্রেগরিয়ান দূরবিন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে এই দূরবিনটি কাজ শুরু করে। এটিএসটি চালু হওয়ার আগে এনটিএস ছিল বিশ্বের বৃহত্তম সৌর দূরবিন। বিগ বিয়ার অবজার্ভেটরি হল নিউ জার্সি ইনস্টিটিটিউট অফ টেকনোলজির (এনজেআইটি) সেন্টার ফর সোলার-টেরেস্ট্রিয়াল রিসার্চ পরিচালিত অন্যতম প্রকল্প।[১৫]
এক্সট্রিম আল্ট্রাভায়োলেট নর্ম্যাল ইন্সিডেন্স স্পেক্ট্রোগ্রাফ (ইউনিস) হল দু-টি চ্যানেল ইমেজিং বর্ণালি-লেখ। ২০০৬ সালে এগুলি প্রথম উৎক্ষেপিত হয়। এগুলি উচ্চ বর্ণালিগত রেজোলিউশন থেকে সৌরকিরীট পর্যবেক্ষণ করে। এখনও পর্যন্ত সৌরকিরীটের উজ্জ্বল বিন্দুগুলির প্রকৃতি, শীতল ট্রানজিয়েন্ট ও সৌরকিরীট বাঁকের আর্কেডগুলির সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করেছে। এগুলি থেকে প্রাপ্ত তথ্য-পরিসংখ্যান সোলার অ্যান্ড হেলিওস্ফেরিক অবজার্ভেটরি সহ অন্য কয়েকটি দূরবিনের ক্রমাঙ্ক নির্ণয় বা সংশোধনের কাজেও সহায়ক হয়েছে।[১৬]